শিরোনাম
৫০০ বছরের ‘গোল তালাবে’র প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি দাবি
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০১৯, ২২:৩৬
৫০০ বছরের ‘গোল তালাবে’র  প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি দাবি
আদনান সৌখিন
প্রিন্ট অ-অ+

রাজধানী ঢাকায় পুকুর বলতে গেলে এখন চোখেই পড়ে না। তবে এক সময় পুকুর-খাল-ঝিলে ভর্তি ছিল মোগল বাংলার রাজধানী। কালের পরিক্রমায় আর মানুষের প্রয়োজনে ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে গেছে ঢাকার পুকুর, খাল ও ঝিল।


৩০ বছর আগে ঢাকা নগরীতে দুই হাজার ছোট-বড় পুকুর ছিল। এখন সরকারি হিসাবে আছে মাত্র ২০০। পরিবেশবিদরা অবশ্য দাবি করেন, প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা একশ’র বেশি হবে না।


মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল দুই হাজার। ১৯৮৯ সালের দিকে সেটা কমে এক হাজার ২০০ তে নেমে আসে।


পুকুরের চারপাশের মাছ ধরার ব্যবস্থা


২০০৭ সালে মৎস্য ভবন পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে পুকুরের সংখ্যা সাকুল্যে ২০০। তবে বর্তমানে এই সংখ্যা কত তা জানা যায়নি। এদিকে ঢাকা শহরে পুকুরের সঠিক সংখ্যার হিসাব নেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাছেও। প্রায় সাড়ে ছয় বিঘা আয়তনের ‌‘গোল তালাব’ বা ‘গোলপুকুরের’ গুরুত্ব বোঝাতে রাজধানীতে পুকুরের এমন পরিসংখ্যানই বোধ হয় যথেষ্ট হবে।


পুকুরটির আকার বৃত্তের মতো গোল। এ জন্য এটির নাম গোলপুকুর। কোথাও কোনো নোংরা নেই, পরিষ্কার টলটলে জল। আর সেই জলের তলায় মাছেদের ছোটাছুটি। দেখার মতো দৃশ্য বটে।


পুকুরের চারপাশে বাঁধানো রাস্তা আর নারকেল গাছ। অন্তত ৫০টি নারকেল গাছ প্রায় একই উচ্চতার। পুকুরসংলগ্ন এসব গাছ পুরো এলাকাটিকে শীতল করে রেখেছে। একের পর এক জলাশয় ভরাট করে গড়ে ওঠা কংক্রিটের রাজধানীতে এমন দৃশ্য বিরল। পুরান ঢাকার ইসলামপুরে দেখা মেলে এ বিরল দৃশ্যের।


শত ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে উনিশ শতকে খনন করা পুকুরটি আজও টিকে আছে গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে। বর্তমানে পুকুর ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে এই এলাকার হাজারো মানুষের কর্মব্যস্ততা, বসত-বাণিজ্য। চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে থাকা ইট-কংক্রিটের স্তূপের মাঝে এই পুকুর যেন একখ-কোমল স্নিগ্ধতা।


বুড়িগঙ্গার দক্ষিণে ও উত্তরে নবাববাড়ী রেখে পূর্ব-পশ্চিমে রয়েছে একাধিক মার্কেট। যার মধ্যে প্রায় পাঁচশ’ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে অবস্থান করছে গোলপুকুর। সময়ের বাঁকে বাঁকে নানা রূপ উত্থান-পতনের সাক্ষী এই পুকুর।


গোল পুকুরে গোসল করতে আসা মানুষ


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইসলামপুর এলাকার এ পুকুরটির উৎপত্তি মূলত ছোট একটি জলাশয় থেকে। আনুমানিক ১৬১০ সালে মোগল শাসকদের প্রতিনিধি ইসলাম খাঁ সুবাদার হিসেবে ঢাকায় আসেন। তিনি প্রথমে বর্তমান ইসলামপুর এলাকায় আসেন। ফলে তার নামানুসারে এলাকাটির নামকরণ হয় ইসলামপুর। সুবাদার ইসলাম খাঁ আসার আগে পুরান ঢাকার বাংলাবাজার মিটফোর্ডের বিশাল এলাকায় বাস করতেন কুমার সম্প্রদায়ের লোক। কুমাররা মাটি দিয়ে তৈরি করেন বিভিন্ন সামগ্রী। তাদের প্রয়োজনে ইসলামপুরের এ স্থান থেকে মাটি নেয়া হতো। মাটি কাটতে কাটতে এক পর্যায়ে সৃষ্টি হয় ছোট আকারের গর্তের। এ গর্ত পরবর্তী সময়ে রূপ নেয় জলাশয়ে।


তখন জমিদার মোগল শেখ এনায়েত উল্লাহ তার বাগানবাড়িতে এটিকে জলাশয় হিসেবে ব্যবহার করতেন। এরপর ১৭০০ সালে লুইস নামে এক ফরাসি ব্যবসায়ী এসে বাণিজ্য কুঠি তৈরি করেন এবং তার নামানুসারে এর নাম হয় ‘লুইসের জলা’। ১৮৩০ সালে নবাব খাজা আলিম উল্লাহ কুঠিসহ জলাশয়টি কিনে নেন। এরপর জলাশয়টি সংস্কার করে পুকুরে পরিণত করা হয়। বৃত্তাকারে প্রায় সাড়ে ছয় বিঘা জমির ওপর তৈরি হয় পুকুর। আগে একে ‘গোল তালাব’ নামে ডাকা হতো। তালাব উর্দু শব্দ, যার অর্থ জলাধার। পরে এটি নবাববাড়ির পুকুর নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পায়। আর সরকারি গেজেটে এর নাম ‘ইসলামপুরের গোল তালাব’। এটি হচ্ছে গোলপুকুর তৈরির প্রচলিত ইতিহাস। তবে মূল পুকুরটির খননের সময় নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। তবে এটি যে উনিশ শতকের তৃতীয় দশকেই খনন করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।


