ছোট্টবেলায় নদী ভেঙে নিয়ে যায় বাড়ি। আশ্রয় হয় দাদার বাড়ি। সেখানেও বেশি দিন থাকা হয়নি। পরে রাজধানীর একটি কলোনীতে বসাবাস। মা মানুষের বাসায় কাজ করেন। বাবা থেকেও নেই। কারণ তিনি মাঝে-মধ্যে কর্ম করলেও সংসারের প্রতি তেমন কোনো দরদ নেই।
তারপরও দিন আসে, দিন যায়। হাজারো কষ্টকে বুকে ধারণ করে হার মানতে নারাজ অধম্য মেধাবী সানজিদা আক্তার। সকল ব্যথা সহ্য করে এবং তিনি এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪ পয়েন্ট ২৮ পেয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছেন।
সানজিদা আক্তার বরিশাল জেলার মেহনদীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা হলেও তিনি বসবাস করেন রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে। ভাই-বোন তিন জনের মধ্যে সানজিদাই সবার বড়। অভাবের তাড়নায় কয়েক বছর আগেই সানজিদার বাবা-মা তাকে নিয়ে রাজধানীর ঢাকার কড়াইল বস্তিতে আসেন। সেখানে একটি রুম নিয়ে শুরু হয় তাদের জীবন যুদ্ধ। তবে ছোটবেলা থেকেই ওই যুদ্ধে বাবা-মার সাথে অংশ নিয়েছেন সানজিদা।
সানজিদার মা রাজধানীর মানুষের বাসায় কাজ করেন। তার বাবা মাঝে মধ্যে কাজ-কর্ম করেন। তবে ওই টাকা তিনি পরিবারে ব্যয় করে না। তাই মায়ের রোজগারের টাকা দিয়েই সানজিদার ভরণপোষণ চলে। তার পরও মেয়ের লেখাপড়া বাদ দেননি। তিনি টিএন্ডটি আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সানজিদাকে ভর্তি করান।
লেখাপড়ার পাশাপাশি সানজিদাও তার মাকে সাহায্য করছেন। তার মা মানুষের বাসায় কাজ করায় তিনি তার নিজের বাসার সব কাজ-কর্ম করেন। শুধু তাই নয়, কলোনীতে টিউশনিও করেন তিনি। এমনকি একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতাও করেছেন এক বছর। কিন্তু করোনাভাইরাস আসার পর কোর্চিং সেন্টার ও টিউশনিও চলে গেছে তার। এখন কিভাবে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হবেন? কে তার লেখাপড়ার খচর চালাবে এমন হাজারো প্রশ্ন মাথায় তার।
তবে যতই বাধা আসুক না কেন সানজিদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ে একজন আইনজীবী হতে চান। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই কষ্ট করছি। আমার মাও আমাদের লালন-পালন করার জন্য অনেক কষ্ট করছেন। মা মানুষের বাসায় কাজ করে বাসা ভাড়া ও পরিবারের খরচ বহন করেন। তাই আমার পড়ার খচর দিতেও হিমশিম খেতে হয় মা’র। তাই আমি কোচিংয়ে শিক্ষকতা করতাম এবং টিউশনি করতাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেটাও চলে গেছে।
কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ছোট কাল থেকে দেখে আসছি আমার বাবা বুদ্ধিহীন। আমার মায়ের জন্য আজ আমি এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছি। আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করি, তখন আমার গ্রামের বাড়ি নদীতে ভেঙে যায়। এরপর আমরা দাদার বাড়ি থাকি। কিন্তু সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর দাদাও চলে যান না ফেরার দেশে।
তিনি বলেন, আমি যখন গ্রামে ছিলাম তখনও লেখাপড়ার খরচ কেউ দিত না। অনেক কষ্টে আমার মা ওই টাকা সংগ্রহ করে আমাকে দিতেন। টাকার অভাবে স্কুলে বেতন ছয় মাস পর দেয়া লাগত। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর আমি টিউশনি শুরু করি।
সানজিদারা গ্রামে থাকালেও তার বুদ্ধিহীন বাবা ঢাকায় থাকতেন। তিনি ঢাকায় থাকলেও তিন-চার মাস পর একবার গ্রামে টাকা পাঠাতেন। ওই টাকা দিয়ে সানজিদার মা কোনোভাবে সংসারের খরচ চালাতেন। সানজিদা বলেন, অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া শেষে মা আমাদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। সেখানে এসে কড়াইল বস্তিতে একটি রুম ভাড়া করেন। পরে মানুষের বাসায় কাজ করে মা আমাকে টিঅ্যান্ডটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করান। এক পর্যায়ে আমি কিছু দিন একটি কোচিং সেন্টারে পড়ানোর সুযোগ পাই। অনেক কষ্টে আমি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেই। আমি ভেবেছিলাম জিপিএ ৫ পাব। কিন্তু তা না পাওয়াতে আমার অনেক কষ্ট লাগছে।
তিনি বলেন, আমার ইচ্ছে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ে একজন আইনজীবী হবো। কিন্তু জানি না আমার এই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না। কারণ একাশদ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার মতো টাকাও আমার কাছে নেই। করোনার কারণে মায়ের কাজও কমে গেছে।
টাকার অভাবে গ্রামের কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা চিন্তা করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে ভর্তি হলে অনেক টাকা লাগবে। এছাড়াও নিয়মিত ক্লাস করা লাগবে। কিন্তু গ্রামের কলেজের ভর্তি হলে টাকা কম লাগতে পারে এবং মাঝে মধ্যে গিয়ে ক্লাস করলেও চলবে। এই সুযোগে তিনি ঢাকায় একটি চাকরি করে মায়ের কষ্টের অংশীদার হতে চান।
সানজিদা সরকারি কালাচাঁদপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তির চান্স পেয়েছে। কিন্তু ভর্তি ফি না থাকায় লেখাপড়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিবার্তা/খলিল/গমেজ/জাই
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]