শিরোনাম
বদলে যাচ্ছে গ্রাম, হারিয়ে যাচ্ছে হাট
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:৪৬
বদলে যাচ্ছে গ্রাম, হারিয়ে যাচ্ছে হাট
মুস্তফা নঈম
প্রিন্ট অ-অ+

বদলে যাচ্ছে গ্রাম, এগিয়ে যাচ্ছে গ্রাম, কিন্তু ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার বছরের গ্রামীণ সংস্কৃতির অনেক কিছুই। এখন যাদের বয়স চল্লিশ কিংবা এর চাইতে একটু বেশি, যাদের জন্ম ও বেড়ে উঠা গ্রামে, তাদের কি মনে পড়ে সাপ্তাহিক হাটের কথা।


আমি গ্রামে বেড়ে উঠা একজন মানুষ । গ্রাম ছেড়েছি প্রায় ৩৫ বছর হয়। আমার নিজের গ্রাম নয়, আমি বেড়ে উঠেছি অন্য এক গ্রামে। আমার বাল্য-কৈশোর কাটানো নান্দনিক সেই গ্রামের নাম কানুনগোপাড়া। বাবার কর্মসূত্রেই কানুনগোপাড়ার সঙ্গেই আমার আত্মার সম্পর্ক।


এই কানুনগোপাড়ায় সেই ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্যার আশুতোষ কলেজ। প্রতিষ্ঠাতা কানুনগোপাড়ার বিখ্যাত দত্তভ্রাতৃবৃন্দের বড় জন বৃটিশ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ড. রেবতী রমন দত্ত। প্রিয় শিক্ষকের নামেই তিনি এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।


কানুনগোপাড়ার সেই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক ছিলেন আমার বাবা। তাঁর কর্মসূত্রেই সেখানে আমাদের বাস।


কানুনগোপাড়ার দক্ষিণ ও উত্তরে দু'টি হাট ছিল। দক্ষিণে কালাইয়ার হাট, উত্তরে মুরাদ মুন্সির হাট। কানুনগোপাড়া থেকে দুই হাটের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। কালাইয়ারহাট বসতো প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার, আর মুন্সি হাট শুক্র ও সোমবার।


আমার এক জেঠাত ভাই আমাদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করতেন । তার সঙ্গে খুব ছোট বয়স থেকেই হাটে গিয়ে সদাইপাতি কিনতে শিখেছি। উনার সঙ্গে আমার প্রতি সপ্তাহে দুই দিন হাট থেকে সদাইপাতি করতে হতো। একটা সুবিধা ছিল, আমরা যে স্কুলে পড়তাম সেই স্কুলটা ছিল হাটের লাগোয়া। ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত পি সি সেন সারোয়াতলী স্কুল সংলগ্ন প্রাইমারিতে আমি পড়তাম। কলেজের প্রায় সব শিক্ষকের ছেলে-মেয়েরা এই স্কুলে পড়তো। স্কুলটি ছিল কালাইয়ারহাট সংলগ্ন। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার আমরা হাট থেকে সদাইপাতি কিনতাম।


কানুনগোপাড়া হচ্ছে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সবচেয়ে অগ্রবর্তী একটি গ্রাম। বোয়ালখালীতে এক সময় ১৬/১৭ সাপ্তাহিক হাট ছিল। এই সব হাটের অনেকগুলো এখন শুধু নামেই রয়েছে, সাপ্তাহিক হাট আর বসে না। কয়েকটি হাট এখনো টিকে আছে কোনভাবে। তবে আগের মতো লোক সমাগম হয় না।


এসব হাটে বর্ষা মওসুমে কাদাপানিতে থকথক করতো। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে শন দিয়ে একচালা ছাউনি দেয়া থাকতো। বেপারীরা বসতো মাটি দিয়ে ঢিবির মতো উঁচু একটা স্থানে । সন্ধ্যায় কেরোসিনের বাতি জ্বালানো হতো। স্থানীয়ভাবে এসবকে বলা হতো বোম্বা। এখন আর কেউ বোম্বা ব্যবহার করে না।


মাঝে মধ্যে সেই গ্রামে গেলে কিছু না কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ে। গ্রামের মানুষকে আর আগের মতো ঘটা করে হাটে যাওয়ার তাগাদা অনুভব করতে দেখি না। এই পরিবর্তনটা অবশ্য একদিনে হয়নি। এক সময় গ্রামের মানুষ ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এখন গ্রামের ছেলেদের অনেকেই মধ্যপ্রচ্যে গিয়ে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করে স্বজনদেরও নিয়ে গিয়েছে। এভাবে এখন প্রচুর ছেলে দেশের বাইরে। অনেকে আবার লেখাপড়া করে সরকারি-বেসরকারি চাকরি করছে। ওরা ধীরে ধীরে শহরের বাসিন্দা হয়ে উঠছে। গ্রামের চিরাচরিত আবাসগৃহ বদলে যাচ্ছে। পাকা দালান উঠছে। গ্রামে সুন্দর সুন্দর মার্কেট হয়েছে। কৃষি আর এখন উপার্জনের একমাত্র উৎস নয়। আয়–রোজগারে সৃষ্টি হয়েছে বহুমুখী খাত।


