শিরোনাম
ছাত্রলীগের ৭০ বছর : দ্রোহ-প্রেম-স্পর্ধার কবিতা
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১৫:৩৩
ছাত্রলীগের ৭০ বছর : দ্রোহ-প্রেম-স্পর্ধার কবিতা
হুসাইন সাদ্দাম
প্রিন্ট অ-অ+

১৮৩০ সালের জুলাই মাসে ফরাসি বিপ্লবের সময় কলকাতার কয়েকজন তরুণ অক্টরলনি মনুমেন্ট থেকে ব্রিটেনের পতাকা সরিয়ে উড়িয়ে দেন সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার তেরঙ্গা ঝাণ্ডা। এর ১১৮ বছর পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে 'নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ' ভাষা প্রশ্নে গণবিরোধী ভূমিকা পালন করতে থাকলে সংগঠনের বিদ্রোহী অংশ 'নিখিল' শব্দটি বাদ দিয়ে গড়ে তোলেন নতুন একটি সংগঠন। নয়া এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান।


এর মধ্য দিয়েই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রলীগ নেতাদের বিদ্রোহ যুগান্তরের অরুণোদয়। ছাত্রলীগের বিপ্লবী কর্মসূচিই নবীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদলীয় কর্মকাণ্ড; স্থবিরতা ও পশ্চাৎপদতার বিপ্রতীপে নতুন অভিজ্ঞান।


দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতার রক্তশপথে বাংলাদেশকে পথ দেখান পাকিস্তানবাদকে প্রথম ‘না’ বলা বিপ্লবী তরুণদল।


১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট ডাকে এদেশের ছাত্রসমাজ। কৃষ্ণচূড়ার রঙে রঞ্জিত হয় রাজপথ। ১৯৪৯ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নিঃশর্ত সমর্থন দেয় ছাত্রলীগ। মুচলেকা দিতে অস্বীকার করে ছাত্রত্ব হারান শেখ মুজিব। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রতিবাদে ছাত্রসমাজকে সাথে নিয়ে দুর্বার জবাব দেয় ছাত্রলীগ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভা থেকে। মহাকালের পালকে যোগ হয় 'রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'। ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করায় প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকা 'মর্নিং নিউজ'-এ আগুন লাগিয়ে দেয় ছাত্ররা।


১৯৫৪ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলের বিজয়ের পর থেকেই জাতীয় রাজনীতির পরিসর থেকে সামরিক স্বৈরাচার ও প্রতিক্রিয়াকে পরাজিত করার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা জাগে। ২১ দফার বেশিরভাগ দাবিই ছাত্রসমাজের মিছিল-শ্লোগান-শপথ থেকে উচ্চারিত। বাঙ্গালির আকাশ থেকে রবীন্দ্রনাথকে ‘মৃত’ করে দেয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মাধ্যমে সত্য-সুন্দরের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন তরুণরা। ৫৬ হাজার বর্গমাইল জেগে উঠে জাগরণের উৎসবে। ১৯৬২ সাল ছিল শিক্ষা-আন্দোলনের মাধ্যমে আইয়ুবশাহীর পতনের ডাক। ১৯৬৪ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার বিরুদ্ধে হাত্রলীগ ছাত্রজনতার সাথে যূথবদ্ধ হয়ে গড়ে তোলে 'পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও আন্দোলন'।


১৯৬৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন মিলে গণমুখী, বৈজ্ঞানিক, ছাত্রবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থার দাবিতে ২২ দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করে। ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে মিলিতভাবে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৬৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি এক সপ্তাহ 'বাংলা প্রচলন সপ্তাহ' পালন করার আহ্ববান জানায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। শিল্প-সাহিত্য-ভাষাকে সমৃদ্ধ করার এ অভূতপূর্ব প্রয়াসে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয় দেশবাসী। দোকানপাটের সাইনবোর্ড এমনকী গাড়ির নামফলক পর্যন্ত বাংলায় লেখার উৎসাহ জাগ্রত হয়। বাধ্য হয়ে যানবাহনের নম্বরপ্লেট বাংলায় লেখার আইন প্রণয়ন করে পূর্ব পাকিস্তানের সংসদ।


১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ৬ দফা উত্থাপন করে সমগ্র শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে তুলেছিলেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জানিয়েছেন, ৬ দফা প্রণয়নের সময় শেখ মুজিব তাকে ডেকে জানিয়েছিলেন, ‘আসলে এটি ৬ দফা নয়, ১ দফাই। ঘুরিয়ে বললাম শুধু।’


