শিরোনাম
হত্যাগুলোর বিচার হওয়া দরকার
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০১৮, ১৭:০৬
হত্যাগুলোর বিচার হওয়া দরকার
কবীর চৌধুরী তন্ময়
প্রিন্ট অ-অ+

শিরোনাম দেখে অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, কোন হত্যার বিচার হওয়া দরকার? আমি বলব, সব হত্যার বিচার হওয়ার দরকার। কারণ একটি হত্যাকাণ্ড বিচারের মুখোমুখি না-হলে হত্যার প্রবণতাটি সমাজ-রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। বিলম্বিত বিচারকাজের কারণে একদিকে হত্যার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তির মাঝে অনুতাপ-অনুশোচনাবোধহীন ঔদ্ধত্য সৃষ্টি হয়। আর অন্যদিকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত আলামত (গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট) নষ্ট হয়ে পড়ে, যা ওই বিচারকাজকে আরও কঠিন করে তোলে ।


দীর্ঘ ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও বিচারের মুখোমুখি হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ূন আজাদের খুনীরা। এটি রাষ্ট্রের জন্য সত্যিই লজ্জার, হতাশার। রাষ্ট্রের অনেকগুলো শক্তিশালী দফতর থাকলেও তারা আজও হুমায়ূন আজাদের খুনীদের ধরতে পারেনি। আবার ধরলেও শক্ত হাতের অভাবে পালিয়ে যায় খুনী চক্রের সদস্যরা! এই যে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত থেকে ২০১৪ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি খুনী চক্রের সদস্য মিনহাজ ও সালেহীনকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাদের অনুসারীরা, তার জবাব কী রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিরা দিয়েছিল? তাঁরা কি এই অবহেলার দায় স্বীকার করেছে বা রাষ্ট্রযন্ত্রের দূর্বল হাত মেরামত করেছে? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।


অভিযোগ আছে, যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে; সে সরিষার মধ্যেই ভূতের বসবাস। অর্থাৎ রাষ্ট্রের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আজ অবাধে বিচরণ করছে। তাদেরকে রাজনৈতিক স্বার্থে, ব্যবসায়িক স্বার্থে, ব্যক্তিস্বার্থে যে যার মতন করে ব্যবহার করছে। আবার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়সহ পারিবারিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত করেছে, এখনও করছে।


সাম্প্রতিক পাঠ্যপুস্তকে হুমায়ুন আজাদের কবিতা পরিবর্তনের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে অনেক প্রমাণ খুঁজে পাবেন। কারা সেখানে সম্পৃক্ত তা খুজে বের করা সরকার বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর এই কারণেই সহজ-সরলভাবে প্রশ্ন আসে, সরকার কী এ ব্যাপারে আন্তরিক?


সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের মুল উৎপাটন করতে সরকারের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি কোনো পরিকল্পনা আছে কী না আমার জানা নেই। তেমন কোনো পদক্ষেপও চোখে পড়েনি। বরং একের পর এক সরকারের দায়িত্ববান ব্যক্তিবর্গ কখনও ব্লগার-লেখকদের সীমা লঙ্ঘন না করার হাস্যকর পরামর্শ প্রদান করেছেন। আবার কখনও অতীত ইতিহাস বা বিশ্ব ইতিহাস টেনে এই ধরনের হত্যাকান্ডের প্রতি এক ধরনের মৌন সমর্থন দিয়েছেন।


ঘটনাটি ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির। বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে টিএসসির দিকে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীদের চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ূন আজাদ। কয়েক মাস চিকিৎসা নেয়ার পর ওই বছর অগস্টে গবেষণার জন্য জার্মানি যান এই লেখক। পরে ১২ অগস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।


রাষ্ট্র তখন হুমায়ূন আজাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গুরুত্বের সাথে নিতে ব্যর্থ হয়নি বরং আমি বলব, অবহেলা করেছে অথবা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। যে অবহেলা বা গুরুত্বহীনতার কারণে এ ধরনের হত্যার অপসংস্কৃতি আজও বিদ্যমান। আর তার শিকার হয়েছেন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়। তিনিও ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফুটপাতে সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপে রক্তাক্ত হন তিনি। সাথে থাকা তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদের মাথায় ও ঘাড়ে চারটি চাপাতির আঘাত এবং বা হাতের বৃদ্ধাঙুল খসে পড়ে উন্মুক্ত ফুটপাতে। ওই রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান অভিজিৎ রায়।


এখানে একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন, আগস্ট মাসকে ঘিরে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে। আর ফেব্রুয়ারি মাসকে ঘিরে দেশের বুদ্ধিজীবী-লেখকদের হত্যার ষড়যন্ত্রের নীল নকশা তৈরি করে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে নেতৃত্বশূণ্য বাংলাদেশ করতে চেয়েছিল। আর অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে দেশের সুর্যসন্তানদের হত্যার মাধ্যমে মেধাশূণ্য জাতিতে রূপান্তরিত করার ষড়যন্ত্র করে সন্ত্রাসীরা।


রাষ্ট্র অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ হত্যাকান্ডকে গুরুত্ব দিলে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে একই কায়দায় খুন করে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করার সুযোগ পেত না সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। শুধু তাই নয়, হুমায়ূন আজাদ হত্যাকান্ডের পরের এই ১২ বছরের মধ্যে হত্যার নীল নকশা পরিবর্তন করে-করে হত্যার অপসংস্কৃতি অব্যাহতও থাকত না।


