শিরোনাম
কারবালার শিক্ষা
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২১, ১০:২৭
কারবালার শিক্ষা
মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান
প্রিন্ট অ-অ+

১০ ই মহররম ৬১ হিজরি। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের একটি দিন। ইরাকের বাগদাদ থেকে একশ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত কারবালা নামক স্থানে ঘটেছিলো মর্মান্তিক এক ঘটনা। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদরের দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.) সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন তৎকালীন উমাইয়া শাসক ইয়াযিদের বাহিনীর হাতে।


মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বীর বিক্রমে লড়াই করেছিলেন। তবুও মাথা নত করেননি অন্যায়ের সামনে। সব অসত্য অবিচার অনাচার এবং জুলুম নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার এ লড়াই চিরদিনের জন্য ইতিহাস হয়ে রয়েছে। এ ছিলো মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর মিছিল। সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের দুর্বার প্রতিরোধ। পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই ছিলো প্রথম ঘটনা যেখানে পরাস্ত হয়েও বিজয় ছিনিয়ে নেয় কেউ।


হযরত হুসাইন (রা.) সে দিন শাহাদাত বরণ করেছিলেন। নিহত হয়েছিলেন সপরিবারে। কোলের ছোট্ট শিশু আলি আসগরকেও সেদিন জালিমদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি । কিন্তু তার এ পরাজয় ছিলো বিস্ময়কর বিজয়। আজ পর্যন্ত কেউ ইয়াজিদকে মনে স্থান দিতে পারে না তার এ অন্যায় আচরণ এবংএই সীমাহীন জুলুমের কারণে।


সর্বস্তরের মানুষ হযরত হুসাইনকেই (রা.) ভালোবাসে হৃদয় থেকে। বিরাট পরাশক্তির অধিকারী ইয়াজিদ শত চেষ্টায়ও মানুষের মন থেকে ঘৃণা দুর করতে পারেনি, কখনো পারবেও না। কিন্তু হযরত হুসাইন শাহাদাৎ বরণ করে চির বিজয়ী হয়ে আছেন ইতিহাসে। মানুষের হৃদয়ে চির জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। অনুপম এক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বিশ্ববাসীর সামনে। তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন কিভাবে নীতিতে অটল থাকলে সাময়িক পরাজয় হলেও চূড়ান্ত শুভ পরিণতি চুম্বন করে নীতি নিষ্ঠ মানুষের উজ্জ্বল ললাট।


কারবালা ছিলো পাহাড়ি উষর এক অঞ্চল। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঐতিহাসিক ফোরাত নদী। শেষ সময়ে হযরত হুসাইন (রা.) এক ফোটা পানির জন্য কাতর হয়েছেন। সামান্য পানি, জালিমরা সেই পানিও পান করতে দেয়নি হযরত হুসাইনকে( রা.)। অবশেষে কোনো রকমে তিনি পানি সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু ততক্ষণে তার এক সন্তান পানির পিপাসা সইতে না পেরে মারা গেছে, তিনি সেই কথা স্মরণ করে আর পানি পান করতে পারেন না, পানি স্পর্শ না করেই, মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, যুদ্ধ করতে করতেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন, বীরের বেশে মাথা উচু করেই পরম প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান।


সেই গর্বিত সুউচ্চ অথচ বিনীত মাথা কেটে ফেলে নরাধম শিমার। শিমার বহু টাকা পুরস্কারের আশায় এমনটি করেছিলো। কুফায় উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের সামনে রাখা হলো হযরত হুসাইন (রা.)-এর কাটা মাথা। ইবনে যিয়াদ বললো, এতো সুন্দর চেহারা আমি কখনো দেখিনি। সে একটি লাঠি দিয়ে হযরত হুসাইনের ঠোটে আঘাত করতে লাগলো।


সেখানে বসা ছিলেন বয়োবৃদ্ধ এক সাহাবি। হযরত যায়েদ ইবনু আরকাম। বৃদ্ধ যায়েদ ইবন আরকাম আর বরদাশত করতে পারলেন না। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, জালিম, সরিয়ে নাও, ঐ লাঠি মুখ থেকে সরিয়ে নাও, আমি আমার দু চোখে কতবার দেখেছি, প্রিয় নবী (সা.) ঐ প্রিয় ঠোঁটে চুম্বন করেছেন। কত শত বার আদর করেছেন।


নবীজী বলেছেন, হাসান হোসেন আমার দুই কলিজার টুকরা, জান্নাতের যুবকদের সরদার। তোমরা নবী পরিবারের সাথে ধৃষ্টতা করে জান্নাতে যেতে চাও? কাল কেয়ামতে কোন মুখে নবীজীর সামনে দাঁড়াবে? কোন অধিকারে প্রিয় নবীজীর হাত থেকে হাউজে কাউসারের পানি পান করবে?