স্বাধীনতার লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবং প্রবীণ নেতাদের একটি বড় অংশ পাকিস্তানপন্থী বলে মুজিব তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য ছাত্রলীগের তরুণ নেতাদের নির্দেশ দেন এবং ৬ দফার ব্যাপক প্রচার করতে বলেন। এসময় নববর্ষ, একুশে, রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বলয় আবর্তিত হতে থাকে।


১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ভাষা সংস্কারের পুনঃচেষ্টা করলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। ১৯৬৯ সালে এসে প্রচণ্ড রুদ্ররোষে ছাত্রদের সঙ্গে গণমানুষ যে রাস্তায় নেমে আসে তার বড় কারণগুলো হলো- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, অব্যাহত অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেতার-টিভিতে পুনরায় রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ, বাংলাভাষা সংস্কারের পুনঃপ্রচেষ্টা। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সূত্রপাতের লক্ষ্যে আলোচনা শুরু হয়। ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রউফ এবং মতিয়া গ্রুপ (ইউ) নেতা শামসুজ্জোহা দাবিগুলোর খসড়া তৈরি করেন। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন-মতিয়া) ও ডাকসুর সমন্বয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ দফার মধ্যে ছিল ৬ দফা এবং শিক্ষাভিত্তিক অন্যান্য দফা।


২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদ শহীদ হলে 'জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট' হয়ে ওঠে যে, ঢাকা শহরে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে দীর্ঘ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। শামসুর রাহমানের ভাষায় 'আসাদের শার্ট আজ প্রাণের পতাকা।'


২৪ জানুয়ারি ঢাকা শহর মানুষের মহাপ্লাবন ডেকে আনে। সচিবালয়ের সামনে অগণিত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শহীদের লাশ নিয়ে মিছিল এগিয়ে যেতে থাকে ইকবাল হলের (বর্তমান জহুরুল হক হল) দিকে। এদিন থেকে ইকবাল হল শুধু আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র নয়, এক পর্যায়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের নিয়ন্তাও হয়ে পড়ে।


১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে হত্যা করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে। সরকারের পৈশাচিকতায় জনতা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কয়েকজন প্রাদেশিক মন্ত্রীর সরকারি বাসভবন জনতার রুদ্ররোষে ভস্মীভূত হয়।


১৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শামসুজ্জোহা। ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিবসহ অন্যান্য রাজবন্দী।


২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ছাত্রজনতার হয়ে শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেন ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমেদ।


গণঅভ্যূত্থান-পরবর্তী এক বড় আন্দোলন ছিল স্কুলপাঠ্য 'পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি' বইটি বাতিলের আন্দোলন। ছাত্রলীগ এ আন্দোলনেও সমর্থন দেয়।


১৯৬৯-পরবর্তী ছাত্রলীগের কর্মধারায় সাহিত্য-বাসর, রাজনৈতিক বিষয়ে পাক্ষিক-মাসিক আলোচনা ছিল নিয়মিত ঘটনা। শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান এবং প্রখ্যাত চিন্তাবিদদের দিয়ে ছাত্রলীগের অফিস 'বলাকা বিল্ডিং' এ শিক্ষা পর্ব চালু করা হয়।


১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুকে কোনো রকম চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার আহ্ববান জানানো হয়। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘ভুট্টো সাহেবরা যদি এখানে না আসতে পারেন তো আপত্তি নেই। তারা ওখানে বসেই পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করুন। আমরা এখানে বাংলার শাসনতন্ত্র কায়েম করব।’


এক আলোচনা সভায় ‘জয় বাংলা’শ্লোগানের বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এর মধ্যে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকার নিহিত।’


১ মার্চ অধিবেশন স্থগিত করা হয়। উত্তেজিত জনতা ঢাকা স্টেডিয়ামে ঢুকে ব্যাট, বল, স্ট্যাম্প, প্যাড ও ম্যাটে আগুন ধরিয়ে দিয়ে জঙ্গি মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে পড়ে। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে।


ছাত্রলীগের এক সভায় তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম করবে।’


২ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘বাঙালিরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে কৃতসংকল্প।’ তিনি ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে ডেকে 'স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করতে বলে দেন।


ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসু ভিপি-জিএস সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১ মার্চ রাতে জহুরুল হক হলে ৮ ছাত্রনেতার ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রথম বাংলাদেশের পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের কাঠামো ও রূপ নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের সভায় স্বাধীনতার প্রস্তাব পাঠ করা হবে।


২ মার্চ স্বাধীনতার প্রস্তাব পাঠ ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৩ মার্চ ছাত্রলীগের আলোচনা সভায় 'স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা' 'আন্দোলন পরিচালনার কর্মপন্থা' 'স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা' এবং বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক’ ঘোষণা করা হয়। রাজপথে শ্লোগান ধরা হয় ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’


৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। আমাদের এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’


গুলি বর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে ৮ মার্চ ছাত্রলীগ ও ডাকসু সর্বত্র কালো পতাকা তোলার নির্দেশ দেয়। ৯ মার্চ সাংগঠনিক এক প্রস্তাবে 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ' এর পরিবর্তে 'ছাত্রলীগ' নাম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এদিন পূর্ব পাকিস্তানের নবনিযুক্ত গভর্নর টিক্কা খানকে শপথ পাঠে অস্বীকৃতি জানান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকি। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক প্রস্তাবে ১১৫ নম্বর সামরিক আদেশ প্রত্যাখান করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে কেবল বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই কোনো নির্দেশ জারি করতে পারেন।’


২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে দেন। ২৫ মার্চ কালোরাতে হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, ‘Your fight must go on until the last soldier of Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh & final victory is achieved.’


ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাবেক ও বর্তমান ৮ নেতার নেতৃত্বে, ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেন। প্রথমে এর নামকরণ হয় Bangladesh Liberation Force, পরে মুজিব বাহিনী নামে এটি সাধারণভাবে পরিচিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো সময় মুজিব বাহিনী স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন ছাত্রলীগের ১৭ হাজার নেতাকর্মী।


স্বাধীনতার ইশতেহার, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা ছাত্রলীগের গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাসের স্বর্ণখণ্ড। পৃথিবীর অন্য কোন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র সংগঠনের অর্জনের এমন অনুপম মেলবন্ধন নেই। ইতিহাসের কালপঞ্জিতে তাই 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগ' অমোচনীয়।


স্বাধীনতার পরে মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-সমাজতন্ত্র অভিমুখী-বাঙ্গালিত্বের শেকড়সন্ধানী একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণে যখন সৃজন-ত্যাগ-গণমুখী কর্মপ্রয়াসের মাধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিযাত্রা নিশ্চিত করছিলেন, সে সময় ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসকে আবার পরাজিত শক্তির আস্ফালন আর পশ্চাৎপদতার দিকে টেনে নিয়ে যায়। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, পরাজিত আদর্শের পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র আর শহীদের স্বপ্নের পুনরুজ্জীবনের জন্য ছাত্রলীগকে আবার লড়াই-আত্মত্যাগ করতে হয়েছে, রক্ত ঝরাতে হয়েছে।


স্বৈরাচারী এরশাদের গণবিরোধী-বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্রবন্দীদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধ এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সাথে যুগপৎ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দুঃখী বাংলার আঁধার পথে অনিশ্চিত যাত্রায় আলো হাতে আঁধারের কাণ্ডারী হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।


পিতা মুজিবের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ যেমন ভাষা-স্বায়ত্তশাসন-গণতন্ত্র-স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছে, বাঙালির আস্থার শেষ ঠিকানা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ তেমনি গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারের শপথ গ্রহণ করে। দুর্যোগময় সেই দিনটিতে শেখ হাসিনার আগমনে মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় রাজধানী ঢাকা। রাজপথে জনতা আওয়াজ তোলে- ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে; শেখ হাসিনা, আমরা আছি তোমার সাথে’, ‘শেখ হাসিনা ভয় নাই, আমরা আছি লাখো ভাই।’


ছাত্রলীগ যুগসন্ধিক্ষণের সে মুহূর্তে ছাত্রলীগের প্রচারপত্রে লেখা হয়, ‘বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক/সংগ্রামী নেত্রী/শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান : প্রিয় ভাই ও বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীর মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই ও স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে। আমাদের সকল ভরসার স্থল জাতির জনক আজ নেই। জনতার মুক্তির দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনাপর্বে তিনি বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় প্রতিক্রিয়ার হিংস্র চক্রান্তে। কিন্তু মহামানবের মৃত্যু নেই, মুক্তির দিশারী বেঁচে থাকেন মুক্তি সংগ্রামের প্রাণশক্তিরূপে।...তিনি আমাদের কর্ম ও চেতনার হাতিয়াররূপে নির্মাণ করে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচীকে আমরা বহন করে চলেছি মানুষের মুক্তির মিছিলে। আর এই মিছিলের অগ্রসেনানী শেখ হাসিনা।’