পাড়ার রাস্তার মোড়ে এখন নিত্যদিন শাকসবজি মাছ তরকারি পাওয়া যায়। মানুষ তার নিত্যপ্রয়োজনীয় সবজি কিনছে পাড়ার মোড় থেকে। ধীরে ধীরে এখানেই জমে গেছে বাজার। এখন সপ্তাহে নয়, প্রতিদিন বাজার করছে গ্রামের মানুষ। ভ্যানগাড়িতে করেও মাছ তরকারি বিক্রি হচ্ছে গ্রামে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, তাই যখন মনে চায় তখনই বাজারে ছুটে যায়। হাতে টাকা থাকলে যা সম্ভব।


আমাদের ছোট বেলায় কানুনগোপাড়া এলাকায় অল্প ক'জন রিকশাচালক ছিলেন। মাটির রাস্তা। আমরা বর্ষায় কাদামাটির রাস্তা ভেঙ্গে স্কুলে গিয়েছি। এখন রাস্তা কার্পেটিং করা, ওখানে এখন অটোরিকশা চলে। সেই অটোর জন্যও মানুষকে অপেক্ষায় থাকতে হয় না। ঘর থেকে পা ফেললেই অটোরিকশা।


স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে কানুনগোপাড়ার আশপাশের গ্রামগুলোর অনেক মানুষ পুবের কড়লডেঙ্গা পাহাড় থেকে বাঁশ, শন ও জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করে হাটে বা অবস্থাসম্পন্ন মানুষের বাড়িতে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন এসব এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে রান্নার কাজে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে।


আমাদের ছোটবেলায় পুরো পাঁচ গ্রামে একজন মাত্র এমবিবিএস বা এলএমএফ ডাক্তার ছিলেন। তিনি ধরলা সরকারি কমিউনিটি হাসপাতালের ডাক্তার। হাসপাতাল কম্পাউন্ডেই থাকতেন। রাত–বিরাতে সাধারণ রোগীদের কোনো সমস্যা হতো না। এলাকার বিত্তশালী ব্যক্তিরা মাঝে মধ্যে রিকশা পাঠিয়ে ডাক্তার সাহেবকে বাড়ি নিয়ে যেতেন মহিলা রোগীদের জন্য। এটার জন্য তাদের কিছু সম্মানী দেয়া হতো। আরও একজন ডাক্তার ছিলেন আশুতোষ কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।


এক সময় সরকারি এই ডাক্তার ছাড়া কানুনগোপাড়া এলাকায় কম্পাউন্ডারি পাস করা এক ব্যক্তি ছিলেন। সবাই উনাকে ডাক্তার হিসাবে জানতেন। আমরাও উনার চিকিৎসা নিয়েছি। মনরঞ্জন দাদু বলে ডাকতাম। সাধারণ মানুষের প্রতি অনেক দয়াবান ছিলেন ।


এখন কানুনগোপাড়া এলাকায় বেশ কয়েকজন এমবিবিএস ডাক্তার নিয়মিত চেম্বার করেন। ধরলা গ্রামের সরকারি সেই ডাক্তারখানায় (কমিউনিটি হেলথ সেন্টার) এখন ডাক্তার থাকেন না।


গ্রামে হালচাষে এখন গরুর বদলে ব্যবহার করেন জমির মালিকরা। গ্রামের অনেক যুবক এখন অন্যের পুকুর ভাড়া নিয়ে মাছ চাষ করছে।


এভাবেই গ্রামের চিত্র বদলে যাচ্ছে। বদলে যাওয়া গ্রামে ক্রমান্বয়ে উঠে যাচ্ছে সাপ্তাহিক হাট প্রথা। শুধু কি কানুনগোপাড়া বা বোয়ালখালী এলাকায় এই অবস্থা? তা কিন্তু নয়। চট্টগ্রাম জেলার সব-ক'টি উপজেলার গ্রামীণ হাটগুলোর অবস্থা প্রায় একই ।


কানুনগোপাড়া গ্রামের পর যে গ্রাম আমাকে বেশি টানে তা হচ্ছে সীতাকুন্ড উপজেলার গোপ্তাখালী। আমরা আমাদের দাদা-দাদিকে দেখিনি। সেই ছোটবেলা থেকেই নানা-নানীর আদর পেয়েছি বেশি। কি শীত কি গ্রীস্ম স্কুল বন্ধ হলেও আমরা নানার বাড়ি চলে যেতাম।


এখানে দেখতাম প্রতি সপ্তাহে হাট করে দেওয়ার জন্য বিশেষ একজন লোক ছিল। উনি সকালে এসে সদাইপাতির তালিকা নিয়ে যেতেন। হাট থেকে শাক–সবজি, পান সুপারি, পুরো সপ্তাহে রান্নার তেল, কেরোসিন থেকে শুরু করে গৃহকাজে ব্যবহৃত সব রকমের সামগ্রী, এমনকি বাড়ির কৃষিকাজে নিয়োজিত লোকদের জন্য তামাক পর্যন্ত কিনে ভারে করে আনতেন এই লোক। নানাবাড়ির সব ঘরের কর্তাব্যক্তিদের দেখেছি হাটে যেতে। নানার বাড়ি গেলে আমরাও যেতাম হাটে।


