শিরোনাম
শিক্ষা, মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০১৮, ১৯:০৬
শিক্ষা, মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ
সেলিম এইচ তালুকদার
প্রিন্ট অ-অ+

শিক্ষা একটি জাতির শিরদাঁড়া ওরফে চালিকাশক্তি। সঙ্গত কারণেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মনুষ্যত্বকে সকল রাহুগ্রাস ও পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করে বসুধার পরিমল বায়ূ সেবনে বৈতরণীর ভূমিকায় সমাসীন শিক্ষা । বস্তুত শিক্ষাই পারে মানুষের ভেতর সুপ্ত গুণাবলীর স্ফূরণ ঘটিয়ে নিখাদ সোনার মানুষ হিসেবে পরিগণিত করতে।


প্রয়াত শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসেন চৌধুরী বিষয়টিকে ব্যক্ত করেছেন এভাবে - ''মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জীবসত্তা নিচতলা আর মানবসত্তা তার উপরতলা। জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে উন্নীত হবার মই হলো শিক্ষা।”


শিক্ষাই আমাদের মানবসত্ত্বার ঘরে নিয়ে যেতে পারে। শিক্ষা জীবসত্তা তথা ক্ষুৎপিপাসাও দূরীভূত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে - এ প্রত্যাশা সিংহভাগ মানুষের। তবে অর্থচিন্তাই যেখানে মূখ্যত অগ্রজপ্রতিম সেখানে অনুজ মানবসত্ত্বা নিয়ত পশ্চাদ্ধাবন খেয়ে ভড়কে যায় ঘোর কালো অমানিশায়। আর এটি হৃদয়ঙ্গম করে মোতাহার হোসেন চৌধুরীর উচ্চকিত প্রত্যয় - ''অর্থচিন্তার নিগড়ে সকল মানুষ বন্দি ....... অর্থ সাধনাই জীবনসাধনা নয়”। অন্ন-বস্ত্রের প্রাচুর্যের চেয়েও মুক্তি বড় - এই বোধটি মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ শিক্ষালাভ করেছে সুপরিসর, সুবিস্তৃত বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডল থেকে। সমগ্র বিশ^ই যেখানে পান্থশালা, আকাশ তার সীমানা। বস্তুত সুনির্মল বসু এ বিষয়টিকে স্তবকাবদ্ধ করেছেন এভাবে -


“বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর


সবার আমি ছাত্র।


নানান ভাবে নতুন জিনিস


শিখছি দিবারাত্র।”


আলোকিত, প্রত্যয়ী, নির্লোভ ও নিঃস্বার্থ মানুষ সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই সাংখ্যিক পরিমাপে অপ্রতুল হলেও বিশ্বের বুকে সংহতি প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা ঢের বেশি বললেও কম বলা হয়। সততই যে শিক্ষা মানুষের মূল্যবোধকে জাগরিত করতে ব্যর্থ হয় তা আর যা-ই হোক শিক্ষা তো নয়ই। প্রমথ চৌধুরী বলেন, ''শিক্ষার আসল কাজ মূল্যবোধ সৃষ্টি, জ্ঞান পরিবেশন নয়।”


সভ্যতার উৎকর্ষের সাথে সাথে মানুষের মাঝে শিক্ষার সর্বব্যাপিতা বৃদ্ধি প্রায় বহুলাংশে। তার অনুসন্ধিৎসু মন শিক্ষার আলোয় হয়ে ওঠে সদা জাগরুক, উদ্ভাসিত; উন্মেষ ঘটে শিক্ষার প্রতিষ্ঠানিকীকরনের। দ্বিধাহীনচিত্তে সবরকম ভণিতাকে পাশ কাটিয়ে একথা ব্যক্ত করা যায় যে, শিক্ষা একটি কাঠামোবদ্ধ রূপ পায়। তদুপরি শিক্ষা-শিখনফল যাচাইয়ের মাধ্যম হয়ে ওঠে পরীক্ষা। ফলে শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠতে থাকে পরীক্ষার্থী! সহসাই শিক্ষা নামক অমৃতে অরুচি ধরে।


তাই বলে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও পরীক্ষার উপযোগিতা স্বীকারে কুন্ঠিত হওয়া প্রকৃত প্রস্তাবে সত্য প্রকাশে কুন্ঠাবোধ ও নির্জলা মিথ্যাকে শুদ্ধাচারে রূপ দেয়ার অপপ্রয়াস ভিন্ন কিছু নয়। বিশ্বচরাচরে বহু মহামানব ও হিতৈষীজন উপহার দিয়েছে শিক্ষালয়গুলো। ফলে কাজী কাদের নেওয়াজের মতো ''শিক্ষাগুরুর মর্যাদা”ও অনুধাবন করা সহজ থেকে সহজতর হয়েছে।