প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্তের নামাজে আমরা প্রিয় নবীজীর উপর দরুদ পড়ি। সাথে তার আহলে বাইতের জন্যও প্রার্থনা করি..ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ। হে আল্লাহ তুমি রহমত বর্ষণ করো প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর বংশধরদের উপর। এই বংশ ধারার অন্যতম সদস্য হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন (রা.)। এই দরুদের কারণে এমনিতেই নবীজীর বংধরের প্রতি মুসলিম উম্মাহর ভালোবাসা রয়েছে।


কারবালার ঘটনা তবু আমাদের ভালোবাসা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। প্রতি বছর মহররম আমাদেরকে সেই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। হযরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা আমাদের কাঁদিয়ে যায়। নিল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া/আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া../কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে/সে কাঁদনে আসু আসে শিমারেরও ছোরাতে..।


সত্যি, ইতিহাসে আর কোনো ঘটনায় মানুষ এতটা কাঁদেনি, কারবালার ঘটনা স্মরণ করে যতটা অশ্রু ঝরেছে পৃথিবীর মাটিতে। আসমানের ফেরেশতারাও হয়তো তাদের কান্না থামিয়ে রাখতে পারেনি সেদিন। শিয়া মুসলিমরা এ দিন উপলক্ষে মহররমের শুরু থেকেই নানান অনুষ্ঠান আয়োজন করেন।


তাযিয়া মিছিল বের করেন, শোক প্রকাশ করতে গিয়ে তারা তরবারি ও ছোরা দিয়ে নিজেদের গায়ে মাথায় পিঠে হাতে মুখে আঘাত করেন। নিজেদেরকে রক্তাক্ত করেন। এভাবে উদযাপন করেন পুরো মহররম মাস। আমাদের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম এই সব মাতম ও বিলাপের প্রতিবাদে লিখেছেন,
ফিরে এলো আজ সেই মহরম মাহিনা/ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা।


এটাই সত্য, আমাদেরকে কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে, শিক্ষাটুকু গ্রহণ না করে, কেবল বিলাপ আর মাতমে আকাশ বাতাস ভরিয়ে তোলায় কোনো লাভ নেই। হায় হোসেন হায় হোসেন বলে শোক প্রকাশের কোনো অর্থ নেই। কারবালার শিক্ষা হচ্ছে ত্যাগ। আত্মদান। নিজেকে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিলিয়ে দেওয়া।


হযরত হুসাইন ( রা.) মদীনা মুনাওয়ারায় খুব আরাম আয়েশের জীবন যাপন করতে পারতেন। পরিবার ও ভক্তদের মাঝে পরিবেষ্টিত হয়ে সুন্দর সুখে কেটে যেতো জীবন। তার নানা মহানবী (সা.) যেমন সত্য প্রতিষ্ঠান জন্য জন্মভূমি মক্কা মুকররমা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করে ছিলেন, একইভাবে হযরত হুসাইন সত্য ও ন্যায়ের জন্য মদীনা মুনাওয়ারা ত্যাগ করে কুফা নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। কোনোভাবে তিনি কুফা শহরে পৌঁছতে পারলে ইতিহাস হয়ত অন্যভাবে লেখা হতো। কিন্তু কুফায় পৌঁছার পূর্বেই কারবালায় ঘটে এই মর্মান্তিক বিয়োগান্তক ঘটনা।


আজ দেড় হাজার বছর পরও মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় বিভক্তি শিয়া সুন্নির বিভেদ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। কারবালায় হযরত হুসাইন (রা.) মুসলিমদেরকে বিভক্ত করতে রক্ত দেননি। আমরা যদি এ ঘটনাটিকে আমাদের বিবাদের মূল হিসেবে ধরে নেই তাহলে তা এই মহান মনীষীর প্রতি চরম অবিচার করা হবে।


বর্তমান এক চরম যুগ সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে মুসলিম উম্মাহ। এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন উম্মাহর ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সৌহার্দের।আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদেরকে বিষয়টি অনুধাবন করার তাওফিক দান করুন; সততা, প্রেম, মহত্ব ও পরম নিষ্ঠায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ হবার তাওফিক দিন। (আমীন)।


বিবার্তা/বিদ্যুৎ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com