শিরোনাম
মহেশখালীতে রাজাকার পরিবারের কাছে জিম্মি মুক্তিযোদ্ধা!
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:৫৪
মহেশখালীতে রাজাকার পরিবারের কাছে জিম্মি মুক্তিযোদ্ধা!
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

মহেশখালী পৌর শহরের গোরকঘাটা বাজার এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন (৬৫)। গেল অক্টোবরে তার চিংড়ি ঘের থেকে মাছ লুটের ঘটনায় ডাকাতি মামলা করেন তিনি। কিন্তু মামলা করে উল্টো নিজেই পরিবারসহ এলাকা ছাড়া হয়ে যান আমজাদ। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেন। জেলা শহরে সংবাদ সম্মেলন করে সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারানোর শঙ্কার কথাও জানান তিনি।


এতকিছুর পরও মুক্তি পাননি তিনি। গত ২৪ নভেম্বর রাতে যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যদের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে আমজাদকে।


তার পরিবারের সদস্যরা জানান, দেশের জন্য জন্য জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন আমজাদ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজ সেই দেশেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে পড়েছেন তিনি। চিংড়ি ঘের থেকে মাছ লুটের ঘটনার মামলা রাজাকার পরিবারের সন্তানদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় তারা আমজাদ হোসেন ও তার পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছিলো। গত ২৪ নভেম্বর সেই আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে আমজাদ হোসেনের ওপর হামলা চালায় রাজাকারপুত্র মহেশখালী পৌর মেয়র মকছুদ মিয়া ও তার স্বজনরা।


বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেনের পরিবার সূত্রে জানা যায়, গেল অক্টোবর মাসে চিংড়ি প্রজেক্টের ১৫ মন চিংড়ি ও মাছ ধরার জাল লুট করে নিয়ে যায় পৌর মেয়র মকছুদ মিয়া এবং তার অনুসারীরা। এ ঘটনায় মহেশখালী থানায় মামলার আবেদন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন। কিন্তু মহেশখালী থানার ওসি মামলাটি থানায় রেকর্ড না নেয়ায় মহেশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এজাহার দায়ের করেন তিনি। পরে মহেশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আব্বাস উদ্দিনের আদালত আবেদনটি আমলে নিয়ে মহেশখালী থানার ওসিকে মেয়র মকছুদ মিয়াসহ ৩১ জনের বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড করার নির্দেশ দেন। মামলাটি রেকর্ড হওয়ার পর থেকে পৌর মেয়র মকছুদ মিয়া ও তার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেনকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছিলো বলে জানান পরিবারের সদস্যরা।


এর জের ধরে মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন ও তার পরিবারকে গ্রাম ছাড়া করার অভিযোগ ওঠে। এরপর মুক্তিযোদ্ধা ওই পরিবার পালিয়ে কক্সবাজার শহরে এসে আশ্রয় নেন। নিজের প্রাণনাশের আশঙ্কার কথা সংবাদ সম্মেলন করে জানান আমজাদ। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডিও করেন তিনি। এ নিয়ে গত ২৮ অক্টোবর দুপুরে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মহেশখালী পৌর মেয়র মকছুদ মিয়ার বিরুদ্ধে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগ আনেন তারা।


মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন অভিযোগ করে জানান, গত ১৯ অক্টোবর রাতে মহেশখালী পৌর মেয়র মকছুদ মিয়ার নির্দেশে ৩০ থেকে ৩৫ জনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আমজাদ হোসেন ও তার পরিবারের ৬৭ একর বিশিষ্ট একটি চিংড়ি ঘের দখল করে নেয়। এ সময় সন্ত্রাসীরা চিংড়ি ঘেরের পরিচালক এবং কর্মচারীদের কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে তারা চিংড়ি ঘেরের কয়েক লাখ টাকার চিংড়ি, লবণ ও মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।


এ ব্যাপারে আদালতে মেয়র মকছুদ মিয়াসহ তার লোকজনদের বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা করলে আদালতের নির্দেশে মহেশখালী থানার পুলিশ গত ২৫ অক্টোবর মামলা নথিভুক্ত করে।



এরপর মহেশখালী ছাড়া ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ পরিবার। পৌর মেয়র মকছুদের অনুসারীরা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডিও করেন তিনি। তবে জিডি করেও শেষ রক্ষা হয়নি। গত ২৪ নভেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে এশার নামাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে মহেশখালী পৌর এলাকার গোরকঘাটা হিন্দুপাড়া রাস্তার মোড়ে প্রায় ২০-২৫ জন সন্ত্রাসী তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে ফেলে চলে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে মহেশখালী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রেফার করেন।


