শিরোনাম
কা’কা বিন আমর: ওয়ান ম্যানস্‌ আর্মি
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:৩৮
কা’কা বিন আমর: ওয়ান ম্যানস্‌ আর্মি
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

উইলিয়াম ওয়ালেস নামটা কি মনে আছে? যাদের মনে পড়ছে না তাদের একটা সূত্র দেয়া যাক। ব্রেভ হার্ট সিনেমার মূল চরিত্রটির কথা মনে করুন। হ্যাঁ, তিনি ছিলেন স্কটিশ স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী। ব্রেভ হার্ট ছবির কল্যাণে তার নাম আমাদের অনেকেরই জানা। শুধু ওয়ালেস নয়, বাল্যকালের পাঠ্যবই ও নানা মুভির কল্যাণে সূর্যসেন, প্রীতিলতা থেকে শুরু করে সম্রাট অশোকা কিংবা গ্ল্যাডিয়েটর খ্যাত রোমান জেনারেল ম্যাক্সিমাস পর্যন্ত অনেক যোদ্ধার নাম আমরা সকলেই জানি। এদের যুদ্ধ জীবনে ঘটে যাওয়া ছোট বড় অনেক ঘটনাও বইয়ে পড়ে বা মুভিতে দেখে আমাদের হৃদয়ে দাগ কেটে গেছে।


তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, আমরা অনেকে হয়তো জানিই না যে বিশ্বের সামরিক ইতিহাসের সেরা জেনারেল একজন মুসলিম, যিনি ছিলেন রাসুল সাঃ এর একজন সাহাবী, যার নাম খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)। শুধু খালিদ নয়, রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সকল সাহাবা এবং পরবর্তীকালে যারা সাহাবাদের সঙ্গ লাভ করেছে বা তাবেয়ী, তাঁদের সামরিক ইতিহাস অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। শুধুমাত্র ঈমান কিভাবে একেকজন মরুচারী কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে পৃথিবীর গতিপথ বদলে দেয়া রাষ্ট্রনায়ক বা জেনারেলে পরিণত করে, তা দেখা গেছে সাহাবা এবং তাবেয়ীদের ইতিহাসে।


আজ ইসলামের স্বর্ণযুগের এমনই একজন বিস্ময়কর নাম না জানা মুসলিম যোদ্ধার কথা আমরা আলোচনা করবো যার বীরত্বের তুলনা শুধু মুসলিম কেন, বাকি বিশ্বেই কম আছে।


রাসুলুল্লাহর (সা.) ইন্তেকালের পর আরব উপদ্বীপের বিরাট অংশ জুড়ে ধর্মত্যাগের ফিতনা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। আবু বকরের মতো কোমল হৃদয় মানুষের অনমনীয় দৃঢ়তার ফলে ধর্মত্যাগের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে নামে মুসলিম বাহিনী। এমন কোন সাহাবা খুঁজে পাওয়া যায় না, যিনি যুদ্ধে অংশ নেননি। এদের নেতৃত্বের ভার আবু বকর (রা.) তুলে দেন অন্যান্য সাহাবার তুলনায় পরে ইসলাম গ্রহণকারী খালিদ বিন ওয়ালিদের হাতে, যাঁকে রাসুলুল্লাহ সাঃ ‘সাইফুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর তলোয়ার’ উপাধি দিয়ে গেছেন।


