অনেক দিন লিখিনি। সবাই নিষেধ করে। লেখা পড়ে মানুষ এত্ত বিরক্ত যে ইনবক্সে ঝাড়ি দিয়ে লিখতে 'না' করে। একজন লিখল, আমি সাধারণ মানুষ, এত্ত কিছু বুঝি না। তুই উল্টোপালটা লিখবি না।
আমি ভাবি, মানুষের সাধারণ-অসাধারণ ক্যাটাগরিটা কিভাবে হয়! সবাই বলার সময় বলে, ''আমি সাধারণ মানুষ,আমি সাধারণ মানুষ', আজ পর্যন্ত অসাধারণ কাউকে দেখলাম না। এটা কি বিরল? নাকি আমার কপালের দোষ?
সে যা-ই হোক, একটা জিনিস বুঝেছি, সাধারণ আর সাধারণ নাই, সাধারণ হয়ে গেছে ন্যাকামি, ভন্ডামি আর উপহাসের অসাধারণ একটি শব্দ।
এই তো কয়েকদিন আগে বিরাট বাড়ি, গাড়ি কোটি টাকার মালিক বলল - জীবনে বেশি কিছু চাই না, শুধু চাই একটা সাধারণ জীবন, আমি সাধারণ মানুষ, সাধারণভাবে পার করে দিতে চাই।
কিছুদিন আগে আমার ঘনিষ্ঠ স্কুল ফ্রেন্ড, যে কিনা একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান মোটামুটি মানের চাকুরি করে (অনেক ভয়াবহ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, প্রমোশন আর জব চেঞ্জের অফার থাকা সত্ত্বেও) জব চেঞ্জ করছে না কেন? জানতে চাইলে সে বলল, দোস্ত আমি সাধারণ মানুষ, সাধারণই থাকতে চাই। এত্ত কিছুর দরকার নাই। জীবনটা পার করে দিতে পারলে বাঁচি।
সেদিন এক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের সাথে হলো। কথা প্রসংগে তিনি বললেন, তিনি সাধারণ মানুষ, সাধারণভাবে থাকতে চান। অথচ আমার জানামতে তিনি অসাধারন ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ।
আমার আরেক বন্ধু গ্রামীণফোনে জব করে। তার সম্পদ, চাকুরী, প্রভাবশালী আত্মীয়ের ছড়াছড়ি। সে আমাকে দেখলে বা ফেসবুকে কথা হলে প্রায় সময় বলে, আমি সাধারন মানুষ।
গেল পরশু বাড়ি ফেরার পথে রিক্সাওয়ালা চাচার সাথে গল্প করছিলাম। উনার ছেলে সেভেনে পড়ে আর একটি ৩ বছরের মেয়ে আছে।
সেদিনকার মতো আমি ওনার গাড়ির শেষ যাত্রী, গাড়ি জমা দিয়ে দেবেন। সেদিনের মত খরচ উঠে গেছে কিন্তু হাতে তখনও গাড়ি জমা দিতে দুই আড়াই ঘন্টা বাকি আছে।
আমি বললাম, আপনার তো সময় আছে, আরো চালান না কেন। উনি বললেন, স্যার বাসায় যামু, বাচ্চাদের কাছে যামু। ছোট মাইয়াডা বেশি কান্নাকাটি করে, দেখলে বুকে মুখ গুছে দিয়া শুয়ে থাকে।
আমি বললাম, এই সময়ে তো আরো ৩০০/৪০০ টাকা আসতে পারে। উনি বললেন, আমি গরীব মানুষ, যা পাই তাতে চলে যায়, বেশি দরকার নাই।
প্রতিউত্তরে আমি পুনরায় বললাম, বাচ্চাদের রাতে সময় দিতে পারবেন, এখনও অনেক সময় আছে আরো কিছু আয় করে যান।
লোকটার দ্রুত উত্তর - না স্যার! এত্ত দরকার নাই। রাইতে হেরা ঘুমায় যাইবো--।
- বাসা কই??
- বাসা আর কই, বস্তিতে! হাসতে হাসতে বলেন একরুমে, কোনোরহমে থাহা, বৃষ্টিও পড়ে, চানের আলোও পড়ে।
আমি নেমে টাকা দিয়ে দিই কিছু বাড়তিসহ। উনি ঘুরিয়ে চলে গেলেন।
পরশু রাতে "সাধারণ" আর বৃষ্টিও পড়ে, চানের আলোও পড়ে নিয়ে অনেক ভাবলাম।
আসলে যে যার যার অবস্থানে মানুষগুলো সাধারণ, কোটিপতি তার অবস্থানকে ভাবছেন সাধারণ, দশ বিশটা গাড়ি কিংবা একশ দুশো কোটি টাকা থাকাটা সাধারণ ব্যাপার। স্ব স্ব অবস্থান থেকে সকলেই সাধারণের ফ্রেমে বন্দি থাকতে চায়।
মধ্যবিত্ত তার অবস্থানকে ভাবছেন সাধারণ আর গরীব ভাবছে তার অবস্থানকে। সবাই সাধারণ।
ইংল্যান্ডের রাণীর অবস্থা!! যিনি দুর্ভিক্ষের সময় তার প্রজাদের রুটি জুটছে না শুনে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেক খেতে। উনার কাছে কেকই ছিল সাধারণ।
তো যাই হোক, সাধারণ মানুষ আমার লিখা পড়বে, এটা আমি প্রত্যাশা করি না।
আমার মত মানুষের লিখা পড়ে সাধারণ মানুষের উপকার হবে না, সময় নষ্ট ছাড়া। তবে এটা বলি নিজেকে নিজে আগ বাড়িয়ে সাধারণ বলার কি দরকার!! অনেক সময় এতে অন্য অসাধারণ মানুষদের উপহাস করা হয়।
আসলে সবাই অসাধারণ, এত্ত অসাধারণের ভিড়ে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া তাই দুষ্কর। সাধারণ হওয়া এত্ত সহজ না, সাধারণ জিনিসটা সাধন করে অর্জন করতে হয়।
সাধারণ মানুষ নিজেও জানবে না সে সাধারণ। কারণ এত্ত সাধারণ-অসাধারণ বুঝা তার সাধারণ ব্রেনে আসবে না।
তারা চাঁদের আলো আর বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে যায়। তবুও বুঝবে না তারাই সাধারণ!!!
লেখক: সিনিয়র পুলিশ কমিশনার, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ।
বিবার্তা/কামরুল/হুমায়ুন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]