শিরোনাম
‘হাটে আইলে পেটে পাথর বাইন্ধাই আহি’
প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২১, ০৮:২৮
‘হাটে আইলে পেটে পাথর বাইন্ধাই আহি’
আদনান সৌখিন
প্রিন্ট অ-অ+

‘গরুর হাটে আহন মানে থাকন-খাওন কষ্ট হইব এইটা মাইনা লইয়াই আহি আমরা।আমি ২০ বছর ধইরা গরুর হাটে ব্যবসা করি।ঈদ মৌসুমেই আমার সারা বছরের কামাই হয়।পেটে কষ্ট হইলেও মাইনা লই।বাড়ি থেইকা গরু নিয়া বাইর হউনের আগে শেষবার গোস্ত দিয়া ভাত মুখে দিয়া আহি।এরপর ১০-১৫ দিনই হাটে থাকি, গোস্তের মুখ দেহি না।ভাত আলু-ভর্তা ডিম দিয়াই চালায়া নেই।হাটে আইলে একরহম পেটে পাথর বাইন্ধাই আহি।গরু বেইচ্চা লাভের মুখ দেখলে এই কষ্ট মনে থাহে নাহ।’


খানিকটা আক্ষেপ নিয়েই বিবার্তাকে কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুর থেকে আটটি গরু নিয়ে হাটে আসা ৫৬ বছরের জামাল হোসেন। জামাল হোসেনের এই গল্পটা যেন কোরবানির হাটে আসা প্রায় প্রতিটি গরুর পাইকার ও ব্যাপারীর।হাটে আসার দিন থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত থাকা-খাওয়া নিয়ে বেশ কষ্টেই কাটে তাদের দিন-রাত। ডাল-ভাত, আলু-ভর্তা, আলু-বেগুনের তরকারি ছাড়া বেশি কিছু জোটে না তাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায়।রাতে ঘুমানোর জায়গাও হয় গরুর পাশে ছোট্ট খালি জায়গাটায়। রবিবার (১৮ জুলাই) রাজধানীর মিরপুর ১২ সেকশনের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গায় পশুর হাটে আসা বিক্রেতাদের সাথে সরেজমিনে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।



হাট ঘুরে দেখা গেছে, সকাল বেলার নাস্তা হিসেবে আলু-ভর্তা, ভাত, ডিম সিদ্ধ খাচ্ছেন ব্যাপারীরা।কেউ কেউ চায়ের দোকান থেকে রুটি কলা, চা দিয়ে সারছেন সংক্ষিপ্ত খাবার পর্ব।এরপরেই কাজে লেগে যান তারা।গরু গোসল করানো, আবর্জনা পরিষ্কারের মত সব কাজ তাদের করতে হয়।সকাল গড়িয়ে দুপুর আসতেই ভিড় জমাতে শুরু করে হাটে আসা ক্রেতারা।এই ফাঁকেই দুপুরের খাবার হিসেবে ডাল, সবজি, ভাত চুলায় উঠিয়ে দেন তারা।খুব কম বিক্রেতার কাছে দেখা মেলে গ্যাস সিলিন্ডারের চুলা।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের রান্না করতে হয় লাকড়ির চুলায়।ইট দিয়ে তৈরি অস্থায়ী চুলায়ই রান্না হয় তাদের ৩ বেলার খাবার।গরুর পাশে বসেই ঝটপট সেরে ফেলতে হয় দুপুরের খাবার।বিকেলে হাটে ভিড় আরো বাড়তে থাকে।এর মধ্যেই চলে রাতের খাবারের বন্দোবস্ত।মেনুতে থাকে বড়জোর আলু-বেগুনের তরকারি, ডাল, খুব বেশি হলে ছোট মাছের তরকারি।


এছাড়া হাটে বেশ কিছু ছোট-বড় খাবার হোটেল থাকলেও মাত্রাতিরিক্ত দামের কারণে সেখানে খেতে যান না হাটের পশু বিক্রেতারা।বেশীরভাগ সময় সেখানে খাবার খান দূর থেকে আসা ক্রেতারা।অন্যদিকে, করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর লক্ষে পাশের জনবহুল আলুব্দি এলাকার সকল প্রবেশমুখে দেয়া হয়েছে বাঁশের উঁচু বেড়া।রাখা হয়েছে ২৪ ঘণ্টা পাহারা।সেখানে হাটে আসা ক্রেতা বিক্রেতা উভয়েরই প্রবেশ নিষেধ।তাই চাইলেও সেখানকার স্থানীয় কাঁচা বাজারে যেতে পারছেন না কেউ।তবে বড় ব্যাপারীরা একবারে বেশ কয়েকদিনের কাঁচা বাজার করেন।সেটা দিয়েই দিন পার করতে হয় তাদের।