সাইফুল্লাহ বা খালিদ বিন ওয়ালিদ সামান্য সেনা নিয়ে বিরাট সব বাহিনীর বিরুদ্ধে অসাধারণ সব বিজয় লাভ করতে শুরু করেন। সমর ইতিহাসের সেরা সব পরিকল্পনা আর বীরত্বের ইতিহাস রচিত হতে শুরু করে খালিদের হাতে। ছোট কিংবা বড় কোন যুদ্ধক্ষেত্রেই পরাজয় নামের কোন শব্দ খালিদের সাথে যায় না। ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধটি হয় ভণ্ডনবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে। রক্তক্ষয়ী সে যুদ্ধের পর আরব উপদ্বীপের ধর্মত্যাগীদের ফিতনা প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আবু বকর (রা.) এরপর খালিদকে তখনকার পরাশক্তি পারস্য সাম্রাজ্যে আক্রমণ করার কঠিন অ্যাসাইনমেন্ট দেন। এরই মধ্যে খালিদ বিন ওয়ালিদ দীর্ঘদিনের নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধে ক্লান্ত তাঁর সেনাদলকে পারস্য আক্রমণের জন্য আদেশ না করে তাদের জন্য তা ঐচ্ছিক করে দেন। ক্লান্ত যোদ্ধাদের অধিকাংশ বিশ্রামের অপশন গ্রহণ করে, যেহেতু তারা প্রায় এক বছরের মতো সময় পরিবারের বাইরে যুদ্ধক্ষেত্রে কাটাচ্ছে।


খালিদ (রা.) এমন পরিস্থিতিতে মদীনায় খলিফা আবু বকরের (রা.) কাছে আরো সেনা চেয়ে চিঠি লিখেন। আবু বকর (রা.) তাঁর উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনারত ছিলেন এমন অবস্থায় খালিদের চিঠি তাঁর হাতে পৌঁছে। তিনি সশব্দে চিঠিটি পড়লেন যাতে সবাই শুনতে পায়। চিঠি পাঠ করার পর আবু বকর (রা.) কা’কা বিন আমর নামে এক যোদ্ধাকে খবর পাঠান।


কিছুক্ষণ পর কা’কা বিন আমর যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে আবু বকরের কাছ হাজির হন। খলিফা তাঁকে অবিলম্বে ইয়ামামায় খালিদের সাথে যোগদানের নির্দেশ দেন। খলিফার সঙ্গীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি একজন ব্যক্তিকে পাঠিয়ে সেই বাহিনীর শক্তি বাড়াতে চান, যার অনেক সৈন্য বিশ্রামে আছে?’ আবু বকর (রা.) কিছুক্ষণ কা’কা বিন আমরের দিকে তাকিয়ে জবাব দেন, ‘সে বাহিনী পরাজয় বরণ করবে না, যাতে এই তরুণের মতো যোদ্ধা থাকবে।’


কা’কা খালিদের বাহিনীর সাথে যোগদান করতে বিদ্যুৎ বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। খালিদের পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আবু বকর কা’কা বিন আমরকে একা পাঠানোতে খালিদ কিছুটা বিস্মিত হলেও নিঃসন্দেহ হন, কেননা আবু বকরের (রা.) বিচক্ষণতা সম্বন্ধে তাঁর কোন সন্দেহ ছিলো না। তিনি কা’কাকে সেনাদলের বিভিন্ন ট্রুপের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। সেই থেকে কা’কা প্রমাণ দিতে শুরু করেন কেন তাঁকে একাই একদল সৈন্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কখনো মুসলিম বাহিনীর অগ্রবর্তী দলের নেতা, কখনো গতিময় অশ্বারোহী টহল দলের নেতা, কখনো সম্মুখ যুদ্ধে ডুয়েল লড়াইয়ে কা’কা অসামান্য ক্ষিপ্রতা ও বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তবে তাঁর প্রতিভার সবচেয়ে সেরা প্রমাণ তিনি দেখান তিনি ‘শিকলের’ যুদ্ধে।


