ইসলামি আইনে ধর্ষণের শাস্তি কী?
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৪, ১০:২৬
ইসলামি আইনে ধর্ষণের শাস্তি কী?
ধর্ম ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ইসলামি আইন অনুযায়ী ধর্ষণের ক্ষেত্রে দুই ধরনের অপরাধ পাওয়া যায়। ব্যভিচার ও বল প্রয়োগ করে সম্ভ্রম হানি ও শারীরিক ক্ষতি। কেউ ধর্ষণ করলে দুইটির শাস্তিই প্রয়োগ করা হবে।


ব্যভিচার হলো বিবাহ সম্পর্ক ছাড়া পরস্পর যৌনমিলন করা। এ ক্ষেত্রে পরস্পর সম্মতি থাকলেও ব্যভিচার হবে। যদি কোনো এক পক্ষের সম্মতি না থাকে তাহলে তা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে।


ইসলামি আইনশাস্ত্র মোতাবেক ধর্ষকের শাস্তি ব্যভিচারকারীর শাস্তির অনুরূপ। তবে অনেক ইসলামি স্কলার ধর্ষণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছু শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন।


শিরক ও হত্যার পর ব্যভিচার সুস্পষ্ট হারাম ও বড় ধরনের অপরাধ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সুরা বনিইসলামি ইসরাইল ৩২)


প্রখ্যাত তাফসিরবিশারদ ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ব্যভিচার করো না’-এর চেয়ে ‘ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’ এটি অনেক বেশি কঠোর বাক্য। এর সহজ অর্থ হলো, যেসব বিষয় ব্যভিচারে উদ্বুদ্ধ করে ও ভূমিকা রাখে সেগুলোও হারাম।’


ধর্ষণের শাস্তির ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিষয়টির স্পর্শকাতরতা নিশ্চিত করা হয়েছে।


এক হাদিসে আছে, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে এক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে নবীজি (সা.) মহিলাকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষককে হদের শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ ২৫৯৮)


যেসব শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতি কোরআন-হাদিসে সুনির্ধারিত রয়েছে সেগুলোকে হদ বলে। যেমন চুরি করলে হাত কেটে দেয়া, ব্যভিচারে লিপ্ত হলে ১০০ বেত্রাঘাত মারা বা পাথর মেরে হত্যা করা।


অন্য হাদিসে আছে, গনিমতের এক পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসির সঙ্গে সরকারি মালিকানাধীন এক গোলাম জবরদস্তিপূর্বক ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে তার কুমারীত্ব নষ্ট হয়ে যায়। হজরত উমর (রা.) ওই গোলামকে বেত্রাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসীকে বেত্রাঘাত করেননি।’ (বুখারি ৬৯৪৯)


ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি


ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি ব্যক্তিভেদে একটু ভিন্ন। ব্যভিচারী বা ব্যভিচারিণী যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ইসলামের বিধান। আর যদি ব্যভিচারী বা ব্যভিচারিণী অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে একশটি বেত্রাঘাত করা হবে।


আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকরের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ (সুরা নুর ২)


হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি একশ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশ বেত্রাঘাত ও রজম (পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড)।’ (মুসলিম)


এই হাদিসের আলোকে অন্য মাজহাবের ইসলামি স্কলাররা বলেন, ব্যভিচারী অবিবাহিত হলে তার শাস্তি দুইটি। এক. একশ বেত্রাঘাত। দুই. এক বছরের জন্য দেশান্তর।


হানাফি মাজহাবের (বাংলাদেশিরা সাধারণত যে মাজহাবের) বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক্ষেত্রে হদ (শরিয়তকর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি) হলো, একশ বেত্রাঘাত। আর দেশান্তরের বিষয়টি বিচারকের বিবেচনাধীন। তিনি ব্যক্তি বিশেষে চাইলে তা প্রয়োগ করতে পারেন।


ইসলামে ধর্ষণের শাস্তির স্বরূপ


ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে ব্যভিচার সংগঠিত হয়। আর অন্য পক্ষ হয় নির্যাতিত। তাই নির্যাতিতের কোনো শাস্তি নেই। কেবল অত্যাচারী ধর্ষকের শাস্তি হবে।


ধর্ষণের ক্ষেত্রে দু’টো বিষয় অবধারিতভাবে সংঘটিত হয়। এক. ব্যভিচার। দুই. বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন। প্রথমটির জন্য পূর্বোক্ত ব্যভিচারের শাস্তি বরাদ্দ। পরেরটির জন্য ইসলামি আইনজ্ঞদের এক অংশ বলেন, ‘মুহারাবা’র শাস্তি হবে।


মুহারাবা হলো, পথে কিংবা অন্য কোথাও অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়া ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা। এতে কেবল সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হতে পারে, আবার কেবল হত্যা করা হতে পারে। আবার উভয়টিই হতে পারে।