লালমনিরহাটের সালাম তালুকদার ১১টি গরু নিয়ে এসেছেন হাটে। সাথে এসেছেন তার ১৪ বছরের কিশোর পুত্র রবিন।সালাম বিবার্তাকে বলেন, হাট চলাকালে আমাদের খাবার-দাবারের কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকে না।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়েই আমি কাজে লেগে পড়ি।আমার ছেলে রান্না বসিয়ে দেয়।বেশির ভাগ সময়েই ভাত আলু-ভর্তা দিয়েই ৩ বেলা চালিয়ে নেই বাপ-বেটা। মাঝে মাঝে সকালের খাবার খাই দুপুরে।সন্ধ্যার মধ্যে রান্না রাতের খাবার রান্না করে খেয়ে ফেলতে হয়।তবে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ১২টা।আবার কখনো ১ টাও বেজে যায়।
হাটের মাঝামাঝি জায়গায় ১৫টি গরু নিয়ে বসেছেন কুষ্টিয়া থেকে আসা দুই ভাই মোফাজ্জল ও আশরাফ।আশরাফকে দেখা গেল গরুর খড়-ভুসির বস্তার উপর কাপড়ের ব্যাগ মাথার নিচে দিয়ে ঘুমাতে। বস্তাগুলো দুই সারি গরুর মাঝের সরু জায়গায় রাখা।



কথায় কথায় মোফাজ্জল বিবার্তাকে বলেন, হাটে আসা কয়দিন আমাদের খাওয়া ঘুম এসব ভুলেই থাকতে হয়।কাল রাতেই আমাদের আরো কিছু গরু এসেছে।সেসব ঠিকঠাক করতেই ভাইজান রাতে ঘুমাতে পারেননি।তাই এখন একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছেন।গায়ে হালকা জ্বরও দেখলাম সকাল বেলা। তাই আর উনাকে ডাকছি না। আমিই সব সামলে নিচ্ছি।
১১ বছরের মাদ্রাসা ছাত্র কাইয়ুম। বাবা হেকমত আলির সাথে ৪টি গরু নিয়ে নরসিংদী থেকে হাটে এসেছেন। কাইয়ুম বিবার্তাকে বলেন, আমি দুই বছর ধরে আব্বার সাথে গরুর হাটে আসি। খাবার-ঘুমে কষ্ট হয়, কিন্তু কিছু তো করার নাই। আসার আগে আম্মা ভাত আর ডাল রান্না করা শিখিয়ে দিয়েছিলেন।আমি শুধু ভাত রান্না করি ৩ বেলা।আব্বা কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে ডাল তরকারি রান্না করেন। এগুলাই খাই ৩ বেলা। গরু বিক্রি করে লাভ হলেই আমি খুশি।



একটু দূরে বসে বড় কড়াইতে আলু-বেগুনের ঝোল রান্না করছিলেন মধুপুরের ইকবাল।কথা বলে জানা যায় তার কাজই হচ্ছে ব্যাপারীদের জন্য খাবার রান্না করা।বেলা প্রতি ২০০ টাকা হিসেবে কমবেশি ২০/২৫ জনের জন্য খাবার রান্না করেন তিনি।ইকবাল বিবার্তাকে জানায়, আমি কোনো গরু নিয়ে আসি নাই।এলাকায় আমার খাবার হোটেল আছে। তাই আমাদের এলাকার কিছু পাইকার মিলে আমাকে নিয়ে আসছে হাটে। আমি তাদের চাহিদা মত ৩ বেলা খাবার রান্না করি। সকাল দুপুরে বেশিরভাগ দিনই ডিম, আলু-ভর্তা, সবজি রান্না করি। রাতের জন্য প্রায় প্রতিদিনই একই খাবার আলু-বেগুনের তরকারি। রান্নার প্রস্তুতিতেই দিন কেটে যায় আমার। রাতে ব্যাগ মাথার নিচে দিয়ে গরুর পাশেই ঘুমিয়ে যাই।


সার্বিক বিষয়ে কোরবানি হাটের ইজারাদার কামাল হোসেন বিবার্তাকে বলেন, আমরা হাটের পজিশন দিচ্ছি পাইকার ব্যাপারীদের। নিরাপত্তার ব্যবস্থাও আমাদেরই কাজ। তবে হাটে আমরা কখনো কারো খাবারের দায়িত্ব নেই না। এটা সম্ভবও না। উনারা নিজেরাই কষ্ট করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেন। হাটে কিছু খাবার হোটেল আছে। উনারা চাইলে সেখানও খেতে পারেন। কেউ কোনো সাহায্য চাইলে কমিটির পক্ষ থেকে যথাসম্ভব চেষ্টা করি। খাবার রান্নার জন্য সিলিন্ডার, লাকড়ি, চুলা যদি কেউ ভাড়া নিতে বা কিনতে চায় সেই ব্যবস্থা আমরা করে দেই। এছাড়া হাটের ৪ ব্লক পরে পরে বড় পানির ট্যাঙ্কি বসানো আছে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করা হয়। যেহেতু করোনা চলে, তাই আমরা পাশের আবাসিক এলাকায় বা বাজারে ঢুকতে দিচ্ছি না কাউকে।


বিবার্তা/আদনান/গমেজ/আবদাল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com