ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ কোটি ৩১ লাখ ১৩৭ টাকার বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। অথচ এতো বড় আয়োজন ঘিরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার-পানি কিছুই ছিল না। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঘটনার সমালোচনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলোও এই প্রতিক্রিয়ার সাথে সহমত পোষণ করেছেন।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ কোটি টাকার গবেষণা প্রকল্পের সময়ও পার হয়ে গেছে! এ নিয়েও সংশ্লিষ্ট মহলে রয়েছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা প্রকল্পের জন্য ২০২০-২১ অর্থ বছরে ২০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই অর্থবছরে শিক্ষকদের গবেষণার জন্য ১ টাকাও খরচ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এক বছর পরে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থ বছরে এসে মৌলিক ও প্রয়োগিক গবেষণা বৃদ্ধি এবং জার্নালসমূহে আধুনিকায়ণ ও শতবর্ষের উপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের লক্ষ্যে গবেষণা সংক্রান্ত কাজে ওই ২০ কোটি টাকাকে বরাদ্দ দেয়া হয়। এটার দায়িত্বে ছিলেন প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল।
পরে গবেষণার এই খাত থেকে শতবর্ষের আলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষক বিশেষ স্মারক প্রকাশনায় ব্যয় হয়েছে ৩৫ লাখ ১৩ হাজার ৬৭৫ টাকা। এ কাজের দায়িত্বে ছিলেন দুর্নীতির দায়ে বিতর্কিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাত থেকে এই খরচ মেটানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্নও রয়েছে।
বিবার্তা২৪ ডটনেটের হাতে আসা প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, শতবর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতির জন্য মঞ্চ তৈরি ও সাজ-সজ্জা, আসন ব্যবস্থাপনা বাবদ বরাদ্দ হয়েছে ১ কোটি ৫২ লাখ ১৯ হাজার ৭১৭ টাকা। অথচ মহামান্য রাষ্টপ্রতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ এবারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি বঙ্গভবন থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে সংযুক্ত ছিলেন।
তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের আন্তর্জাতিক কনফারেন্স ও সেমিনার (ওয়েবিনার) আয়োজন বাবদ বরাদ্দ ছিল ৭৯ লাখ ১ হাজার টাকা। এ কাজের দায়িত্বে ছিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৫টি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এসব গ্রন্থের মধ্যে দু’টি গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো আর্থিক বিধি-বিধান না মেনে অর্থ ব্যয়ে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। এ দু’টি গ্রন্থের সম্পাদনায় জড়িত দুই সম্পাদকের জন্য বরাদ্দ ৯ লাখসহ সম্পাদনায় মোট ব্যয় করা হয়েছে ২০ লাখের অধিক টাকা। অথচ বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতি গ্রন্থ সম্পাদনায় সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে থাকে।
ক্রমিক ৫ এ উল্লেখিত History of Dhaka University গ্রন্থের সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন প্রাক্তন অধ্যাপক ড. শরিফ উদ্দিন আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন এই অধ্যাপক বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। এ গ্রন্থ সম্পাদনার জন্য তার সম্মানী তিন লাখসহ এ গ্রন্থের জন্য ব্যয় হয়েছে ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।
ক্রমিক ৬ এ উল্লেখিত The Role of Dhaka University in Making and Shaping Bangladesh নামক গ্রন্থের সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমিরেটাস অধ্যাপক প্রফেসর ড. এ.কে আজাদ চৌধুরী। তাকে একটি মাত্র গ্রন্থ সম্পাদনার জন্য সম্মানী বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬ লাখ টাকা। এই সম্মানীসহ সব মিলিয়ে এই গ্রন্থের জন্য মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই দুইটি গ্রন্থের জন্য ব্যয় হয়েছে ৫৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা।
৪ দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৪৪ লাখ ৬৫ হাজার। এরমধ্যে থিম সংয়ের ব্যয় ছিল ৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরও জানা যায় যে, ফটোগ্রাফি কম্পিটিশন, এক্সিবিশন, পাবলিকেশন ইত্যাদির দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ড. এ জে এম সফিউল আলম ভূঁইয়া। এ কাজে বরাদ্দ হয়েছে ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
সৌন্দর্য বর্ধনের দায়িত্বে ছিলেন জীববিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক মিহির লাল সাহা। এ কাজে ব্যয় হয়েছে ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
ডুকুমেন্টারি ( প্রামাণ্যচিত্র) নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রফেসর ড. এ জে এম সফিউল আলম ভূঁইয়া। এ কাজের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১২ লাখ ১০ হাজার টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের অনুষ্ঠানে মোট বরাদ্দ হয়েছে ২৪ কোটি ৩১ লাখ ১৩৭ টাকা। অথচ এতো বড় বাজেট সত্ত্বেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার-পানি কিছুই ছিল না। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ঘটনার সমালোচনায় সরব তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলোও এই প্রতিক্রিয়ার সাথে সহমত পোষণ করেছেন।
শতবর্ষের অনুষ্ঠানের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বিবার্তাকে বলেন, ২৪ কোটি টাকায় গণরুমের অন্ধকার দূর করার লক্ষ্যে একটা হল করতে পারতো কিংবা কিছু হলের এক্সটেনশন করতে পারতো।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি সোহান খান বিবার্তাকে বলেন, শতবর্ষের অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খাবার-পানি পায়নি। বিষয়টা দুঃখজনক।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক রাকিবুল ইসলাম রাকিব বিবার্তাকে বলেন, শতবর্ষের অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খাবার-পানিও পায়নি। আমরা এ ঘটনার জন্য তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাই। শিক্ষার্থীদের খাবার-পানির জন্য তো কোটি কোটি টাকা খরচ হতো না। কয়েক লাখ টাকা বরাদ্দ করলে হতো। কিন্তু তাও করা হলো না ! বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন করে কী ?
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী), ঢাবি শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বিবার্তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের আয়োজন শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করা হয়নি। শিক্ষার্থীরা পুরো প্রক্রিয়ার সাথে বিচ্ছিন্ন ছিল। তারা এ অনুষ্ঠানে আবেগের সাথে যুক্ত থাকতে পারেনি।
তিনি বলেন, শতবর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি বড় মাইলফলক। সেখানে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটগুলো গুরুত্বের সাথে আলোচিত হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা হয়নি! এছাড়া যে সাজসজ্জা করা হয়েছে সেটাও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যায় না। চারুকলা অনুষদের কাছে দায়িত্ব দিলে তারা খুব সুন্দরভাবে এটা করতে পারতেন। সবমিলিয়ে এ অনুষ্ঠান প্রত্যাশার দাঁড়ে কাছেও ছিল না।
শতবর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের খাবার-পানি না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, এসব বিষয়ে আর কী বলবো। আমাদের সকল আয়োজনই আসলে শিক্ষার্থীদের জন্য। তবে আয়োজনের ঘাটতি থাকতে পারে। শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার , পানি এসব বিষয়ে আরো নজর দেয়া দরকার ছিল।
বিবার্তা/রাসেল/কেআর
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]