২৮ অক্টোবর। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের ইতিহাসের এক অনবদ্য দিন। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের অপশাসন, গণতন্ত্র ছিনতাইয়ের হাত থেকে দেশ ও জনগণকে মুক্ত করার এক অবিনশ্বর লড়াইয়ের সেই দিন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র উর্দিধারীদের জোর করে দখল করা ক্ষমতার জোরে বদলাতে থাকে। পাকিস্তানমুখী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে আবারো প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চলতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জামাত এবং তাদের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রধান মিত্র বিএনপি গাঁটছড়া বেঁধে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে।
পঁচাত্তরের পরে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা চলে, এই অপশক্তির জোট রাষ্ট্রক্ষমতার জোরে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে উগ্র ধর্মীয় সশস্ত্র জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটায়। বাংলা ভাই-জেএমবি গোষ্ঠীর তাণ্ডব, একের পর এক সভা-সমাবেশ-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সিনেমা হল-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বোমা-গ্রেনেড হামলা, সারাদেশের ৬৩ জেলার পাঁচ শতাধিক স্থানে একযোগে বোমা বিস্ফোরণের মতো ভয়ংকর জঙ্গিবাদী তৎপরতা চলতে থাকে।
এসব সবারই জানা। তার সাথে সাথে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ‘হাওয়া ভবন’-এর মতো ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র স্থাপন করে দুর্নীতি-দুঃশাসন-দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়। খালেদাপুত্র তারেক রহমানের মতো একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজকে দেশের তরুণ সমাজের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা করা হয়।
একদিকে উগ্র ধর্মীয় সশস্ত্র জঙ্গিবাদ, অপরদিকে দুর্নীতি-দুঃশাসনের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। বিপরীতে ক্ষমতাসীনরা এই অপশাসনকে চিরস্থায়ী করার দুঃস্বপ্নে মত্ত হয়ে ওঠে। তারা সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে নানা কৌশলে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপ দেয়ার নকশা আঁকে। এ লক্ষ্যে সে সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনীব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে নিজেদের দখলে নিতে চেয়েছিলো। সে সময়ের কে এম হাসান-এমএ আজিজ কাহিনী নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি।
মানুষ তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন রাজপথে, রাজধানী থেকে প্রান্তিক জনপদে ১৪ দলের নেতৃত্বে। আন্দোলন-সংগ্রামের মুখে একসময় শেষ হয়ে আসে বিএনপি-জামাতের শাসনকাল। ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর তাদের মেয়াদান্তের দিন ছিলো। কিন্তু সমাধান হলো না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সৃষ্ট বিতর্ক।
২৭ অক্টোবর দুপুরের পর থেকেই দিকে দিকে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে তীব্র গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠতে থাকে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীনদের দলীয় কার্যালয়ে হামলা করে, আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
২৮ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিলো। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের কৌশলে নির্ধারিত কেএম হাসানকে কোনোভাবেই জনগণ মেনে নেয়নি। উল্টোদিকে বিএনপি-জামায়াতও জনদাবি অনুধাবন করে সত্যের কাছে মাথা নত করতে রাজি ছিলো না। ফলে সংঘাত অনিবার্যই ছিলো।
২৮ অক্টোবর সকাল থেকেই মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ারের প্রতীক লগি-বৈঠা নিয়ে রাজধানীর পল্টন ময়দানে জনসমাবেশ ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন ১৪ দলের নেতা শেখ হাসিনা। মানুষ আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই সমবেত হওয়া শুরু করেছিলেন। এটা ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত জনস্রোত। নিজের চোখে দেখেছি, রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় নন - এমন পেশাজীবী ঘরোয়া মানুষগুলোও সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিলেন।
২৮ অক্টোবর পল্টন ময়দানে জনসমাবেশ হওয়ার কথা ছিলো। আগের দিন সন্ধ্যার পর বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা পল্টন ময়দান দখল করার পাঁয়তারা চালায়। ১৪ দলের সাহসী যুবারা সেদিন মাঠ উদ্ধার করেছিলেন পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে।
কিন্তু ২৮ অক্টোবর সকালেই পল্টন ময়দানে ১৪ দলের পূর্বঘোষিত সমাবেশের উপর ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পল্টন ময়দান পুলিশের দখলে চলে যায়। এদিকে কোনোপ্রকার পূর্বঘোষণা ছাড়াই বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটের সামনে মঞ্চ নির্মাণ করে সমাবেশ শুরু করে জামায়াত-শিবির। সকাল থেকে তাদের অঙ্গসংগঠন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী উস্কানিমূলক গান শুরু করে। ফাঁকে ফাঁকে জামায়াতের নেতারা উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখতে থাকেন।
পল্টন ময়দানে ১৪৪ ধারা জারি করার ফলে স্বতঃস্ফূর্ত জনস্রোত অবস্থান নিতে থাকে গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, মুক্তাঙ্গন, পল্টন মোড়, তোপখানা রোড, বিজয়নগর, কাকরাইলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। তারই ঠিক পাশে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে জামায়াতের এই উস্কানি সমাবেশ আয়োজনের অর্থই ছিলো ইচ্ছাকৃত সংঘাত সৃষ্টি - একথা বুঝতে আমাদের বিন্দুমাত্র বাকি ছিলো না। কিন্তু পরিস্থিতির অনিবার্যতার কারণে সমবেত জনতার সামনে অন্য কোনো পথও খোলা ছিলো না। কারণ, স্বাধীনতা-গণতন্ত্র রক্ষায় বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালেও মরণপণ যুদ্ধ করেছেন, সেই বাঙালি জাতি সেই স্বাধীনতাবিরোধীদের চোখরাঙানিতে মাথা নোয়াবেন কেন?
