শিরোনাম
৭ মার্চের ভাষণ এবং বোধহীন অবুঝদের কিছু প্রাসঙ্গিক জবাব
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০১৮, ১৬:৩২
৭ মার্চের ভাষণ এবং বোধহীন অবুঝদের কিছু প্রাসঙ্গিক জবাব
হায়দার মোহাম্মাদ জিতু
প্রিন্ট অ-অ+

তাত্ত্বিক ‘ফ্রাঞ্জ ফ্যানোর’ “জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত” গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লেখিত, ‘অধিকার আদায়ে সহিংসতা আবশ্যক। আর এর একমাত্র পথ নির্যাতিতের স্বতঃস্ফূর্ততা’। আর এই স্বতঃস্ফূর্তটা আসে নির্যাতিতের নির্মোহ অংশগ্রহণ এবং সর্বোচ্চ ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা থেকে’।


সে হিসেবে এই প্রক্রিয়ায় সাফল্য আসবে তখনই ‘যখন একটি যোগ্য নেতৃত্বের বলে নির্যাতিতরা বুঝবেন আঘাতের উৎকৃষ্ট সময়কে’। কারণ, ইতিহাস সাক্ষী, একমাত্র ‘সময়ের’ যথার্থতা না বোঝায় হাজারো বিজয় পরাজয়ে এবং হাজারো পরাজয় জয়ে রুপান্তরিত হয়েছে।


সূত্রমতে বাঙ্গালীও ঠিক সেরকম একটি মাহেন্দ্রক্ষণ খুঁজছিল যখন পাকিস্তানীদের দুর্গে তারা চরম আঘাত হানবে। আর তার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”।


আমরা জানি সংস্কৃত নাট্যের ‘সূত্রধর’ চরিত্র নাটকের গল্প সম্পর্কিত আবহে প্রবেশে দর্শককে নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু ঠিক তেমনিভাবে বাংলার স্বাধীনতার আখ্যান অর্জনে সূত্রধর হিসেবে আবির্ভূত। যেখানে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামনে থেকে এবং তাঁর সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ছিল তাঁর নেতৃত্বের ঐতিহাসিক দলিল।


তবে পঞ্জিকায় থাকা ৭১’এর মার্চ এর একটা আলাদা গূঢ়ার্থ আছে। কারণ, এ মাসেই তারা পেয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধুর’ সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ‘প্রেম-দ্রোহ-স্পর্ধার’ ঝাঁঝালো সুর। যেখানে প্রতিধ্বনিত ছিল মুক্তির ইস্পাত প্রতিজ্ঞা।


নিন্দুকেরা আজও বঙ্গবন্ধুর দেয়া সেই ৭ মার্চ ভাষণের মূলমন্ত্র খুঁজতে খাবি খান। এটাতে তাদেরও খুব একটা দোষ দেখি না। কারণ, ওই উচ্চতায় ভাববার মত যোগ্য জনম এখনও তাদের হয়নি। তবে মোটা দাগে বললে সেই ভাষণে ছিল,


আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চরম মুহূর্তেও সংগঠিত থাকার আহ্বান এবং নেতৃত্বের মাঠে একজনও না থাকার পরও সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা।


৪৭’এ ভারতবর্ষ বিভক্তের পর দীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা বাঙ্গালীর হৃদয় মানচিত্রে যে গহীন ক্ষত তৈরি করেছিল তারই জবাব ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ বিজয়। আর এই বিজয়ের পাদপ্রদীপে নোঙ্গর করতে দিনপঞ্জিকার প্রতিটি মাসকেই সাজাতে হয়েছিল চরম বিসর্জনে।



এককথায়, একটি জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটানোর জন্যে যা যা প্রয়োজন ছিল তার সকল দিক নির্দেশনাই ছিল সেই ভাষণে। যার শেষটা আরো সুস্পষ্ট হয়, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” ধ্বনিত করার মাধ্যমে।


তবে সেদিনের সেই ভাষণে ‘ভাষার’ ব্যবহারে ‘বঙ্গবন্ধুর’ মুন্সিয়ানার কথা বলতেই হয়। ভাষা বিজ্ঞানীকে থেকে শুরু করে ভাষার চর্চাকারী সকলে আজ স্বীকার করেন, সেদিন শব্দ চয়ন এবং শব্দের দ্যোতনায় ‘তিনি’ প্রকম্পিত করেছিলেন জনমানবের ‘হৃদয় স্টেশন’।