‘...ক্ষমতার মোহে মদমত্ত একশ্রেণীর বন্দুকধারী ও তার চাটুকার রাজনৈতিক দলে চলছে বিলাসী উন্মত্ততা। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা।...আজ এই সময়ের মুখোমুখি শেখ হাসিনার আগমন তাই আমাদের জীবনে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমাদের প্রত্যাশা, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে এ প্রত্যাবর্তন। বাঙালী জাতিকে তিনি নেতৃত্ব দেবেন জাতির জনকের আরাধ্য দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচী বাস্তবায়নে সৎ, বিপ্লবী, সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনীর সংগঠন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মহাসংগ্রামে। আর তাই এ প্রত্যাবর্তন হোক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।’


সেদিনের প্রচারপত্রটি লিখেছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ওবায়দুল কাদের। সেদিনের সেই লেখনীই প্রমাণ করে সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের দূরদর্শিতা।


স্বৈরাচারী এরশাদের গণবিরোধী-বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্রবন্দীদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধ এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সাথে যুগপৎ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচীতে শহীদ হন জয়নাল-দিপালী-কাঞ্চনসহ নাম না জানা আরো অনেকে। ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলের ওপর ট্রাক চালিয়ে দিলে ঘটনাস্থলেই শহীন হন সেলিম ও দেলোয়ার। ১৯৮৫ সালে এরশাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রাউফুন বসুনিয়া। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর শহীদ হন নূর হোসেন।


২৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আপসহীন আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে এরশাদশাহির।


জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে রাজপথ প্রকম্পিত করে ছাত্রলীগ। গণআদালতের সংগঠকদের বিরুদ্ধে যখন খালেদা-নিজামী গং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা করে, এ সময় প্রথমবারের মত সংসদে প্রতিবাদ উত্থাপন করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সংসদে জোরালো বক্তব্য উত্থাপন করেন। জনগণের ভোটাধিকার রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সন্ত্রাস ও অপকৌশলের মাধ্যমে যখন কেড়ে নেয়া হয়, গণতন্ত্রের সাথে তামাশা করে বাংলাদেশে যখন মাগুরা-মিরপুর ধরনের নির্বাচনের অপসংস্কৃতি তৈরি করা হয়; সে সময় ভোট আর ভাতের অধিকারের দাবিতে ছাত্রলীগ ১৯৯৬ সালে গড়ে তোলে ছাত্রজনতার যূথবদ্ধ ঐকতান। জনতার মঞ্চে ছাত্রসমাজের সোচ্চার ভূমিকাই গণবিরোধী শক্তিকে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচন ব্যবস্থা প্রদানে বাধ্য করে।


সন্ত্রাস-অস্ত্রনির্ভর রাজনীতির বিপরীতে ছাত্রলীগ প্রচেষ্টা চালায় শিক্ষামুখী ইতিবাচক গতিধারা নির্মাণের। এক ছাত্রসমাবেশে শিক্ষার্থীদের হাতে বই আর কলম তুলে দিয়ে সন্ত্রাসবাদী ছাত্ররাজনীতিকে পরাজিত করার পবিত্র নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।


১৯৯৮ সালের বন্যার সময় দূর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগ মানবিক রাজনীতির পতাকাকে ঊর্ধে তুলে ধরে। দূর্যোগকবলিত মানুষের পাশে রুটি আর স্যালাইন নিয়ে কর্মীদের তৎপরতা ব্যাপক প্রশংসিত হয়। নিরক্ষরতা দূরীকরণ, পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ গঠন ও বৃক্ষরোপণে এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।