২০১৩ সালে রাজীব হায়দার খুনের পর থেকে টাঙ্গাইলে হিন্দু দর্জি নিখিল জোয়ার্দার হত্যাকান্ড পর্যন্ত ৩৭টি হামলার মধ্যে ২৫টি জেএমবি, আটটি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও চারটি ঘটনা অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠী ঘটিয়েছে। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি), আনসার আল-ইসলাম, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হরকাতুল জিহাদ-আল-ইসলাম (হুজি-বি), হিজবুত তাহরীর বাংলাদেশ এবং নতুন আবির্ভূত আল মুজাহিদ সংগঠনগুলো এসব হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত। এসব হামলা ও হত্যাকান্ডের মধ্যে ৩৪টিরই মূল রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্রযন্ত্রের সাবেক পুলিশপ্রধান। এর মধ্যে মাত্র ৬টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।


হুমায়ুন আজাদের ওপর জঙ্গিদের চাপাতি হামলার পর রাজীব হায়দারকে চাপাতির আঘাতে খুন করা হয়। মুক্তমনা নামে ব্লসাইটের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ও একই কায়দায় সস্ত্রীক চাপাতির আঘাতে প্রাণ হারান। তাঁর স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদও মারাত্মক আহত হন। অভিজিৎ রায়কে হত্যার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যেব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয় ১২ মে। ঠিক তার তিন মাসের মাথায় ৭ আগস্ট রাজধানীর একটি বাড়িতে ঢুকে হত্যা করা হয় ব্লগার নিলয়কে। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল সমকামী মানবাধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান এবং তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয়কে ঢাকার কলাবাগানের এক বাসায় কুপিয়ে হত্যা করে অপশক্তি। আর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সিলেটের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। অন্যদিকে ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।


এখানে হত্যাকান্ডগুলোর মুল উদ্দেশ্য হল- মুক্ত, সহনশীল, স্থিতিশীল ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পরিচয় মুছে দেওয়া। তাই ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ, ধর্মীয় পুরোহিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, ভিন্নমতের ইসলামী ভাবধারার অনুসারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও বিদেশিদের ওপর একের পর এক এই ধরনের বর্বর হামলা অব্যাহত রেখেছিল। এই ধরনের হত্যাকান্ড কমিয়ে আনা বা নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের এক বিশাল সাফল্য হলেও জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টার হামলার ঘটনার মাধ্যমে এখনও অব্যাহত রয়েছে বলে প্রতীয়মান।
জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থানের কারণে লেখক জাফর ইকবালকে ২০১৬ সাল থেকেই সরকারের নির্দেশনায় পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। অথচ পুলিশের সামনেই এই শিক্ষকের মাথা, পিঠ ও হাতে জখম করে জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী ফয়জুল নামের ওই ঘাতক।


এখানে একেবারেই স্পষ্ট, ঘাতক ফয়জুল একা নয়, তার নেপথ্যে আরও অনেকে পরিকল্পনা করেছে। ফয়জুলকে মাঠে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। ফয়জুল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়েও ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে ঠিক জাফর ইকবালের পিছনেই দাঁড়িয়ে সুযোগ বুঝে পুলিশের সামনেই হত্যাচেষ্টা করা; এটি পূর্ব পরিকল্পনার অংশ।


একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন, জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী ফয়জুল অন্য শিক্ষার্থীদের মতই জাফর ইকবালের খুব কাছাকাছি ছিল। পুলিশ ও জনতাকে পর্যন্ত ভয় পায়নি। কারণ তাকে ভয় না পাওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। আগের হত্যাগুলোর বিচারহীনতার ঔদ্ধত্য জাফর ইকবালের উপর হত্যাচেষ্টার হামলা ঘটাতে সহায়তা করেছে।


এখানে ব্যক্তি জাফর ইকবাল রক্তাক্ত হননি, রক্তাক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। তিনি শঙ্কামুক্ত অবস্থায় ক্যাম্পাসে ফিরেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ তো শঙ্কামুক্ত নয়। লাখো-কোটি মানুষের ভালোবাসায় এ যাত্রায় জাফর ইকবাল আমাদের মাঝে সুস্থ হয়ে ফিরে আসলেও বাংলাদেশ কী ফিরে আসতে পারবে? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হতে পারবে?



অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের প্রাক্তন শিক্ষক অজয় রায়ের মত আমিও আশাবাদী, সকল অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করবে সরকার। এটা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব পালনে সর্বপ্রথম সরকারের ভিতরের মৌলবাদীদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। অপশক্তির ডাল-পালা ধ্বংস করতে হবে।


শেখ হাসিনার প্রতি এ জাতি আস্থাশীল। কারণ জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিচারহীনতার ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’-এর কালো ছোবল থেকে তিঁনি শুধু জাতিকেই রক্ষা করেননি; জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করেছেন। জাতির কলঙ্ক রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন করেছেন। এমনি করে এই ধরনের হত্যাগুলোরও বিচার করা দরকার। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে আইনের শাসন সুনিশ্চিত করা এবং অপরাধপ্রবণতা রোধ করার লক্ষে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি।


লেখক : সভাপতি, বাঙলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com