শিরোনাম
টেলিনর-আজিয়াটা একীভূতকরণে টেলিকম খাতে সম্ভাব্য প্রভাব
প্রকাশ : ৩০ মে ২০১৯, ১৭:০৮
টেলিনর-আজিয়াটা একীভূতকরণে টেলিকম খাতে সম্ভাব্য প্রভাব
মোজাহেদুল ইসলাম ঢেউ
প্রিন্ট অ-অ+

সম্প্রতি এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে টেলিনর ও আজিয়াটার সম্ভাব্য একীভূতকরণের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের অপারেটরগুলির মালিকানার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই একীভূতকরণের ফলে বাংলাদেশের টেলিকম খাতে বড়ো ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


টেলিনর ও আজিয়াটা এশিয়ার মোট নয়টি দেশে একীভূত হয়ে এ অঞ্চলের টেলিকম ব্যবসা একত্রে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করেছে বলে জানা গেছে। সম্ভাব্য এই একীভূত প্রতিষ্ঠানে টেলিনর ও আজিয়াটার সম্ভাব্য মালিকানা হবে যথাক্রমে ৫৬.৫% ও ৪৩.৫%। তবে বাংলাদেশে আজিয়াটার স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান রবি এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ, রবি’তে আজিয়াটার মালিকানা অপরিবর্তিত থাকবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, রবি’তে বর্তমানে আজিয়াটা (৬৮.৭%) ছাড়াও মালিকানা রয়েছে ভারতী এয়ারটেল (২৫%) ও এনটিটি ডোকোমোর (৬.৩%)।


এদিকে টেলিনর-আজিয়াটা একীভূত হলে দেশের সবচেয়ে বড়ো অপারেটর গ্রামীণফোনের প্রায়২৫% মালিকানা আজিয়াটার কাছে যাবে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ, দেশের দুইটি অপারেটর রবি ও গ্রামীণফোনের মালিকানা পাবে আজিয়াটা। দুইটি আলাদা অপারেটরে মালিকানার ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আজিয়াটার ভূমিকাতে স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তন আসবে।


নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, গ্রামীণফোনে নতুন মালিকানার ফলে লাভবান হবে আজিয়াটা। গ্রামীণফোন বর্তমানে দেশের একমাত্র লাভজনক অপারেটর, এবং প্রতিনিয়ত অপারেটরটির লাভের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার টেলিকম খাতে অপারেটরটির আধিপত্য কমাতে ইতোমধ্যে এসএমপি নীতিমালা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে সার্বিকভাবে গ্রামীণফোন এতোটাই শক্ত অবস্থানে রয়েছে যে, এসএমপি নীতিমালা বাস্তবায়ন হওয়ার পরও এটির লাভের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।


গ্রামীণফোন থেকে আজিয়াটা প্রতিনিয়ত লাভবান হতে থাকলে রবি-এর মালিকানার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা কি হতে পারে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া এই মুহূর্তে কঠিন। কারণ, ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও বাজারজাতকরণে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করার পরও রবি এখনও পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে লাভজনক অপারেটরে পরিণত হয়নি। ২০১৮ সাল ও ২০১৯ সালের প্রথম চার মাসের বাজার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিনিয়োগের তুলনায় ডেটা থেকে রবি’র আয় আশানুরূপভাবে বাড়েনি।


তাছাড়া যেহেতু দেশের টেলিকম খাত তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ, সেহেতু রবি দ্রুত লাভজনক অপারেটরে পরিণত হবে, এমনটা আশা করাও এই মুহূর্তে যৌক্তিক নয়। এমনই এক প্রেক্ষাপটে আজিয়াটা যখন গ্রামীণফোন থেকে প্রতিনিয়ত লাভবান হবে, তখন রবি’র সাথে সম্পৃক্ত থেকে অপারেটরটিতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখা প্রতিষ্ঠানটির জন্য কতোটা লাভজনক হবে সে প্রশ্ন থেকে যায়।


এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় বিবেচনায় রাখা জরুরি। এই মুহূর্তে রবি-এর টাওয়ার-এর মালিকানায় রয়েছে ইডটকো বাংলাদেশ, যেটি আজিয়াটার আত্ততাধীন ইডটকো-এর একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। আজিয়াটার সাথে টেলিনর একীভূত হলে এই প্রতিষ্ঠানটির মালিকানার একটি অংশ চলে যাবে টেলিনরের কাছে। সেক্ষেত্রে ইডটকো বাংলাদেশে যেমন- রবি-এর কাছ থেকে সব বিটিএস অধিগ্রহণ করেছে, তেমন বর্তমানে গ্রামীণফোন-এর আয়ত্তে থাকা টাওয়ারগুলিও ইডটকো বাংলাদেশ অধিগ্রহণ করতে পারে।


দুইটি অপারেটরের সব টাওয়ারের দখল নিলে দেশের চারটি অপারেটরের মোট বিটিএস’এর ৭০%-এর বেশি চলে যাবে এই এর আওতায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে মোট দুইটি তাৎপর্যপূর্ণ বাজার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা থাকবে একীভূত এই প্রতিষ্ঠানের কাছে। এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে টাওয়ার লাইসেন্স প্রাপ্ত অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার পরিধি অত্যন্ত সীমিত হয়ে আসবে।


ইডটকো বাংলাদেশ রবি’র বিটিএসগুলিকে অধিগ্রহণের পর সেগুলিকে রবি’র কাছে ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করলেও অন্য তিনটি অপারেটর তা শুরু করতে পারেনি, কারণ রবি বাদে অন্য কোনো অপারেটর বিটিএস হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করেনি। এমন অবস্থায় উপরোক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বাজারে আসার পর ইডটকো বাংলাদেশ’এর একাধিপত্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রতিষ্ঠান তিনটি।


তবে সেক্ষেত্রে ইডটকো-এর মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকবে আজিয়াটার। সব মিলিয়ে, গ্রামীণফোন ও ইডটকোর মাধ্যমে যথেষ্ট লাভবান হওয়ার সুযোগ পাবে আজিয়াটা। এই পরিস্থিতিতে এখনও পর্যন্ত অলাভজনক একটি অপারেটর রবি’তে আজিয়াটার বিনিয়োগের যৌক্তিকতা কতোটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।


এছাড়া বিনিয়োগের দৃষ্টিকোণ থেকে রবি-এর সামনে আরেকটি বড়ো চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। যে ১০ মেগাহার্জ তরঙ্গের উপর ভিত্তি করে রবি’র ফোরজি নেটওয়ার্ক গঠিত, ১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডের সেই তরঙ্গ বরাদ্দের মেয়াদ আগামী বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর সাথে সাথে শেষ হয়ে যাচ্ছে ৯০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডের ২.৪ মেগাহার্জ তরঙ্গ, যা বড়ো শহরের বাইরে অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ে টুজি ও থ্রিজি সেবা প্রদানের জন্য উপযোগী। এই তরঙ্গের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে রবি’রসেবা প্রদানের জন্য নতুনভাবে তরঙ্গ বরাদ্দ নিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে আজিয়াটাকে।


গ্রামীণফোনে আজিয়াটার নতুন মালিকানার প্রেক্ষাপটে রবি’এর জন্য প্রতিষ্ঠানটির এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে লাভজনক নয়। কোনো বাজারে বিনিয়োগের দুইটি ক্ষেত্র থাকলে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবে সেই ক্ষেত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে যেটি থেকে লাভের সম্ভাবান বেশি। অপারেটর হিসেবে এখনো লাভজনক না হওয়ায় তাই ভবিষ্যতে বিনিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতায় পড়তে হতে পারে রবি।


সার্বিকভাবে বাংলাদেশের টেলিকম খাত এই মুহূর্তে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অপারেটরগুলির মালিকানাতে রদবদল হলে নিঃসন্দেহে তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে এই খাতের উপর। এই রদবদলের কারণে কোনো অপারেটর অতি মাত্রায় শক্তিশালী হলে টেলিকম খাতের প্রতিযোগিতার পরিবেশ আরও বেশি ব্যাহত হবে। আবার এই রদবদলের ফলে যদি কোনো অপারেটরের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হয়, তাহলেও তা টেলিকম খাতের সার্বিক ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে।


তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের টেলিকম খাতকে গ্রাহক ও বিনিয়োগ বান্ধব করার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার তথা বিটিআরসি’কে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দক্ষতার সাথে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।


লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম (বিআইজেএফ)


বিবার্তা/উজ্জ্বল



সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com