২০০১ সাল থেকে বিএনপি-জামাতের দুঃশাসন, সন্ত্রাস, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ সংগঠনটি প্রতিবাদ জারি রাখে। বিএনপি-জামাত জোটের ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও প্রগতিশীল শক্তির ওপর অমানবিক দমন-পীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে রুঁখে দাঁড়ায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির মধ্য দিয়ে যারা জাতিসত্তার ভিন্ন বয়ান নির্মাণ করতে চেয়েছে, ছাত্রলীগ সৃজনশীলভাবে তার জবাব দেয়, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জিপিএ-৫ অর্জনকারী কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের সংবর্ধনার আয়োজন, নবীনবরণ এবং নকলমুক্ত পরীক্ষা হলের দাবিতে সচেতনতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব, ছাত্রস্বার্থবিরোধী, হত্যা চাঁদাবাজির অপরাজনীতিকে প্রতিরোধ করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি ছাত্র আন্দোলনের কর্তব্য পালন করেছে।


চারদলীয় জোটের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, প্রশাসনিক পীড়ন, হত্যা-নির্যাতন মোকাবেলা এবং শিক্ষার সংগ্রামে সংহত হয়ে ছাত্রলীগ তার সাংগঠনিক কার্যক্রম এগিয়ে নিয়েছে। বাংলার দুঃখী মানুষের আস্থার ঠিকানা, বঙ্গবন্ধুকন্যার আত্মত্যাগ, আদর্শিক দৃঢ়তা, অপরিমেয় সাহসিকতা, সীমাহীন নিষ্ঠা, সৃজনশীল-গণমুখী রাজনীতি নির্মাণের স্পৃহার বলে বলীয়ান হয়ে ছাত্রলীগ তার প্রাগ্রসরতার প্রমাণ রেখেছে সময়।


জননেত্রীর নির্দেশে এ সময় চালু ছিল রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। জাতির জনকের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে রাজনীতি নির্মাণের কর্মকৌশল হিসেবে এ ফলপ্রসূ কর্মসূচীর উত্তরাধিকার এখনো বহন করে চলেছে ছাত্রলীগ। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে জনগণের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সূচিত ধারাবাহিক সংগ্রামে নিয়োজিত থেকেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কলঙ্কযুক্ত অধ্যায় দেশবিরোধী শক্তির ক্রীড়নক তত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে জনসমর্থন সংগঠিত করতে সাংগঠনিকভাবে দৃঢ় ভূমিকা পালন করে এ সংগঠন। এর আগে অপশক্তির নীল নকশার নির্বাচনও বানচাল করে দেয়। এ সময়ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়েছে, জেল-জুলুম সহ্য করেছে।


২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বেআইনিভাবে গ্রেফতার হন জননেত্রী শেখ হাসিনা। সেই কলঙ্কিত ঘটনার প্রথম প্রতিবাদ রচনা করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। নেত্রী মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালির আশার পিদিম জ্বালিয়ে রাখে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষকবৃন্দের গ্রেফতারের প্রতিবাদে লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।


২০০৭ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপকৌশলের বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয় ২০-২২ আগস্টের ছাত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন, মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে উজ্জীবিত হয়ে তরুণ সমাজের ম্যান্ডেট নিয়ে আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। আদর্শিক ঐক্য, সাংগঠনিক দৃঢ়তা, শেখ হাসিনার প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস-ভালোবাসা নিয়ে ছাত্রসমাজকে মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত লক্ষ্যের সিপাহসালার জননেত্রীর পাশে ঐক্যবদ্ধ রাখে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আধুনিক-বিজ্ঞানভিত্তিক-গণমুখী-বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হয়। এর গর্বিত অংশীদার এ সংগঠনটি।


এর পাশাপাশি সৃজনশীল পদ্ধতি, বছরের প্রথম দিনে সকল শিক্ষার্থীকে বই উপহার, মাদ্রাসাশিক্ষার আধুনিকায়ন, কারিগরি শিক্ষার প্রসার, বিপুলসংখ্যক রেজিস্টার্ড বেসরকারি বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তি, জিডিপির অনুপাতে শিক্ষার বাজেট বৃদ্ধি, নতুন সরকারি কলেজ-মেডিকেল কলেজ, পাবলিক ও বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে ছাত্রলীগের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম।


২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে তারুণ্যের যে জাগরণ উৎসব দেখে বাংলাদেশ; এ আন্দোলনের অন্যতম কারিগর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।


২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশবিরোধী শক্তি যখন পেট্রোলবোমা ও ককটেলবাজির রাজনীতির মাধ্যমে জনগণে জীবন-জীবিকা অনিরাপদ করে তোলে, গণতন্ত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলা করে, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ অস্থিতিশীল করে তোলার অপচেষ্টা করে; সে সময় সন্ত্রাস প্রতিরোধ, সেশনজটমুক্ত ক্যাম্পাস, নিরাপদে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা প্রদান করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।