মালেকি মাজহাবের আইনজ্ঞরা ‘মুহারাবা’র সংজ্ঞায় সম্ভ্রম হননের বিষয়টি যোগ করেছেন। তবে সব ইসলামি স্কলারই ‘মুহারাবা’ বলতে পৃথিবীতে অনাচার, নিরাপত্তা বিঘ্নিতকরণ ও ত্রাস সৃষ্টি ইত্যাদি অর্থে উল্লেখ করেছেন।


মুহারাবার শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহ ও তার রসুলের সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলিতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো- তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সুরা মায়েদা ৩৩)


এখানে হত্যা করলে হত্যার মাধ্যমে শাস্তি, সম্পদ ছিনিয়ে নিলে বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কেটে দেয়া, সম্পদ ছিনিয়ে হত্যা করলে শূলিতে চড়িয়ে হত্যা করার ব্যাখ্যা ইসলামি আইনজ্ঞরা দিয়েছেন। আবার এরচেয়ে লঘু অপরাধ হলে, দেশান্তরের শাস্তি দেয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন।


মোটকথা, হাঙ্গামা ও ত্রাস সৃষ্টির অপরাধের শাস্তি ত্রাস ও হাঙ্গামাহীন অপরাধের শাস্তি থেকে গুরুতর।


বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সংগম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’


ইসলামের সঙ্গে এই সংজ্ঞার তেমন কোনো বিরোধ নেই। তবে এতে কিছুটা অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। ইসলাম সম্মতি-অসম্মতি উভয় ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিবাহবহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ককে দণ্ডনীয় অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু আমাদের দেশীয় এ আইনে কেবল অসম্মতির ক্ষেত্রে অপরাধ বলা হয়েছে। পার্থক্য এইটুকুই।


সম্মতি ছাড়া বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ইসলাম ও দেশীয় আইন এবং সর্বস্তরের জনগণের কাছে অপরাধ হিসেবে গণ্য। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু না হলে তার মৃত্যুদণ্ড নেই। কেবল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড রয়েছে। পক্ষান্তরে ইসলামে বিবাহিত কেউ ধর্ষণ বা ব্যভিচার করলে, তাকে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা রয়েছে।


আইনে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর ইসলামে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে, প্রথমে ধর্ষক ব্যভিচারের শাস্তি পেয়ে পরে হত্যার শাস্তি পাবে। যদি অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়, তাহলে ‘কিসাস’ বা মৃত্যুদণ্ড। আর যদি অস্ত্র দিয়ে না হয়, এমন কিছু দিয়ে হয়, সাধারণত যা দিয়ে হত্যা করা যায় না। তাহলে অর্থদণ্ড। যার পরিমাণ একশ উটের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ (প্রায় কোটি টাকা)।


ধর্ষণের সঙ্গে যদি আরও কিছু অপরাধ সংশ্লিষ্ট রয়েছে। যেমন, অশ্লীল ভিডিও ধারণ করা। ওই ধরনের ভিডিও প্রচার করা ইত্যাদি। যদি এসব অপরাধ পাওয়া যায়, তাহলে শাস্তির পরিমাণ আরো দীর্ঘ হবে।


ইসলামে ধর্ষণ প্রমাণের নীতিমালা


ব্যভিচার প্রমাণের জন্য ইসলামে দুটি বিষয়ের কোনো একটি জরুরি। এক. ৪ জন সাক্ষী, দুই. ধর্ষকের স্বীকারোক্তি। তবে সাক্ষী পাওয়া না গেলে আধুনিক ডিএনএ টেস্ট, সিসিটিভি ফুটেজ, মোবাইলে ধারণকৃত ফুটেজ, ধর্ষিতার বক্তব্য ইত্যাদি অনুযায়ী ধর্ষককে দ্রুত গ্রেফতার করে, কৃত অপরাধ স্বীকারে চাপ প্রয়োগ করা জরুরি। স্বীকারোক্তি মিললে ধর্ষকের ওপর শাস্তি কার্যকর করা হবে।


বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে যতটুকু শাস্তি রয়েছে তা বাস্তবায়ন করা রাষ্ট্র পক্ষের দায়িত্ব। শাস্তি প্রয়োগে নানাবিধ বিলম্ব করা ও রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক কোনো চাপের কারণে ধর্ষণের উপযুক্ত শাস্তি না দেয়া সম্পূর্ণ অনুচিত।


অনেক সময় ধর্ষিতাকে একঘরে করে রাখা হয়। তাকে সমাজে বাঁকা চোখে দেখা হয়। তার পরিবারকে হুমকি-ধামকি দেয়া হয়। ইসলাম কোনোভাবেই এসব সমর্থন করে না।


ইসলামি আইন অনুযায়ী ধর্ষণের যেসব শাস্তির কথা আলোচিত হয়েছে, তা কেবল রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের অনুমোদনপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রয়োগ করবে, ব্যক্তি পর্যায়ের বা সামাজিক কোনো সালিশি বৈঠকের কেউ নয়। কেননা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী চাইলেই অন্যকে শাস্তি দিতে পারে না। এর জন্য রাষ্ট্রের মতো পৃথক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয়। যা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত।


বিবার্তা/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com