স্বাধীনতার পরপর পুকুরের সৌন্দর্য হ্রাস পায় এবং এটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এছাড়া পুকুরের মালিকানাকে কেন্দ্র করে নবাব পরিবারের বংশধরদের মধ্যে মামলা-আপসের কারণেও পুকুরটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট পুকুরটির বৈধ মালিকানা পায়। সেই থেকে ট্রাস্টের অধীন একটি কমিটির মাধ্যমে পুকুরের সংস্কার, রক্ষা ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলছে।


সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে গোলাকার পুকুরের চারপাশ গ্রিল দিয়ে আবদ্ধ। পূর্ব দিকে রয়েছে একটি শান বাঁধানো ঘাট ও পাকা ছাউনিসহ বড় আকারের গেট। ঘাটে মানুষজন গোসল করছে। আর ঘাটের ওপরে আলাদা গোসলখানায় সাবান ব্যবহার করছে, কারণ পুকুরে সাবানের ব্যবহার নিষেধ। গোসল করতে জনপ্রতি নেয়া হয় পাঁচ টাকা। ট্রাস্টের অনুমোদন নিয়ে তিন বছরের জন্য পুকুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছে নবাববাড়ি ট্যাংক কমিটি।


ঘাটেই কথা হয় কমিটির সদস্য রেহানুল হকের সঙ্গে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, প্রতিদিন প্রায় হাজারখানেক মানুষ পুকুরে গোসল করে। বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ তীব্রতা পেলে ও এলাকায় পানি সঙ্কট দেখা দিলে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণ-তিনগুণ।


পুকুরের মূল ফটক


তিনি আরো জানান, ৪৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পুকুরের জন্য সময় দেন। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োগকৃত চার-পাঁচ জনকে পারিশ্রমিক দেয়া হয়। পুকুর থেকে অর্জিত বাকি অর্থ জমা হয় ট্রাস্টে। ট্রাস্টের অর্থে পুকুরের সৌন্দর্য রক্ষায় এর পাড়ের চারদিকে লাগানো হয় সুপারি, আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কুল, বরইসহ বিভিন্ন ফলের গাছ। সে সঙ্গে পুকুরে চাষ করা হয় রুই, কাতলা, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন জাতের মাছ। মাছ বড় হলে চলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা।


এ প্রসঙ্গে কমিটির সাধারণ সম্পাদক খাজা মো. ওয়াসিম উল্লাহ বিবার্তাকে বলেন, গত ৩১ মে প্রায় ১৬ মণ এবং ২ জুন প্রায় ১৩ মণ মাছ পুকুরে ছাড়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এক থেকে দেড় কেজি ওজনের রুই, আড়াই কেজি ওজনের কাতলা, ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের কালা বাউশ এবং ব্ল্যাক ক্যাপ প্রজাতির মাছ। পুকুরের চারপাশ ঘিরে রয়েছে বসে মাছ ধরার ব্যবস্থা। চারপাশে একসঙ্গে প্রায় ৫০ জন শৌখিন মাছ শিকারি বড়শি নিয়ে বসতে পারেন।


কমিটি সদস্য রেহানুল হক জানান, মাছ ধরার প্রতিটি টিকিটের দাম চার হাজার টাকা। এর বিনিময়ে মাছ শিকারিরা চারটি বড়শি দিয়ে চার সপ্তাহে মোট চারদিন (প্রতি শুক্রবার) মাছ ধরার সুযোগ পান।


ঐতিহ্যবাহী এ পুকুরটি এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পানির সমস্যা লাঘবে সহায়তা করলেও পুকুর সংলগ্ন রাস্তার কিছুটার পরিবেশ দৃষ্টিকটু রকমের নোংরা। উত্তর পাশে বিশাল জায়গাজুড়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মৌসুমী ফলের আবর্জনা ও অন্য আবর্জনা স্তূপ করে রেখেছেন।


পুকুরের পশ্চিম পাশে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্মিত ডাস্টবিন বিকেল চারটার সময়ও গৃহস্থালী ময়লা-আবর্জনায় টইটুম্বুর। দুর্গন্ধের কারণে ওদিকটায় হাঁটা দায়। তবে পুকুরের চারপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ ভাল। রক্ষণাবেক্ষণ কমিটি নিজ উদ্যোগ পুকুরের চারপাশে চারটি সিসি ক্যামেরা বসিয়েছে। এছাড়া আশপাশের ব্যবসায়ীরাও পুকুরমুখী রাস্তায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছেন।


পুকুরের বাইরের ফটক


কমিটি সূত্রে জানা গেছে, পুকুরটি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এটি পরিবেশ আইনে গেজেটভুক্ত ও ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত। পুকুরের পাশে মার্কেটের কারণে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। তাই এটিকে ঘিরে পরিকল্পিতভাবে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট তৈরি করা যেতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।


স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, এ পুকুর নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। নবাবের বংশধর দাবি করে কয়েকজন এটি বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন। পরে আদালতের আদেশের কারণে তা আর পারেননি। ঐতিহ্যবাহী পুকুর হিসেবে সরকার সংরক্ষিত পুকুর ঘোষণা করেছে কিন্তু রাজউক ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এখনো কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি এখানে। তাই ৫০০ বছরের ‘গোল তালাব’ এর কার্যক্রম শুরু করতে সরকারের সুদৃষ্টি চায় এলাকাবাসী।


বিবার্তা/আদনান/উজ্জ্বল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com