পারস্যে মুসলিম বাহিনীর প্রথম বড় যুদ্ধ হলো এই শিকলের যুদ্ধ যা কাজিমা নামক স্থানে সংগঠিত হয়। মুসলিম বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য দাস্ত মেইসানের গভর্নর ও এক লাখ দিরহাম মূল্যের ক্যাপ পরিধানকারী জেনারেল হরমুজ তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হাজির হন। তখনকার দিনে পারস্যে সেনা কমান্ডারদের র‍্যাংক ও সম্মান নির্ধারিত হতো ক্যাপের মূল্যের ভিত্তিতে। পাঁচশ-এক হাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামি ক্যাপ ছিলো র‍্যাংক বিন্যাসে। আর এর ভেতর সবচেয়ে দামি ক্যাপটি ছিলো এক লাখ দিরহামের। হরমুজ ছিলো এই এক লাখ দিরহাম ক্যাপ জেনারেল। তাঁর সামরিক দক্ষতা ছিল পারস্য বাহিনীর ইতিহাসে ঈর্ষণীয়। হরমুজ যুদ্ধে পারস্যের যুদ্ধের পূর্বতন ট্রাডিশন অনুযায়ী তার সৈন্যদের গ্রুপে গ্রুপে ভাগ করে পরস্পরকে শিকলের সাহায্যে জুড়ে দেন। এর ফলে সুবিধা ছিলো এই যে, প্রতিপক্ষ বাহিনীর পক্ষে ব্যুহভেদ করে ঢোকা ভীষণ কষ্টকর হতো এবং তারা সহজেই শেকলের ঘেরাওয়ের ভেতর পড়ে আটকা পড়তো। এছাড়াও পারস্য সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবার চিন্তা বাদ দিতে বাধ্য হয়ে মরণপণ যুদ্ধ করতো।


শিকলের যুদ্ধের আগেই সমগ্র আরব উপদ্বীপে ও সমগ্র পারস্যে খালিদ বিন ওয়ালিদের (রা.) বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মনে এই ধারণা গেঁথে বসতে থাকে, যে যুদ্ধে খালিদ থাকবে, সেখানে প্রতিপক্ষের পরাজয় অনিবার্য। আর সেজন্যই হরমুজ যুদ্ধের নিয়ম ভেঙে এক ভয়াবহ পরিকল্পনা আঁটেন। যুদ্ধ শুরুর আগের দিন তিনি তার অন্য জেনারেলদের নিয়ে পরিকল্পনা করেন যে, পরদিন তিনি খালিদকে অস্ত্রহীনভাবে খালি হাতে দ্বৈতযুদ্ধের আমন্ত্রণ জানাবেন। খালিদ কাছে এলে আগে থেকে লুকিয়ে থাকা কয়েকজন চৌকশ ঘোড়সওয়ারের একটি দল অতর্কিতে আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করবে। খালিদকে হত্যা করলে মুসলিম বাহিনীর মনোবল নষ্ট হয়ে যাবে আর তখন তাদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। পরিকল্পনা মতো যুদ্ধের দিন অতর্কিতে আক্রমণকারী বাহিনী প্রস্তুত হয়ে থাকে। সবকিছুই প্রস্তুত তাদের পরিকল্পনা মতো। তবে আল্লাহ যেভাবে কুরআনে বলেছেন, ‘তারা ষড়যন্ত্র করে, আর আল্লাহ্‌ও পরিকল্পনা করেন। আর আল্লাহ্‌ হলেন শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী’, সেদিন সকালে আবার তা আবার প্রমাণিত হয়।


হরমুজ তার বাহিনী থেকে বেরিয়ে খোলা ময়দানে এসে খালিদকে (রা.) দ্বৈতযুদ্ধের আহবান জানায়। খালিদ (রা.) সে আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন। প্রথমে অস্ত্রসহ দ্বৈতযুদ্ধের সূচনা হয়। উভয়ে উভয়কে মরণপণ আঘাত করতে থাকেন। কিন্তু একে অপরের আঘাত এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন। উভয় মহান যোদ্ধা পরস্পরের নৈপুণ্যে বিস্মিত হন। এক সময় হরমুজ অস্ত্র ফেলে খালিদকে খালি হাতে কুস্তি লড়বার আমন্ত্রণ জানায়। খালিদ সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কুস্তি শুরু হবার সাথে সাথে হরমুজ খালিদকে শক্ত করে ধরে চিৎকার করে তার গোপন বাহিনীকে সাহায্যের জন্য আমন্ত্রণ জানান। খালিদ (রা.) কিছু বুঝে উঠার আগেই পারস্যের অশ্বারোহী একটি দল তাদের ঘিরে ফেলে উদ্ধত অস্ত্র হাতে। খালিদ (রা.) বুঝে ফেলেন তাঁকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, কিন্তু ততোক্ষণে কিছুই করার নেই। তবে আল্লাহর কৃপায় খালিদ হঠাৎ এমন একটি কাজ করেন যাতে ঘেরাও করা দলটি কিছুক্ষণের জন্য আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। তিনি হরমুজকে চেপে ধরে মাটিতে পড়ে যান এবং অনবরত মাটিতে গড়াতে শুরু করেন। এর ফলে খালিদকে আঘাত করতে গেলে হরমুজ আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে- এই সমস্যার জন্য দলটি আঘাত করা থেকে বিরত থাকে।