এক্ষণে আমি যে প্রসঙ্গটি চর্বিত চর্বণ করতে চাই তার সারাংশ হলো - শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষান্তে সনদপ্রাপ্তিই একজন মানুষের শিক্ষিত, আলোকিত ও জ্ঞানবান হওয়ার বিধায়ক সাব্যস্ত হওয়া শুধু অস্বস্তিকর ও অমূলকই নয় বরং প্রমথ চৌধুরীর মতে সুশিক্ষিত লোকমাত্রই স্বশিক্ষিত। আর সদ্যপ্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক স্বেচ্ছায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করলে তার অগ্রজতুল্য মরহুম ফজলে লোহানী বলেছিলেন - ''মনে রাখবে বিশ্বই তোমার বিশ্ববিদ্যালয়”। তাছাড়া উগ্র জাত্যাভিমান, জাতিবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, কলুষতা, নারীবিদ্বেষ ,সমস্ত অশ্লীলতা ও পঙ্কিলতা থেকে মোক্ষলাভই প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরিচায়ক সাব্যস্ত হওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক।


আর এও ধ্রুব সত্য যে, এসব কুটিল নিয়ামক থেকে আশু নির্বাণ লাভ কঠিন তবে অসম্ভব নয়। তাই তো বলা হয়েছে, ''তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় মানুষ”। অর্থাৎ প্রাণ থাকলেই প্রাণী হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হওয়া যায় না।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তার পুত্রের স্কুলশিক্ষককে চিঠি লিখেছিলেন, ''আমার ছেলে যেন প্রকৃত মানুষ হয়।''


বিশ্বশ্রেষ্ঠ মনীষী সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো, সফোক্লিস, হোমার কিংবা শেক্সপিয়র থেকে নিয়ে আমাদের নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ও বেগম রোকেয়াদের শিক্ষালয়ের ফিরিস্তি নাতিদীর্ঘ হলেও মানুষ তাদের স্মরে অপার শ্রদ্ধায় । কারণ, তারা শিক্ষার মূলমন্ত্রটি রপ্ত করতে পেরেছিলেন বেশ ভালোভাবেই। ধন্যবাদার্হ এই পরমব্রত মানুষগুলোই আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে মানুষ হতে হয়; হতে হয় শিক্ষিত। এঁরাই আমাদের প্রদোষে প্রাকৃতজন। এই মানুষগুলোর অনুপস্থিতিরাধিক্য হলে সুবচন নির্বাসনে চলে যায়; সুবোধ যায় পালিয়ে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও ছাত্রদের এসাইনমেন্ট নকল করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়া কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও শুধু একটি ক্যালকুলেটরের জন্য পিটিয়ে সহপাঠীর কর্নিয়া নষ্ট করে দেয়া কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেও অনৈতিক কাছে লিপ্ত হওয়ায় স্ত্রী কর্তৃক ধৃত হওয়া অথবা প্রতিষ্ঠাপ্রধান হয়েও দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির দায়ে নিন্দার ঝড় ওঠার মতো অস্বাভাবিক ও অনভিপ্রেত ঘটনাগুলো অন্যান্য কাগজে খবরের ন্যায় জ্ঞান হয়। এ জন্যই কবি হুমায়ুন আজাদ উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন ''সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে'' বলে।


তবে আমরা নৈরাশ্যবাদী নই। আমরা বিশ্বাস করি, আলো আসবেই।


সবশেষে বলতে চাই, শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, স্কুলও কোনো দোকান নয়। আগামী প্রজন্ম হবে আরও সুশিক্ষিত, মূল্যবোধে উজ্জীবিত ও মার্জিত। সকল অমাণিশার নাগপাশ ছিন্ন করে তারা হয়ে উঠবে শিক্ষিত মানবসত্তা। তাই মনুষ্যত্বের আলোয় দেখি বিশ্ব। আর যেখানেই অসাম্য, অসত্য, অশিক্ষা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় সেখানেই মনুষ্যলোকের মানসপটে উচ্চকিত প্রত্যয়ে ব্যঞ্জনাময় হবে -


“এসো ভাঙ্গনকে ভাঙ্গি, সৃষ্টিকে গড়ি,


সুন্দরের কানে কানে বলি, এ দ্রোহ আমার।''


লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com