শিরোনাম
স্মরণে শাহ আব্দুল করিম
প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৯:১৫
স্মরণে শাহ আব্দুল করিম
একে কুদরত পাশা
প্রিন্ট অ-অ+

হাওরাঞ্চলের মানুষের শোকের মাস সেপ্টেম্বর। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর লাখ লাখ ভক্তকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন হাওরের মানুষ বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম।


শাহ আব্দুল করিম শুধু বাউল নন। তিনি একজন রাজনীতিক ও দেশের যে কোনো সংকটময় মুহুর্তে তিনি প্রহরীর মতো দেশমাতার কাছে দাঁড়িয়েছেন। আজকে দেশের এ সংকটময় মুহুর্তে আব্দুল করিমের মতো গুণী মানুষের প্রয়োজন অনেক বেশি।


হাওর-বাওর-খাল-বিল ও নদী-নালার দেশ সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের ধলআশ্রম গ্রামে ১৯১৬ ইংরেজির ১৫ ফেব্রুয়ারি এ কালজয়ী পুরুষ শাহ আব্দুল করিম জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইব্রাহীম আলী এবং মায়ের নাম নাইওরজান বিবি। ভাটির নিজস্ব পরিবেশ ও প্রকৃতি এখানকার মানুষদের করে তোলে ভাবুক, আউল-বাউল, শাহ আব্দুল করিমও তাদের মধ্যে একজন। কৃষি মজুর অভাবী পরিবাবে তাঁর জন্ম। অভাবের সাথে যুদ্ধ করে শুরু হলো জীবন।


শাহ আব্দুল করিমের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দিরাই-শাল্লার সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০০৯ সালে করিম লোক উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছিলেন, ''সংসারের অভাব, কালনীর কালো জল, আর ভরাম হাওরের ঢেউ রাখাল বালক শাহ আব্দুল করিমকে বাউল সম্রাটে পরিণত করেছে।''


শাহ আব্দুল করিমের একমাত্র পুত্র শাহ নুর জালাল পিতার স্মৃতিচারণ করেন এভাবে- ''এই মিনতি করিরে বন্ধু চাইরা যাইওনা, আমিতো জানিরে বন্ধু তুমি আপনা।''


ভক্ত বাউল নূর জাহান তার মনের আকুতি প্রকাশ করে বলেন, ''আশি বলে গেলো বন্ধু আইলো না/ আসবে বলে আশায় রইলাম, আশাতে নইরাশা হইলাম/ বাটাতে পান সাজাই তইলাম, আইয়া বন্ধে খাইলো না।''


নূর জাহানরা মনে করেন, তাদের গুরু গানের মাধ্যমেই তাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন আজীবন। শুধু নূর জাহান নয় হাজার করিম ভক্তরা ভীর জমান শাহ আব্দুল করিমের মাজার উজানদল গ্রামে। শাহ আব্দুল করিমের মৃত্যু বার্ষিকীকে গিরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে করিম ভক্তরা আসতে শুরু করছেন উজান দল গ্রামে।


দেশমাতৃকার প্রতি শাহ আব্দুল করিমর ছিল অগাধ ভালোবাসা। দেশের যে কোনো সংকটময় মুহুর্তে নিজে আবির্ভূত হয়েছেন স্বমহিমায়। নিজের সৃষ্টিকর্ম দিয়ে দেশকে সব সময় কিছু দেয়ার চিন্তা করেছেন এ গুণী। কোনো কিছুর বিনিময় তিনি কখনো আশা করেননি।


শাহ আব্দুল করিমের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫৪’র নির্বাচন ৬৯এর গণ আন্দোলন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি পর্যায়ে স্বরচিত গণসঙ্গীত পরিবেশন করে জনতাকে দেশ মাতৃকার টানে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন।


তাঁর গণসঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে মাওলানা আব্দুল হামিদ থান ভাসানী তাঁর পিটে হাত রেখে বলেছিলেন, ''বেটা, গানের একাগ্রতা ছাড়িও না, তুমি একদিন গণমানুষের শিল্পী হবে।''


হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গণসঙ্গীত শুনে একশ পঁচাশি টাকা দেন, শেখ মুজিবুর রহমান ১১ টাকা দিয়ে বলেন, ''তোমার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হবে।''


দেশের জন্য শাহ আব্দুল করিম যেমনি ছিলেন উদার, দেশও তার প্রতিদান দিতে চেষ্টা করেছে। অসংখ্য পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন এ গুণী বাউল সম্রাট। ২০০১ সালে সরকার শাহ আব্দুল করিমকে ’একুশে পদক’ প্রদান করে। এছাড়া মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, রাগিব-রাবেয়া সাহিত্য পদক, সিলেট সিটি কর্পোরেশন নাগরিক সংবর্ধনা, নিউয়র্ক হাসন রাজা লোক উৎসব সম্মাননা সহ অসংখ্য পদক ও সম্মননার তালিকা রয়েছে এ গুণী শিল্পীর।


বাউল গানের জন্য দেশে এখন পর্যন্ত কোনো উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। শাহ আব্দুল করিম বাউল একাডেমী প্রতিষ্টা করা এখন দিরাইবাসী তথা সাড়াদেশের বাউল ভক্তদের প্রাণের দাবি। শাহ আব্দুল করিমের শেষ ইচ্ছা ছিল- করিম একাডেমী প্রতিষ্টা করা। তিনি মরে গেলে যেন দেশের করিম ভক্তরা তথা বাউল মনা মানুষগুলো বাউল গানের চর্চা করতে পারে এ প্রতিষ্টান থেকে। সে লক্ষ্যে নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় কাজ শুরুও করেছিলেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি। বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিরা বাউল আব্দুল করিম একাডেমী প্রতিষ্টার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।


শাহ আব্দুল করিম ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ বাউল। তিনি নিজের জন্য কিছুই করেননি। এমনকি ভাবেনওনি। তাই তিনি তাঁর বিরাট সৃষ্টিকর্ম প্রায় দেড় হাজার গান মানুষের জন্য রেখে গেছেন। নিজ উদ্যোগে সেই গানের বই প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে বাজারে রয়েছে তাঁর কয়েকটি বই।


তাঁর প্রথম বই আফতাব সঙ্গীত, তাঁর সহধর্মীনির নামে বইটির নাম। এরপর প্রকাশিত হয়েছে গণসঙ্গীত, ধল মেলা, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে। সর্বশেষ ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্র। এছাড়া বাংলা একাডেমী তাঁর ১০টি গান ইংরেজিতে অনুবাদ বের করেছে।


শাহ আব্দুল করিম একজন আধুনিক বাউল। তার গানের কথা ও সুরে এর পরিচয় পাওয়া যায়। শাহ আব্দুল করিমের গান সকল মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়। বাউল সমাজের কাছে তার গান যেমনি জনপ্রিয় নতুন প্রজন্মের কাছে তা আরো বেশি জনপ্রিয়। শাহ আব্দুল করিম তার গানের মাঝে বেছে থাকবেন আমাদের কাছে আজন্ম।


কিন্তু শাহ আব্দুল করিমের শেষ স্বপ্ন পুরণে আমরা কি কিছুই করতে পারি না? আসুন, আমরা সবাই মিলে উদ্যোগ নেই শাহ আব্দুল করিম বাউল একাডেমী প্রতিষ্টার জন্য।


লেখক: সাংবাদিক ও উন্নয়ণকর্মী।


বিবার্তা/কামরুল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com