জানা গেছে, এঘটনায় গত ২৬ নভেম্বর পৌর মেয়র মকছুদসহসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে নিজে বাদী হয়ে মহেশখালী থানায় মামলা দায়ের করেছেন আমজাদ হোসেন। মামলা নং- ১৬। এ ঘটনার পর জিম্মি দশা থেকে মুক্তি চেয়ে গত ২৮ নভেম্বর আবারো সংবাদ সম্মেলন করেছেন আমজাদ হোসেনের পরিবারের সদস্যরা।


এদিকে মহেশখালী উপজেলার সদ্য সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কামাণ্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেনের এক ছেলে বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হলেও অদৃশ্য কারণে গেজেটে নাম তালিকাভুক্ত হয়নি বলে দাবি করছেন।


জানা গেছে, মো. আনোয়ার নামে তার এক ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করেছেন। ৩৮তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন তিনি। তবে পুলিশ ভ্যারিফিকশনে তাকে আটকে দেয়া হয়েছে।


তথ্যমতে, যুদ্ধাপরাধী মামলা তালিকার ২২ নম্বর আসামি হাশেম সিকদার ওরফে বড় মোহাম্মদের ছেলে মকছুদ মিয়া। হাশেম শান্তি কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মকছুদ মিয়ার চাচা মৌলভী জাকারিয়া সিকদার ওই কমিটির সভাপতি ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি। ট্রাইব্যুনাল থেকে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এছাড়া ১৯৭১ সালে হিন্দু সম্প্রাদায়ের ওপর তাণ্ডব চালিয়েছে ওই পরিবারের ৯ সদস্য। যাদের বিরুদ্ধে আদালতে বিচার চলমান রয়েছে।


জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা একমাত্র মামলার এক নম্বর আসামি মাওলানা জাকারিয়া। মেয়র মকছুদ মিয়া হচ্ছেন মাওলানা জাকারিয়া পরিবারের সন্তান ও স্বীকৃত রাজাকার হাশেম শিকদারের ছেলে। মকছুদ এখন জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মহেশখালী পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক।


অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মহেশখালী পৌর মেয়র মকছুদ মিয়া বিবার্তাকে বলেন, আমি তার ওপর কেন হামলা করবো? হামলার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমার মনে হয়, তার মানসিক সমস্যা আছে, তাই আমার নাম জড়িয়েছে। আমি ওইদিন এলাকায় ছিলাম না। তার ওপর হামলা কারা করেছে জানি না। চাচা খাইরুল আমিন হত্যা মামলায় আমজাদ অভিযুক্ত। মামলার কার্যক্রমকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করতে তিনি নাটক সাজাচ্ছেন।


আহত মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেনের ছেলে মো. আনোয়ার বিবার্তাকে বলেন, রিকশা নিয়ে গোরকঘাটা বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে হিন্দুপাড়া রাস্তার মোড়ে রিকশার গতিরোধ করে মেয়র মকছুদ মিয়া, তার ছেলে ইয়াবা মামলার আসামি নিশান, ভাগিনা মামুন এবং আত্মীয় মহিউদ্দিন ও শামসুদ্দিনসহ আরো বেশ কয়েকজন হামলা চালায়। এ সময় তারা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। মাথায় ৩টা কোপ লেগেছে।


তিনি আরো বলেন, রাজাকার সন্তান পৌর মেয়র মকছুদের সাথে আপস না করায় দলবল নিয়ে আমার বাবাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়েছে। কিছুদিন আগে মাছ লুটের ঘটনায় মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বাবা। এরপর থেকেই আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম। আমার বাবা ২০১৪ সাল থেকে উপজেলার নির্বাচিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমাণ্ডার ছিলেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার ও তার সহায় সম্পদ যদি এ রাষ্ট্রে নিরাপদ না হয়, রাজাকারপুত্রের কাছে জিম্মি দশায় থেকে লুটতরাজ ও ডাকাতির শিকার হতে হয়, তাহলে আমরা কোথায় আশ্রয় নেবো?


কক্সবাজার জেলার সাবেক সহকারী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাসুদ কুতুবী বিবার্তাকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একজন মুক্তিযোদ্ধার ওপর রাজাকার পরিবারের সদস্যরা হামলা করেছে, এটা অত্যন্ত বেদনার। এখানে যারা আওয়ামী লীগ করছে তাদের বেশিরভাগেরই কোনো নীতি নেই। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা এনেছেন, সফলতা এনেছেন। এখন এটা রক্ষা করতেই প্রধানমন্ত্রী হাবুডুবু খাচ্ছেন। মেয়র মকছুদের বাবা যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামি। আওয়ামী লীগের নমিনেশন দিয়ে তাকে মেয়র বানানো হয়েছে। তাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এধরনের লোকদের যদি আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত করে তাহলে আর কী বলার আছে?


বিবার্তা/সোহেল/কেআর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com