সেদিনের সেই ভাষণে তিনি “কলকাতা-নদীয়া অঞ্চলের বাংলা কিংবা প্রমিত ঘরানার শব্দ এবং বাচন ভঙ্গিকে” ঝেড়ে ঝংকার তুলেছিলেন ‘মেহনতি’ মানুষের মুখ নিঃসৃত শব্দ যোগাযোগকে। যা তৎক্ষনাৎ সম্মোহিত করেছিল জনমানুষকে। তারা খুঁজে পেয়েছিল এমন একজন নেতাকে যিনি “তাদের ভাষায় কথা বলেন, তাদের মত করে তাদের কথা চিন্তা করেন”।


তবে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই সফল জমায়েতের গতিপথ প্রসঙ্গে সাংবাদিক 'অ্যান্থনি মাসকারেণহাস' কিছুটা উল্টো সুরে যোগ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা তাঁর “দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ” গ্রন্থে তিনি মত প্রকাশ করেন, ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে বিপুল জনসমুদ্র হয়েছিল তাতে তিনি চাইলেই তাঁর এক তর্জনী ইশারায় ক্যান্টনমেন্ট দখল নিতে পারতেন। তাঁর এই উক্তির পক্ষে পোক্ত যুক্তিও ছিল। কারণ প্রকৃতই,


তৎকালীন সময়ে দেশের সার্বিক অবস্থা যা ছিল তাতে দেশের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু চাইলেই তাঁর এক ‘তর্জনী’ ইশারায় বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েও বাঙ্গালী হাসিমুখে সব করতে প্রস্তুত ছিল।


অন্যদিকে পূর্ব-বাংলায় সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানের ওই জনসমুদ্রকে সামাল দেবার কোনো সক্ষমতাই ছিল না।


অর্থাৎ, 'অ্যান্থনি’ প্রদত্ত চিন্তার ফলাফল হল, এতে একদিকে “বাংলার” স্বাধীনতা অর্জন হত তড়িৎ গতিতে অন্যদিকে বিসর্জনের পরিমাণও হত স্বল্প। ‘বাংলা ও বাঙ্গালীর’ প্রতি ‘অ্যান্থনি মাসকারেণহাসের’ আবেগকে আমরা সম্মান করি।


তবে প্রকৃত বাস্তবতা হল, সেদিন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙ্গালী যদি ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে বসত তখন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বিশ্ব দরবারে ‘বাঙ্গালীকে’ প্রতিষ্ঠিত করত ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী’ হিসেবে এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ বনে যেতেন সেই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর একজন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা’।


আর তাছাড়া যেহেতু রাষ্ট্রীয় দখল ছিল তাদের সে হিসেবে বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রোপাগান্ডা চালাতেও তাদের খুব একটা বেগ পেতে হত না। অর্থাৎ, তারা একদিকে প্রচার করত পাকিস্তান রাষ্ট্র ‘বাঙ্গালী নামক একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী’ দ্বারা আক্রান্ত’ হয়েছে। অন্যদিকে চালাত আমাদের বিরুদ্ধে নিধন অভিযান। আর তখন আমাদের অবস্থা হত এখনকার বিশ্বের অন্য আট-দশটা ব্যর্থ স্বাধীনতাকামী জাতির মতন।


বুদ্ধিজীবীরা কলমের খোঁচায় বুদ্ধির ঢেউ কিংবা নির্দেশনা দিয়েই খালাস হন। কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতাকে মাঠ-ঘাটের প্রতিকূলতা বুঝে যথার্থ ‘সময়টা’ খুঁজতে এবং বুঝতে হয়। যা তাত্ত্বিক ‘ফ্রাঞ্জ ফ্যানোও’ বলেছেন।


তাছাড়া স্বতঃস্ফূর্ততার কিছু চোরা ফাঁদও রয়েছে। যেখানে পরে হাজারো স্বাধীনতাকামী জাতির স্বপ্নকে মুখ থুবড়ে নষ্ট হয়েছে। বাঙ্গালী জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেই চোরা ফাঁদ ডিঙ্গিয়ে স্বাধীনতার স্পর্ধাকে বুকে নিয়েছে।


জীবদ্দশায় ‘অ্যান্থনি’ তাঁর সীমানা থেকে খুব একটা দূরে দেখেননি। দেখলে অবশ্যই ৭ মার্চ তাঁর ক্যান্টনমেন্ট দখলের চিন্তা শুধরে ‘বঙ্গবন্ধুকে’ সাধুবাদ জানাতেন। আর বলতেন, রাজনৈতিক, দার্শনিক এবং চিন্তক হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু’-ই সফল।


কারণ, বিংশ শতকে থেকেও একবিংশ শতকের চিন্তাকে তিনি ছুঁতে পেরেছিলেন। যার কারণেই ‘বাংলা এবং বাঙ্গালী’ আজ কোন বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং আগামীর দুয়ারে দাঁড়ানো এক সম্ভাবনাময় নক্ষত্র রাষ্ট্র।


লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com