এভাবেই সময়ের সারথী হয়ে, একাত্তর কবিতার বারুদে স্ফুলিঙ্গ হয়ে মুক্তির অগ্নি অক্ষর লিখে চলেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।


কুসুমকুমারী দাস ছিলেন জীবনানন্দের মা। ভেতো, কর্মবিমুখ, আলস্যপ্রিয় বাঙালিদের উদ্দেশে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে , কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’


ছাত্ররাজনীতির তুলনামূলক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ছাত্রলীগ সেই ধারারই ছাত্র সংগঠন, যারা সময়কে সঠিকভাবে পড়েছেন; অভিজ্ঞতার উপলব্ধি থেকে জনমানস নির্মাণ করে সমাজ প্রগতির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন। ছাত্রলীগ বাগাড়ম্বরপ্রিয় সংগঠন নয়, ছাত্রলীগ তার কাজের মাধ্যমেই বৃত্ত ভাঙার সংগঠন। সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ তাই কুসুমকুমারীর ভাবনারই মানসসন্তান। সময়ের সাহসী সন্তান অভিধাটি তাই মোটেও অতিরঞ্জন নয়; বরং এটি সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য।


বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সামনে আজ অনেকগুলো প্রশ্ন। উঠতি বয়সীদের মধ্যে জেঁকে বসছে রাজনীতিবিমুখ 'আই হেট পলিটিক্স' থিওরি। বিরাজনীতিকরণ ও সমাজবিমুখতাকে ‘মোকাবেলা' করার মতো প্রতিষ্ঠানের অভাব আছে বাজারমুখী রাজনৈতিক সংস্কৃতির এ যুগে। ইতিহাসের সন্তান হয়ে ছাত্রলীগকেই এই চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে। ছাত্রলীগ এ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে; চলতি স্টাইলে স্কিপ করেনি; চোখ থাকতেও অন্ধ সাজেনি, অন্ধের হাতি দেখার মতো করে সমস্যার 'বাই প্রোডাক্ট'কে সমস্যা মনে করে ভুল রণকৌশল গ্রহণ করেনি, উৎসস্থলেই আঘাত করতে চেয়েছে। সমস্যাকে স্বীকার করে মোকাবেলা করার প্রয়াস নিয়েছে।


পলিটিক্যাল ইসলামের চোরাবালির ফাঁদে পা দিয়ে মধ্যযুগীয় পশ্চাদপসরণের সময়ও এটা। সহজিয়া ইসলামের বাংলাদেশে তরবারির ইসলামের 'জোশ' অনেককেই আক্রান্ত করছে। মৌলবাদী রাজনীতির প্রচলিত ডিসকোর্সকে চোখ রাঙ্গিয়ে আমরা দেখছি সূত্রের নবায়ন। দরিদ্র মাদ্রাসাশিক্ষার্থীরাই শুধু নয়; মধ্যবিত্তের সীমানা ছাড়িয়ে উচ্চবিত্তের উচ্চশিক্ষিতরাও এখন জঙ্গিবাদের 'হিউম্যান রিসোর্স'। তিন-চার ধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার সবগুলো ধারা থেকেই বিকাশ লাভের সুযোগ নিচ্ছে নানা কিসিমের মৌলবাদী সংগঠন। খেলাফত, ইসলামী শাসনতন্ত্র, মডারেট ইসলাম, শরীয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা; হরেক রঙের লক্ষ্য এদের। সমাজপ্রবাহের বড় বড় নদীগুলোর পাশে এসব হয়তো চোরা নদী; শাখা নদী; অন্য ভূগোলের আলো-বাতাস-ভূমির আঁতুড়ঘরে বড় হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখা নদ। কিন্তু ছোট হলেও এরা বিপজ্জনক। আমাদের ভবিষ্যতের রোদ্দুরকে ধর্মীয় রাজনীতির মেঘে এরা ঢেকে দিতে চায়। ছাত্রলীগ এ চ্যালেঞ্জও নিয়েছে; স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যে সফলও হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে তাদের লড়াই অব্যাহত রয়েছে। ইতিহাসের অন্ধকারে অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী হয়েই এ লড়াইয়ের সমাপ্তি হবে নিশ্চয়ই।


