পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মহাকাব্যের নাম মহাভারত। আর মহাভারতের প্রধান নারী চরিত্র দ্রৌপদী। তিনি ছিলেন পাঞ্চালের রাজকুমারী, পরবর্তীতে পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী। দ্রৌপদীর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন অহংকারী চরিত্রের নারী। স্বয়ম্বর সভায় আমন্ত্রিত অতিথি হওয়ার পরও কর্ণকে তিনি ধনুক উত্তোলন করতে দেননি কারণ সূতপুত্রে বিবাহে তার আপত্তি ছিল। দুর্যোধনকে তিনি অন্ধের পুত্র অন্ধ বলে অপমান করেছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভায়। যার সরাসরি প্রতিক্রিয়ায় দুর্যোধন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
মহাভারতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। যার ফলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়েছিল। সে যুদ্ধে দুর্যোধনেরা ১০০ ভাই মৃত্যুবরণ করেন। বস্ত্রহরণকারী দুঃশাসনের বক্ষ চিরে রক্ত পান করেন দ্রৌপদীর স্বামী ভীম আর দ্রৌপদী সে রক্ত দ্বারা তার চুল ধুয়ে নেন। তো এত কথা বলার অর্থ হচ্ছে, দ্রৌপদী ব্যক্তি হিসেবে যেমনই হন, তার কৃতকর্ম যতই ক্রোধ জাগানিয়া হোক; তা কখনোই বস্ত্রহরণের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডকে জাস্টিফায়েড করে না। যুগে যুগে কর্ণ-দুর্যোধনের জন্য অনেক মানুষ সহানুভূতি বোধ করেছেন কিন্তু আমার জানামতে কেউই সম্ভবত বস্ত্রহরণের ঘটনাকে জাস্টিফায়েড করার চেষ্টা করেননি। সব অপরাধকে আসলে এক দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায় না। কিছু অপরাধের ভার বসুমতীর জন্য অসহনীয়।
নারীর অসম্মান, নারীর বস্ত্রহরণ তেমনই একটি অপরাধ। এই অপরাধটাই করা হয়েছে কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ইফফাত জাহান এশার সাথে।
নিজের দলেরই আরেক কর্মীর রগ কাটার গুজবের ওপর ভিত্তি করে তাকে জুতার মালা গলায় পরিয়ে গ্রাম্য অশিক্ষিত পঞ্চায়েতের স্টাইলে অপমান-অপদস্থ করা হয়েছে ১১ এপ্রিল মধ্যরাতে। তার জামাকাপড় টেনে ছিড়ে নেয়া হয়েছে পুরুষের উপস্থিতিতে। আরো যা ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটেছে, এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করা হয়েছে। আর আমরা সবাই জানি নারীসংশ্লিষ্ট বিষয় ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে কী ধরণের প্রতিক্রিয়া আসে। সে নারীর চরিত্রহনন করা হয়, তাকে ভাষায় প্রকাশ করার অযোগ্য সব ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। তার নামে ফেইক আইডি খুলে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়।
কবি সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগের সভাপতিও এই তথ্য দ্বারা যৌণসন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ ফেসবুকার থেকে শুরু করে অনেক বোদ্ধা-বুদ্ধিজীবীদেরকেও দেখছি এশার ওপর নির্যাতনকে জায়েজ করার চেষ্টা করছেন। কারণ তিনি ‘অপরাধী’। ফলে তাকে আমজনতা নির্যাতন করতে পারে এটাই তাদের স্পষ্ট বক্তব্য।
যদিও যার পায়ের রগ কাটার অভিযোগ উঠেছে সেই মোর্শেদা পরে ভিডিওতে বলেছেন তিনি নিজেই জানালার কাঁচে লাথি মেরে পা কেটেছেন, তারপরও আমি তর্কের খাতিরে মেনে নিচ্ছি এশা আসলেই অপরাধী। কিন্ত সভ্য সমাজে অপরাধীরও তো মানবাধিকার থাকে। আজকে যদি সরকার বলে, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আইন-আদালতের মাধ্যমে বিচার না করে জনতার হাতে ছেড়ে দেয়া হবে গণপিটুনি দেওয়ার জন্য, আপনারা কি সেটা মেনে নেবেন? শুধু জামায়াত-শিবির কেন, বামরাও সম্ভবত মানবাধিকারের ধুয়া তুলে বিষয়টা মানবে না।
আবার আছেন নারীবাদীরা। তারা ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেন, ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তনের দাবি জানালে একে বর্বরতা বলেন। কিন্তু এশাকে মধ্যযুগীয় কায়দায় অপমান-অপদস্থ করা হলে তাদের মনে কোনো সহানুভূতি জাগে না। এশা ছাত্রলীগ করে বলে কি সে নারী নয়? শিশু ধর্ষণকারীর মানবাধিকার থাকতে পারে, তাহলে এশার থাকতে পারবে না কেন?
এক্ষেত্রে আরেক দল প্রশ্ন করে, সাধারণ মেয়েদের ওপর হামলা হলে তো আপনাদের দরদ দেখা যায় না, শুধু ছাত্রলীগের মেয়ে বলেই এত দরদ। কিন্তু প্রশ্নটা তো উল্টোভাবেও করা যায়। শুধু জেনারেল মেয়ের শ্লীলতাহানি হলেই সেটা অন্যায়? ছাত্রলীগের মেয়েদের শ্লীলতাহানি করলে তা অন্যায় হয় না?
উপসংহারটা খুব সহজ, সব বিবেকবান নারী-পুরুষের উচিত দল-মত-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নারীকে বিবস্ত্র করার মতো ঘৃণ্য অপরাধকে ঘৃণার চোখেই দেখা। এক্ষেত্রে ভেদাভেদ করার কোনো সুযোগ নেই। আরো সুযোগ নেই ‘প্রেক্ষাপট’ বিবেচনা করে এই ঘটনাকে জায়েজ করার চেষ্টা করারও। যারা তা করবে, তারা আসলে ‘কাপড়ের দোষে নারী ধর্ষিত হয়’ ঘরানার মানুষ। অনেকে আবার মব জাস্টিসের মতো কঠিন কঠিন টার্ম ব্যবহার করছেন। আমি মব জাস্টিসের প্রতিশব্দটা বলি - জাংগাল জাস্টিস। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? তারা দাবি করে যে তাদের প্রত্যাশা সভ্য সমাজ গড়ে তোলা। কিন্তু অপছন্দের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে তারা জংগলের আইনে বিশ্বাসী।
তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় এশা ছাত্রলীগে তার হারানো পদ ফিরে পেয়েছে, সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের হারানো ছাত্রত্বও ফিরে পেতে যাচ্ছে। কিন্তু সমাজে তার ও তার পরিবারের যে সম্মানহানি হলো এর কি কোনো ক্ষতিপূরণ আছে? নেই। শুধু এতটুকুই আশা করবো, সব গুজবকে পাশ কাটিয়ে এশাকে বিবস্ত্রকারীদের পরিচয় সামনে আসবে এবং তাদের যথোপযুক্ত শাস্তি হবে।
মনে রাখতে হবে, নারীর শ্লীলতাহানির অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। তা সে মহাভারতের যুগেই হোক অথবা একুশ শতকের বাংলাদেশে।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিবার্তা/কাফী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]