শিরোনাম
কয়েকবার নির্মিত হয়েছে কাবা শরীফ
প্রকাশ : ২৪ মে ২০১৭, ১৪:৫১
কয়েকবার নির্মিত হয়েছে কাবা শরীফ
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জন্য তো বটেই, বিশ্বের অন্যতম পবিত্র স্থান সৌদি আরবের হিজাজ অঞ্চলের উপত্যকা অঞ্চল মক্কা। পবিত্র কাবার চতুর্দিকে হাজারো মানুষ ২৪ ঘণ্টাই ঘোরাফেরা করেন। সারা বিশ্বের কয়েক কোটি বাড়িঘরে পবিত্র কাবা শরীফের ছবি সাজানো থাকে এবং প্রতিদিন পাঁচবারের বেশি এই কাবা শরীফের দিকে ফিরেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন কয়েকশ কোটি মানুষ।


মক্কার কেন্দ্রস্থল কাবা শরীফ। ঘনক আকৃতির এই স্থাপনাটিটি মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে পরিচিত স্থাপনাগুলোর একটি। কালো পর্দা ছাড়াও অসংখ্য প্রশ্ন, কৌতূহল ও রহস্যে আবৃত এই কাবা শরীফ। পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো কাবা শরীফ সম্পর্কে এমন ১০টি তথ্য, যা অনেকেরই অজানা।


কয়েকবার নির্মিত হয়েছে কাবা শরীফ: আজকের যে কাবা শরীফ আমরা দেখি, এটি এবং নবী ইব্রাহিম ও ইসমাইলের সময় নির্মিত কাবা শরীফ এক নয়। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণ বারবারই নির্মাণ করতে হয়েছে কাবা শরীফ। তবে এতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি এসেছিল মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবদ্দশায়, যখন তিনি নবী হননি। কাবা শরীফের ভেতর কালো পাথরটি রাখা ও মর্যাদাপূর্ণ এই কাজের অংশীদার হওয়া নিয়ে যখন বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল, তখন মুহূর্তেই সমাধান দিয়ে সে সময় ভয়াবহ যুদ্ধ ও রক্তপাতের সম্ভাবনাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলেন মহানবী (স.)।


এরপর থেকেই কয়েক শতাব্দী পরপর কাবা শরীফে বড় ধরনের অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ কাজ পরিচালনা করা হয়। শেষবার এই পুনঃসংস্কার করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, যা ছিল অত্যন্ত বড় পরিসরের। সে সময় অনেকগুলো পাথর প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, ভিত্তি আরো মজবুত করে নির্মাণ করা হয়েছে এবং নতুন একটি ছাদ তৈরি করা হয়েছে। আগামী কয়েকশ’বছরে এটিই শেষ পুনঃনির্মাণ বলে আশা করা হচ্ছে।


কাবা শরীফে দুটো দরজা ও একটি জানালা ছিল: একদম প্রথম নির্মিত কাবা শরীফের ভেতরে প্রবেশ ও বাইরে বের হওয়ার জন্য পৃথক দুটি দরজা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এর একপাশে একটি জানালাও ছিল। বর্তমান কাবা শরীফে মাত্র একটি দরজা থাকলেও নেই কোনো জানালা।


কাবা শরীফ ছিল নানা রঙে বর্ণিল: আমরা কাবা শরীফকে ‘কিসওয়াহ’হিসেবে পরিচিত স্বর্ণের নকশাখচিত কালো কাপড়ে দেখেই অভ্যস্ত। অন্য কোনো রঙে কাবা শরীফকে যেন ভাবাই যায় না। মহানবীর (স.) ছোট চাচা আব্বাস ইবনে আব্দ আল-মুত্তালিবের শাসনামল থেকে শুরু হওয়া আব্বাসিদ সাম্রাজ্য শুরুর আগ পর্যন্ত কাবা শরীফকে সবুজ, লাল, সাদাসহ নানারকম রঙেই দেখা যেত। আব্বাসিদ সাম্রাজ্যে গৃহস্থালি রং হিসেবে কালো রং ব্যবহার করা হতো। সে সময় থেকেই কাবা শরীফকে কালো রঙে দেখা যায়।


