শিরোনাম
নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেও নৌকা পেলেন আসাদুল
প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২১, ০৮:১৯
নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেও নৌকা পেলেন আসাদুল
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. আছাদুল হক। দেবহাটা উপজেলার ১নং কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান তিনি। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ কার্যকরী কমিটির ৩৭ জন স্বাক্ষর করে আছাদুল হককে দলীয় প্রতীক নৌকায় মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। পরে সেই নাম পাঠান কেন্দ্রে।


তবে সেই ইউনিয়নে মনোনয়ন পেয়েছেন গেলো ইউপি নির্বাচনে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থীর ভাই আসাদুল ইসলাম। যার বিরুদ্ধে ইউপি নির্বাচন ছাড়াও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে কাজ করা ও স্থানীয় জামায়াত নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে।


এদিকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ মনোনয়নের জন্য একক নাম পাঠালেও স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রভাব খাটিয়ে আরো নাম যুক্ত করেছেন এমন অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের। এক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও রয়েছে। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাকে বাদ দিয়ে ইউপি নির্বাচনে আসাদুলকে মনোনয়ন দেয়ায় ক্ষুদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতারা তৃণমূল আওয়ামী লীগকে বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছেন।



জানা যায়, গত ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত কাগজে আসাদুল ইসলামকে মনোনয়ন দেয়া হয়। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে তার ভাই ইমাদুল ইসলাম নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে প্রার্থী ছিলেন। ভাইয়ের পক্ষে সেসময় নির্বাচনী প্রচারণায়ও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন আসাদুল ইসলাম। তিনি পড়ালেখা করেছেন জামায়াত নিয়ন্ত্রিত পারুলিয়া দাখিল মাদ্রাসায়। কুলিয়া ইউনিয়ন জামায়াত নেতাদের সাথেও তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তাদের সাথে তাকে দেখা যায়। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, এসব জামায়াত নেতাদের আর্থিক সহায়তায়ও করেন তিনি।


গত ২৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবরে কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দেয়া আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পুনঃবিবেচনার আবেদন করেছেন আছাদুল হক। আবেদনে তিনি জানান, দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্রোহী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হবে না জেনে চাতুরতার সাথে তার ছোট ভাই আসাদুল ইসলামকে দিয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। নৌকার মনোনয়ন প্রাপ্ত আসাদুল ইসলাম আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। উল্টো তার মদদে কুলিয়া ইউনিয়নের জামায়াত-বিএনপি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।


জানা যায়, আছাদুল হক ১৯৬৭ সালে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে মহকুমা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। দীর্ঘদিন সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ আছাদুল বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেীকার বিদ্রোহী সমর্থকদের হামলায় পঙ্গুত্ব বরণ করেন তার কনিষ্ঠ সন্তান মো. শরীফ রেজা।


কুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গত ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির ৩৭ জন স্বাক্ষর করেন। সভায় মো. আছাদুল হককে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।



স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দেবহাটা উপজেলার ১নং কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মো. আছাদুল হকের সমর্থনে কুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নয়টি ওয়ার্ডের সভাপতি, সম্পাদক ছাড়াও ইউনিয়ন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ সভাপতি-সম্পাদক লিখিত সুপারিশ করেছেন।


কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে সুপারিশ জানানো প্রত্যয়নপত্রে তারা বলেন, কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য একমাত্র জনপ্রিয় ও যোগ্য ব্যক্তি আছাদুল হক। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের দুঃসময়ে তিনি সর্বপ্রকার সহযোগিতা করেছেন। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ জনগণের নিরাপত্তায় দুঃসাহসিকতার সাথে বিরল ভূমিকা পালন করেছেন। দলের দুঃসময়ের প্রকৃত বন্ধু, রাজপথের লড়াকু সৈনিক উল্লেখ করে তাকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেয়ার সুপারিশ করেন তারা।


অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মনোময়ন পাওয়া মো. আসাদুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, এগুলো সব মিথ্যা অভিযোগ। আমার ভাই ছাত্রলীগ করতো। দীর্ঘদিন সে দেশের বাইরে ছিলো। সে সময়ে তৃণমূল থেকে মতামত না নিয়ে জেলা থেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। তাই নৌকা পায়নি। তার নির্বাচনী প্রচারণায় আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। আমরা ভাই-ভাই আলাদা ফ্যামিলি। জামায়াত নেতাদের সাথে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা রক্তে-মাংসে আওয়ামী লীগ করি। আমি আওয়ামী পরিবারের সন্তান। জামায়াত নেতাদের সাথে আমার সম্পর্ক থাকবে কেন বলেন?


সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. আছাদুল হক বিবার্তাকে বলেন, আমি ৩৯ বছর ধরে জনপ্রতিনিধি। ১৯৬৭ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। যে জীবনে আওয়ামী লীগ করলো না তার হাতে নৌকা কিভাবে দেয়া হয়? আমার এলাকায় সহযোগী সংগঠন আছে, আমি কাউকে চাঁদাবাজি করতে দেই না। কোনো অনুষ্ঠান করলে সব খরচ আমার। একটা মানুষের সাথে আরেক মানুষের বিরোধ থাকতে পারে; কিন্তু আমার বেলায় কারো অভিযোগ নেই। আজকে আমার দুর্ভাগ্য। আসাদুল জামায়াতের মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছে। জামায়াত নেতাদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতাও রয়েছে। অথচ তাকেই নৌকা দেয়া হলো।


সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) ফজলুল হক বিবার্তাকে বলেন, আসাদুলের ভাই নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করে জিতেছিলো। সে বিদেশে চলে গেছে। যে আছে সে এবার নৌকার মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করেছে। তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।


দেবহাটা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান বিবার্তাকে বলেন, বর্তমানে এটাই হলো নিয়ম। আমি উপজেলা চেয়ারম্যান। উপজেলা নির্বাচনে আসাদুল ইসলাম ও নোয়াপাড়ার আলমগীর হোসেন দুইজনই আমাদের নৌকার বিরোধিতা করেছে। অথচ আজ তারা দু’জনেই নৌকার মনোনয়ন পেয়েছে। আছাদুল হক সারাজীবন আওয়ামী লীগের লোক। ইউনিয়ন থেকে আছাদুল হকের একক নাম দেয়া হয়েছে। এমপি সাহেব ডিও লেটার দিয়েছেন। যার কারণে আরো নাম যুক্ত করে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।



এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১নং কুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিধান বর্মণ বিবার্তাকে বলেন, আছাদুল হক গতবার নৌকা পেয়েছিলেন, তাই তাকে সবাই মিলে মনোনয়ন দিয়েছে। তিনি সবসময় আমাদের পাশে ছিলেন। এবার যিনি নৌকা প্রতীক পেয়েছেন তার ভাই গত নির্বাচনে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। এবারের প্রার্থী সেসময় নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। আমাদের ইউনিয়নের পাঁচটি সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদক আছাদুল হককে মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছি; কিন্তু আমাদের কোনো মূল্য নেই। এভাবে হলে নির্বাচন দলীয়ভাবে উন্মুক্ত করে দেয়া হোক অথবা সম্ভব হলে প্রার্থী পরিবর্তন করা হোক। আমরা খুব কষ্টে আছি।


কুলিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মোশারফ হোসেন বিবার্তাকে বলেন বলেন, আমরা আমাদের জীবনটা ভিক্ষা চাচ্ছি। জীবনটা হাতে নিয়ে এলাকায় ঘুরছি। দীর্ঘদিনের প্রবীণ নেতা, যিনি ২০১৩ সালে নাশকতা প্রতিরোধে জীবনবাজী রেখে লড়াই করেছেন। তাকে বাদ দিয়ে আসাদুল ইসলামকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। নৌকা পাবার পরে সে (আসাদুল ইসলাম) রীতিমতো হুঙ্কার দিচ্ছে। এই দুঃখে মরণ ছাড়া উপায় নেই।


বিবার্তা/সোহেল/আরকে/এমবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com