ইতিমধ্যে দুই বাহিনী দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে দু রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। পারস্য বাহিনী খুশিতে চিৎকার করে ওঠে আর মুসলিম বাহিনীতে উৎকণ্ঠার নিরবতা ছেয়ে যায়। এমনি সময় কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সবাই দেখতে পায় মুসলিম বাহিনীর এক ঘোড়সওয়ার বিদ্যুতের মতো এগিয়ে এসে চোখের পলকে হরমুজের গোপন বাহিনীর তিনজনের গর্দান উড়িয়ে দিয়েছে। সামান্য সময়ের ভেতর বাকী অন্য কয়জনও এই যুবকের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই যুবকই হলেন আবু বকরের পাঠানো একজনের সেনাবাহিনী কা’কা বিন আমর। কা’কা হরমুজের সাথে খালিদের সাথে কুস্তি শুরু হবার পরই চারদিকে চোখ রাখতে শুরু করেন এবং গোপন বাহিনী বেরিয়ে আসার পর পরই ষড়যন্ত্র হচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি দ্রুত খালিদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে যান। সেই পরিস্থিতি এত দ্রুত ব্যবস্থা দাবি করছিল যে, তিনি অন্য কাউকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে তাঁর সাথে এগিয়ে যাবার আহবান জানানোকেও সময় অপচয় বলে ভাবলেন। আর এভাবেই আল্লাহর তাঁর তরবারিকে কা’কার ক্ষিপ্রতার মাধ্যমে রক্ষা করেন। মুসলিম বাহিনী আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে।


কা’কার তৎপরতার পর খালিদ উঠে গিয়ে এক আঘাতে হরমুজের জীবন সাঙ্গ করেন। লাখো দিরহামের জেনারেল হরমুজকে হারিয়ে মনোবল ভেঙে পড়ে পারস্য বাহিনীর। স্বল্প সংখ্যার মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দেন আল্লাহ্‌।


কা’কা বিন আমরের সামরিক দক্ষতার যে ইতিহাস, তা দিয়ে কয়েক ডজন ব্রেভহার্ট ধরনের চলচিত্র তৈরি করা সম্ভব। নিজের দক্ষতাকে প্রচার করতে চাইলে তাঁর নাম ও খ্যাতি আরো ছড়াতো এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তিনি খ্যাতির জন্য লড়াই করেননি কোনদিন। তাঁর লড়াই ছিল কেবল আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য। আর তাই ব্যক্তিগত বীরত্বে ভরা তাঁর জীবনে তিনি কোনদিন এসব কৃতিত্বের জন্য গৌরব বোধ করতেন না। সমরাঙ্গনের বাইরে লাজুক ও মুখচোরা ধরনের এই অনন্য সাধারণ লোকটি যুদ্ধের বাইরের সময়টা আল্লাহ্‌র ইবাদতে কাটিয়ে দিতেন। ঘোড়ার পিঠে আর তরবারির ছায়ায় যেমন ক্ষিপ্র ছিল তাঁর জীবন, ততোধিক গোপনে ও নীরবে তিনি অশ্রু ঝরাতেন আল্লাহ্‌র কাছে। প্রতিটি রাতের নিকষ কালো আঁধারে।


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com