বাংলাদেশ কায়েম হয়েছে ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। মানচিত্র, পতাকা, ভৌগোলিক স্বাধীনতা, সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব এদেশের মানুষ অর্জন করেছে রক্তের বিনিময়ে; গোলটেবিল আলোচনা, দফারফা বা আপোসমীমাংসার মধ্য দিয়ে নয়। রাষ্ট্রের রঙ, রূপ, রস অনেক বিষয়ে সমাধান করেই জন্ম নিয়েছে এ ভূখণ্ড। দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো শত্রুরা পুরোপুরি পরাস্ত হয়নি; পরাজিত মতাদর্শও নয়। যে বিচার না হলে বাংলাদেশের কায়েম হওয়া অসমাপ্ত থাকে, অন্য বিচার করার ন্যায্যতা তৈরি হয় না, ইতিহাস থেকে আমরা দায়মুক্ত হতে পারি না; সে বিচার যখন গণপ্রজাতন্ত্রের সরকার করতে চেয়েছে, দেশি-বিদেশী গণবিরোধী, ধর্মান্ধ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের অস্ত্রাগারের সমস্ত সামাজিক-রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক অস্ত্র দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এতটুকু টলানো যায়নি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজপথের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই শেখ হাসিনার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করেছে।


ছাত্রলীগের সোচ্চার ভূমিকাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনকে সফল করেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাজনীতি ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে এ সংগঠনটি দৃপ্ত কণ্ঠে সৃজনশীল, প্রগতিমুখীন, ছাত্রবান্ধব রাজনীতির সাহসী উচ্চারণ করে এই বন্ধ্যা সমাজে আশার আলো দেখিয়েছে। দ্বিদলীয় রাজনীতির বাংলাদেশে অপর ধারাটির কথিত ছাত্রসংগঠনটি যখন জন্মলগ্নের অস্ত্র, অর্থ, ধর্মাশ্রয়ীতাকে অবলম্বন করে, নিজের বৈশিষ্ট্যের প্রতি একনিষ্ঠ থেকে সাম্প্রতিক কালেও পেট্রোলবোমা আর ককটেলবাজির ছাত্ররাজনীতির ছবক দিয়েছে শিক্ষাঙ্গনকে; ছাত্রলীগ সুন্দর আর ন্যায়ের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাদেরকে প্রতিরোধ করেছে; সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার পরিবেশ নিরাপদ রেখেছে। ইতিহাসবিকৃতির মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপ্রতীপ বয়ান যারা নির্মাণ করতে চেয়েছে, ছাত্রলীগ তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। শীতার্ত ও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়ে ছাত্ররাজনীতির একটা মানবিক রূপ উপহার দিয়েছে বাংলাদেশকে।


সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক পচনের মধ্যেও অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাতিঘর করে আন্দোলন-সংগ্রাম করে চলেছে শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির নিশানবাহী ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। নিরাপদ জীবনের হাতছানির বৃত্ত ভেঙে, ইতিহাসের দায়মুক্তি আর প্রজন্মের ঋণের স্বপ্নদের হাতড়ে বেড়ায় অশান্ত-স্বপ্নবাজ-সংশপ্তক তরুণেরা। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এ ‘স্পর্ধিত তারুণ্য’কেই প্রতিনিধিত্ব করে। সবুজ ঘাসে লেগে থাকা শহীদের রক্তকণিকার মতোই সারা বাংলার রাজপথ জানে যার রক্তে সে রঞ্জিত, সে অপরাজেয়।


সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন সবাই দেখে; কিন্তু অপশক্তি প্রতিরোধের জন্য বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে পিছপা হয় সবাই। ছাত্রলীগ তার দায়িত্ব এড়ায়নি, যুগোপযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে এ সময়ের শিক্ষাবান্ধব-ছাত্রমুখী-মানবিক-সৃজনশীল প্রয়াসের মাধ্যমে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। সমসাময়িক ছাত্ররাজনীতির প্রবাহের ইতিহাস যখন লেখা হবে, তখন দেখা যাবে ছাত্রলীগ সঠিক পথেই ছিল।


ছাত্রলীগের মত সংগঠনই তাই হৃদ-স্পন্দন থেকে উচ্চারণ করতে পারে-


‘ভেঙ্গেছি বলেই সাহস রাখি গড়ার


ভেঙ্গেছি বলেই সাজিয়ে দিতে পারি!


স্বপ্নের পর স্বপ্ন সাজিয়ে আজ


আমরা এখনো স্বপ্নের কারবারি!’


লেখক : আইন বিষয়ক উপ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com