শিরোনাম
আ.লীগে ভুঁইফোড় সংগঠন: অভিযোগের তীর কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে (পর্ব-১)
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২১, ১৭:২৮
আ.লীগে ভুঁইফোড় সংগঠন: অভিযোগের তীর কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে (পর্ব-১)
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ। আর এ সুযোগে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নামে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ‘রাজনৈতিক দোকান’। মূল দলের নামের সঙ্গে মিল রেখে অর্থাৎ ‘লীগ’ শব্দটি যোগ করে সংগঠন গড়ে চাঁদাবাজি বা সরকারি সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে এসব ভুঁইফোড় সংগঠন। দেশজুড়ে এসব সংগঠনের ছড়াছড়িতে ক্ষুণ্ন হচ্ছে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি। দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, ভুঁইফোড় সংগঠনের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় তারা বিব্রত।


আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এসব সংগঠনের দলীয় কোনো স্বীকৃতি না থাকলেও দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকেই এসব সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি, অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নেন নিয়মিত।


এমনই একজন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও ঢাকা-২ আসন থেকে নির্বাচিত তিনবারের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নামে গড়ে ওঠা ভুঁইফোড় নানা সংগঠনের অনুষ্ঠানে রয়েছে তার সরব উপস্থিতি।


এর মধ্যে প্রবাসী আওয়ামী ফোরাম, প্রত্যাগত প্রবাসী আওয়ামী ফোরাম, শেখ রাসেল শিশু সংসদ, বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, স্বাধীনতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিষদ, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরিষদ প্রভৃতি নামের এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের নানা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছেন কামরুল ইসলাম।


জানা গেছে, এসব সংগঠনের বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেই তিনি মন্ত্রী থাকাকালে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন।


আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ এমপি। বাংলাদেশ আওয়ামী মটর চালক লীগ নামের একটি সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত অতিথি তিনি। এছাড়াও আওয়ামী হকার্স লীগ, সৈনিক লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়ই দেখা যায় তাকে।


বিবার্তার অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব ‘রাজনৈতিক দোকান’ খুলতে সুযোগ করে দেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কিছু নেতা, বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রী। আর তারা এসব সংগঠন তৈরি করেন নিজেদের প্রচারের স্বার্থে। নাম সর্বস্ব এসব সংগঠনে পদ দিয়ে অনুসারীদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন তারা। পেছন থেকে এসব সংগঠনকে মদদ দেন মন্ত্রী-এমপিরা। একেকটি সংগঠন দলের একেক নেতাকে টার্গেটে নিয়ে কাজ করে। তাদের অনুষ্ঠানেরও মধ্যমণি করা হয় তাকে।


নাম সর্বস্ব এসব সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানের প্রায় অর্ধশতাধিক ছবি বিবার্তার কাছে এসেছে। এসব অনুষ্ঠানে ব্যানার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বড় বড় ব্যানার-পোস্টারে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবির অবাধ ব্যবহার। এসব সংগঠনের ব্যানারে অন্যান্য অতিথিদের নাম ব্যবহারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘আওয়ামী নেতা’ উল্লেখ করা হয়। এসব সংগঠনের মানববন্ধন, আলোচনা সভা বেশিরভাগ সময়ই মিডিয়াপাড়া খ্যাত জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি-ডিআরইউ, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন এলাকায় হয়ে থাকে।


সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে তোলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটি থেকে ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তাকে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। এরপর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভুঁইফোড় রাজনৈতিক এসব সংগঠন নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা ভুঁইফোড় এসব সংগঠনকে মনিটরিংয়ের আওয়তা আনা এবং দলের নেতাদের এসব বিষয়ে সতর্ক করার ব্যাপারেই বেশি মনোযোগী। তবে এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী সংগঠনকে সমমনা ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে দাঁড় করানোর তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।


আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির সহযোগী সংগঠনের সংখ্যা সাতটি। এগুলো হলো মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী যুব লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতী লীগ ও যুব মহিলা লীগ। এর বাইরে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে আছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব দলের বাইরে আওয়ামী বা লীগ শব্দ যুক্ত করে গড়ে ওঠা ভুঁইফোড় সংগঠন দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যানার নিয়ে হাজির হয়।


দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের সাতটি সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বাইরে অন্য কারও এ ব্যাপারে দাবি করার সুযোগই নেই। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা কিংবা কার্যক্রম পরিচালনা করতে গেলে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ থেকে অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু নাম সর্বস্ব সংগঠনগুলো এসব নিয়মের তোয়াক্কা করছে না।


প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা নানা সময়ে কিছু সংগঠনের কার্যক্রমে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।


অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ এমপি বিবার্তাকে বলেন, সৈনিক লীগ আমাদের সমমনা একটি দল। এখনো অফিসিয়ালি সংগঠনটিকে ঘোষণা করা হয়নি। সম্মেলন হয়ে গেলে এটা একটা সমমনা দল হয়ে যাবে। এটার প্রক্রিয়া চলছে। আর হকার্স লীগের যারা আওয়ামী পন্থী আছেন তাদের নিয়ে কয়েকবার বসেছি। সম্মেলন হয়ে গেলে এটাকে ভ্রাতৃপ্রতিম বা সমমনা সংগঠন হিসেবে নেয়া হবে। সংগঠনটির ব্যাপারে এসব প্রক্রিয়া চলছে।


ভুঁইফোড় নানা সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, খেয়াল নাই কখন কোথায় গেছি। আমি কোনো আজেবাজে অনুষ্ঠানে কখনো যাইনি, মনে হয় না।


এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি বিবার্তাকে বলেন, আপনাদেরকে দেখতে হবে তারা (এসব সংগঠন) কী অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেছে। নিশ্চয়ই কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেনি। হয়তো বা বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী বা শাহাদাত বার্ষিকী পালন উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান করতে চেয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা গিয়ে থাকতে পারেন। তবে আমরা এ ব্যাপারে আরো কড়াকড়ি করবো, যাতে আমাদের কোনো নেতা-কর্মী বিশেষ করে ভুয়া কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে না যায়।


তিনি আরো বলেন, আমরা রাজনীতি করি। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী বা শাহাদাতবার্ষিকী এসব আলোচনায় আমরা যাই। আমরা জনগণের সাথে মিলেমিশে থাকি। এখন সেখানে আমার পাশে দাঁড়িয়ে যদি অবাঞ্চিত কোনো লোক এসে ছবি তোলে, এসব কি থামানো যায়? দুয়েকজন দুষ্টু প্রকৃতির লোক আছে, যারা আমাদের সঙ্গে ছবি তুলে খারাপ কাজও করে। যখনই কেউ এধরনের কাজ করে, তখনই মানুষ বুঝে যায় তার একটা উদ্দেশ্য আছে। তবে কোন ধরনের অনুষ্ঠানে আমরা গেলাম, কে আমাদের সঙ্গে ছবি তুললো এসব বিষয়ে আমাদেরকে আরো সতর্ক থাকতে হবে।



এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিবার্তাকে বলেন, যেখানে আওয়ামী লীগের অনুমোদন নেই, সেখানে নেতারা কিভাবে যান, এটাতো মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। যারা ভুয়া এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে যান অথবা এদের সাথে কথাবার্তা বলেন তারা হয়তো অসর্তকতার কারণে এসব করেন। এছাড়া যারা স্বার্থান্বেষী, ধোঁকাবাজ তারা তো আমাদের নেতাদের সরলতার সুযাগ নিয়ে ধোঁকাবাজি করে। আমাদের নেতাদের অনুরোধ করবো যাতে তারা ধোঁকাবাজদের ব্যাপারে আরো সতর্ক হন।


তিনি বলেন, ধান্ধাবাজদের হাতে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী যাতে প্রতারিত না হয় সেই বিষয়গুলো আমরা মনিটরিংয়ের ভেতর নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। আমরা অনেকটাই সক্ষম হচ্ছি। ধান্ধাবাজ, ধোঁকাবাজদের নজরদারির ভেতর রাখাটাও কঠিন। আমরা একটা শঙ্কার মধ্যে থাকি কার দ্বারা কোন সময় আমাদের চরিত্র হনন হয়ে যায়। এসব বিষয় নিয়ে আমরাও বিব্রত। আগামী দিনে যাতে এসব না হয় আমরা সেইভাবেই মনিটরিং করবো।


বিবার্তা/সোহেল/গমেজ/আরকে

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com