নানার বাড়ির কাছাকাছি মুরাদপুরে বাংলাবাজার নামে একটি হাট ছিল, যেটা মুক্তিযুদ্ধের সময় চালু হয়। সেই বাংলাবাজার হাট এখন আর মিলে না। সীতাকুণ্ড এলাকার বুক চিরে বয়ে গেছে চট্টগ্রাম–ঢাকা মহাসড়ক। এই সড়কের পাশে বড়দারোগা হাট, শুকলাল হাট, মহন্তর হাট, মাদামবিবির হাটসহ যে ক'টা হাট ছিল এসব হাটের কয়েকটি নিজস্ব বিশেষত্বের কারণে টিকে আছে, সাপ্তাহিক হাট প্রথার কারণে নয়। এসব হাট এখন নিত্যদিনের বাজারে পরিণত হয়েছে।


আমরা দেড়-দুই মাইল পথ হেঁটে সীতাকুণ্ড সদরে মহন্তর হাট বা শুকলাল হাটে যেতাম। বাড়ি থেকে একে অপরকে ডেকে নিয়ে সবাই দল বেঁধে হাটে যাওধ-আসা করতো। ছোটরা বয়স্কদের হাটের ব্যাগ বহন করে নিয়ে আসতো।


এখন মানুষ মনে হয় হাঁটতে ভুলে গেছে। গ্রামের প্রায় সব রাস্তা পিচ করা। কোথাও কোথাও ইট বসানো। এখন বর্ষাকালেও কাদা মাড়াতে হয় না। বাড়ির কাছেই অটো রিকশা আসে।


বর্ষা মওসুমে নানার বাড়ি যাওয়া ছিল কঠিন এক যুদ্ধ। হাঁটু অবদি কাদা মাড়িয়ে চলাচল করতে হতো। তারপরও আমাদের বেশ মজা লাগতো। জল টুপটুপ বিলে দাপিয়ে বেড়ানোর আনন্দ অন্য রকম। এখন গ্রামে কঠিন কাদা নেই।


এক সময় গোপ্তাখালী পাশের গ্রামগুলোতে জ্বালানী কাঠের সঙ্গে গৃহপালিত গরুর গোবর দিয়ে ঘুটি ও লাঠি এবং শুকনো খড়ের উপর গোবরের প্রলেপ দিয়ে গোল গোল করে চাটি তৈরী করে রাখতেন বাড়ির মহিলারা। এখন এসব আর দেখা যায় না। গ্রামে গ্রামে এখন সিলিন্ডারনির্ভর গ্যাসের চুলা।


এখন কেরোসিনের হারিকেন, কুপি বাতি বা চেরাগ আর কেউ তেমন জ্বালায় না। বাড়ি বাড়ি বৈদ্যুতিক আলো।


এক সময় এই এলাকার মানুষ পুকুরের পানি ফিটকিরি দিয়ে বিশুদ্ধ করে পান করতো। এখন আর কেউ পুকুরের পানি পান করে না। এখন গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে টিউবওয়েল রয়েছে।


স্বাধীনতাপরবর্তী চার দশকের বেশি সময়ে গ্রামের দৃশ্যমান পরিবর্তনগুলো জানান দিচ্ছে আমাদের এগিয়ে যাওয়া। দেশের এই এগিয়ে যাওয়ার চিত্র স্বাধীনতার আগে চিন্তাও করতে পারেননি আমাদের মুরব্বিরা। একটি দেশ স্বাধীন হলে নিজস্ব স্বপ্ন বুনন নিজেরাই করতে পারে। তা না হলে এই এগিয়ে যাওয়া স্বপ্নই থেকে যেত।


বাংলাদেশের দারিদ্রের হার কিভাবে হ্রাস পাচ্ছে তার একটি তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাদের এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০০০ থেকে ২০১৬ এই ১৬ বছরে অতিদরিদ্রের হার ৪৮.৯ থেকে ২৪.৩ শতাংশ এবং হতদরিদ্র ৩৪.৩ থেকে ১২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। স্বচক্ষে দেখা গ্রাম বদলের চিত্র এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে তেমন পার্থক্য নেই।


এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ব্যুরো অন্যভাবে একটি কাজ করতে পারে। তা হচ্ছে তিরিশ বছর আগে গ্রামের সড়কব্যবস্থা ও মানুষের বসতবাড়ির কাঠামোগত অবস্থান এবং বর্তমান অবস্থা ও কি পরিমাণ পাকাবাড়ি নির্মিত হয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামে, তার একটা চিত্র তুলে ধরা।


লেখক : সাংবাদিক, চট্টগ্রাম


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com