কাবা শরীফের দায়িত্ব একটিই পরিবারের ওপর: মহানবীর (স.) সময়ে হজের আচার-অনুষ্ঠান যারা পালন করতেন, তারা ছিলেন কুরাইশ বংশের বিভিন্ন উপ-গোষ্ঠীর সদস্য। তাদের হাতেই কাবা শরীফের বিভিন্ন আচারের দায়িত্ব থাকত একেকটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। একটি গোষ্ঠী ছাড়া বাকি সবগুলো গোষ্ঠীই ধারাবাহিকভাবে কাবা শরীফের অভিভাবকত্ব থেকে সরে যেত। মক্কা বিজয় উপলক্ষ্যে মহানবীর (স.) ওপর এই সমস্ত দায়িত্ব ও অভিভাবকত্বের মর্যাদা অর্পণ করা হয়েছিল। কিন্তু নিজে ভোগদখল না করে এই দায়িত্ব ও মর্যাদা তিনি তুলে দিয়েছিলেন বনি শাইবা পরিবারের উসমান ইবনে তালহার ওপর। এরপর বছরের পর বছর ধরে কাবা শরীফের অভিভাবকত্ব এই পরিবারটির ওপরেই ন্যস্ত, তাদের কাছেই থাকে কাবা শরীফের চাবি। মহানবী (স.) সৃষ্টির শেষদিন পর্যন্ত এই দায়িত্ব এই পরিবারটির ওপরেই দিয়ে গেছেন এবং বলেছেন, ‘এই নিন, ও বনি তালহা, কেয়ামতের আগ পর্যন্ত চিরকালের জন্য, এবং কোনো অন্যায় ও অন্যায্য স্বেচ্ছাচারিতা ও নির্যাতন ছাড়া অন্য কোনোভাবে এটি আপনার কাছ থেকে ফেরত নেওয়া হবে না।’


এরপর থেকেই কোনো খলিফা হোন, বা সুলতান বা সম্রাট- বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিও মহানবীর (স.) এই কথাগুলোর প্রতি সম্মান জানাতে এবং কাবা শরীফে প্রবেশের আগে এই ছোট পরিবারটির কাছ থেকে অনুমতি নিতে বাধ্য।


একসময় সবার জন্যই উন্মুক্ত করা হতো কাবা শরীফ: বর্তমানে কাবা শরীফ কেবল মুসলিমদের জন্যই উন্মুক্ত হলেও এক সময়ে সপ্তাহে দুদিন করে এটি সবার জন্যই উন্মুক্ত করে দেয়া হতো। কিন্তু হজযাত্রী ও মুসলিম পর্যটকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় এবং আরো অনেক কারণেই কাবা শরীফ এখন বছরে কেবল দুবার সম্মানিত ও বিশেষ অতিথিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, তা তারা যেই ধর্মেরই হোন না কেন।


একসময়ে সাঁতরিয়ে পৌঁছাতে হত কাবা শরীফের কাছে: একটি উপত্যকার একদম নিচে অবস্থান হলে সামান্য বৃষ্টি হলেও বন্যাপ্রবণ উপত্যকাগুলোতে ভীষণ জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। মক্কাও এর বাইরে নয়। তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং পানি নিষ্কাশন প্রণালী আবিষ্কার হওয়ার আগের দিনগুলোতে মক্কায় দারুণ সমস্যা সৃষ্টি হতো। দিনের পর দিন কাবা শরীফের অর্ধেকটাই ডুবে থাকত পানির নিচে। কিন্তু তাই বলে কি মুসলিমরা কাবা শরীফে যাওয়া কিংবা ‘তাওয়াফ’করা, অর্থাৎ কাবা শরীফের চতুর্দিকে ঘোরার কাজ বাদ দিতেন? মোটেই না। তারা সাঁতরিয়ে কাবা শরীফের কাছে পৌঁছাতেন সে সময়।


যা আছে কাবা শরীফের ভেতর: অনেক বছর ধরে অনেকেই ভেবেই চলেছেন যে কাবা শরীফের ভেতরটা দেখতে কেমন। হাতে গোনা যে দু’তিনজন কাবা শরীফের ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছেন, কেবল তাদের কাছ থেকে শুনেই কৌতূহল মেটানো যথেষ্ট কি? কাবা শরীফের ভেতরটা বর্তমানে মার্বেল পাথরের তৈরি এবং ওপরের দেয়াল ঢেকে রাখা রয়েছে একটি সবুজ কাপড়। দেয়ালে লাগানো রয়েছে বিভিন্ন সময়ে ‘আল্লাহর ঘর’পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে যে শাসকদের আমলে, তাদের নাম খোদাই করা ফলক। বিশ্বে এটিই একমাত্র স্থান, এই ‘আল্লাহর ঘর’, সমগ্র মানবজাতির প্রথম প্রার্থনাস্থল, কাবা শরীফ- যেখানে একজন মুসলিম হয়ে আপনি যেদিকে খুশি ফিরে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে নিজের আর্তি জানাতে পারবেন।


আছে দুটো কাবা: ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবীর এই কাবা শরীফের ঠিক ওপরেই বেহেশতে রয়েছে আরো একটি কাবা শরীফ, ঠিক একই রকমের। এই দ্বিতীয় কাবা শরীফটির উল্লেখ রয়েছে পবিত্র কুরআন শরীফে এবং মহানবী (স.)-ও এই কাবা শরীফের কথা বলেছেন। মিরাজ সফরের কথা বলতে গিয়ে পৃথিবীতে আল্লাহ প্রেরিত দূত মহানবী (স.) বলেছেন, ‘এরপর আমাকে দেখানো হলো আল-বাইত-আল-মা’মুর (আল্লাহর ঘর)। আমি জিবরাইলকে জিজ্ঞেস করলাম এই বিষয়ে এবং তিনি বললেন, এটি আল বাইত-উল-মা’মুর যেখানে ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রতিদিন নামাজ পড়েন এবং প্রতিদিন তারা নামাজ পড়ে ফিরে যাওয়ার পর আর কোনোদিন এখানে ফেরেন না (প্রতিদিন নতুন ৭০ হাজার ফেরেশতা এখানে আসেন)।’


কালো পাথরটি ভাঙা: রূপার তৈরি ফলকের ভেতর কালো পাথরটি কিভাবে এলো, এ নিয়েও কৌতূহলের শেষ নেই। অনেকে বলেন, যখন এটি মহানবীর (স.) সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের দখলে ছিল, তখন মক্কা-কাবা শরীফ দখল করতে এসেছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান। তখন উসমানের বাহিনীর ছোঁড়া পাথরে পাথরটি ভেঙে গিয়েছিল। তবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মত অনুসারে, মধ্যযুগে বাহরাইন থেকে আসা কারমাতিয়া খ্যাত চরম বিরোধী ইসমাইলিরাই পাথরটির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল। ইসমাইলির দাবি ছিল- হজ কুসংস্কার। সে সময় তারা হজ পালনরত অবস্থায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করে মৃতদেহগুলো জমজম কূপে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।


তাও যথেষ্ট মনে না হওয়ায় তারা কালো পাথরটিকে আরবের পূর্বাঞ্চলে এবং সেখান থেকে ইরাকের কুফায় নিয়ে গিয়েছিল। আব্বাসিদ সাম্রাজ্যের সময় তাদের এটি ফেরত দিতে বাধ্য করার আগ পর্যন্ত এটি সেখানেই ছিল। তবে তারা এটি ফেরত দিয়েছিল টুকরো টুকরো অবস্থায় এবং এই পাথরখণ্ডগুলোকে জোড়া লাগাতেই একসাথে এগুলোকে রূপার তৈরি ফলকে জুড়ে দেয়া হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, পাথরটির সবগুলো টুকরো এখনো এক করে রাখা হয়নি এবং হারানো টুকরোগুলোও আশপাশেই কোথাও রয়েছে।


বর্গাকার ছিল না কাবা শরীফ: কাবা শরীফ যখন নির্মাণ করা হয়েছিল, তখন এটি বর্গাকার নয়, বরং আয়তাকার হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। মহানবীর (স.) নবুওয়্যাত লাভের কয়েক বছর আগে যখন কাবা শরীফ পুনঃনির্মাণ করা হয়, কুরাইশরা শুধুমাত্র পবিত্র পথে আয় করা অর্থ দিয়ে এটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। অর্থাৎ কাবা শরীফ নির্মাণে জুয়া, লুটপাট, যৌনবৃত্তি, সুদের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করা হবে না। তখন এত বেশি অন্যায় ও অপরাধের ঘটনা ঘটতো যে ন্যায়ের পথে থেকে আয়কৃত অর্থ দিয়ে কাবা শরীফ নির্মাণ সম্ভবপর ছিল না। তখনকার সময়েও সম্পদশালী অঞ্চলটির অধিকাংশ সম্পদই ছিল অন্যায়ভাবে অর্জিত। তাই অল্প খরচে কুরাইশরা তখন একটি ছোট কাবা শরীফ নির্মাণ করলেন এবং তাতে ছিল মাটির তৈরি ইটের দেয়াল। ওই কাবা শরীফটি পরিচিত ছিল ‘হিজর ইসমাইল’নামে, যদিও তার সাথে নবী হযরত ইসমাইল (আ.)-এর কোনো সম্পর্ক ছিল না।


মহানবী (স.) মৃত্যুর আগে আগের আকৃতিতে কাবা শরীফ নির্মাণ দেখে যেতে চাইলেও সে ইচ্ছা পূরণ হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। কাবা শরীফের ইতিহাস কেবল মুসলিমদের গৌরবান্বিত অতীতের উৎসাহদায়ক অংশই নয়, বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সারা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তেই মুসলিমরা থাকুক না কেন, তাদের এক করার একটি বাস্তব ও বর্তমান মাধ্যম হলো কাবা শরীফ। এটি মুসলিমদের একতার প্রতীকও বটে।


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com