মাথা নোয়াননি সেদিন বাঙালি। বরং উস্কানিমূলক সশস্ত্র হামলা প্রতিরোধ করেছিলেন কেবলমাত্র লগি-বৈঠার জোরে আর আদর্শ ও দেশপ্রেমের দৃঢ়তায়।
একের পর এক মিছিল আসছিলো, কোথা থেকে এসব মানুষ এসেছেন সেদিন তা হয়তো কোনো নেতাও জানতেন না। কারণ সংগঠিত কর্মীবাহিনীর চাইতে অনেক অ-নে-ক বেশি মানুষ এসেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। দুপুরের আগেই হঠাৎ করে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে জামাত-শিবিরের জমায়েত থেকে উস্কানিমূলক স্লোগানের সাথে সাথে জনতার উপর হামলা চালানো হয়। অস্ত্র-গুলির মুখে মানুষকে সেদিন ওরা জিম্মি করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিলো। ওদের মঞ্চ থেকে ওদের নেতারা মাইকে বারবার ঘোষণা দিতে থাকে - “বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করো, মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী”। ওদের হায়েনা বাহিনী নেতাদের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। ওরা গুলি চালায়, মুহুর্মুহু বোমা বর্ষণ করতে থাকে। আর বিপরীতে মানুষ ১৪ দলের নেতৃত্বে কেবলমাত্র লগি-বৈঠা নিয়েই প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন হায়েনাদের বিরুদ্ধে।
জামাত-শিবিরের ক্যাডাররা গুলি করে হত্যা করে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর প্রাক্তন যোদ্ধা ও বাংলাদেশ যুব মৈত্রীর খিলগাঁও থানা যুগ্ম আহবায়ক রাসেল আহমেদ খানকে। একইসাথে টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন রাসেল। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রাসেল তাদের সংগঠিত করার গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
এই রাসেল আহমেদ খানের মতো নিবেদিতপ্রাণ ও আদর্শের প্রতি সৎ-অবিচল কমরেড খুব কমই দেখেছি। যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার পাঠান পাইকপাড়া গ্রামের ছেলে রাসেল। অল্প বয়সে মাকে হারান তিনি। কঠোর দারিদ্র্য আর সৎ মায়ের সংসার। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই লেখাপড়া ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন রাসেল। ছাত্রজীবনে ছাত্র মৈত্রীর রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ঢাকায় এসে কঠোর জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা তপন সাহা’র কাছে জেনেছি, রাসেল কখনো পরের দোকানে কাজ করে, কখনো গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে আবার কখনো রাতের বেলায় রিক্সা চালিয়ে জীবন চালাতেন। খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। থাকতেন রামপুরায় বস্তিসম বাসায়। বাসা ভাড়াও জোটেনি অনেক দিন। থেকেছেন টিনশেডের বাসার বারান্দায়। কিন্তু এতো কঠোর জীবনের টানাপোড়েনেও আদর্শ-রাজনীতি-পার্টিকে ত্যাগ করতে পারেননি রাসেল। পার্টির কাজের প্রতি এতোটাই নিষ্ঠ ছিলেন যে অনেক দায়িত্বশীল সিনিয়র নেতাও এতোটা পারেন না। অনেকেই আছেন, পার্টির কর্মসূচিতে এসে পকেটে টাকা না থাকলে যাওয়ার আগে নেতা বা সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে দুই-দশ টাকা নিয়ে বাসায় ফেরেন। কিন্তু রাসেল আহমেদ খান কারো কাছ থেকে হাত পেতে কোনোদিন টাকা নেননি। শূন্য পকেটে প্রায়ই পল্টনের পার্টি অফিস থেকে পায়ে হেঁটে রামপুরার বাসায় যেতেন। কখনো হার মানেননি।
২৮ অক্টোবরও রামপুরা থেকে পায়ে হেঁটে প্রতিরোধ লড়াইয়ে পল্টনে আসতে চেয়েছিলেন। রামপুরা থেকে স্বাধীনতার পক্ষের একটি মিছিল আসছিলো পল্টনের দিকে। একা একা হেঁটে না এসে ওই মিছিলের পিছন পিছন হেঁটে চলে আসেন। সবাই যখন পল্টন মোড়ের এপারে থেকে ইট-পাথর-লগি-বৈঠা হাতে প্রতিরোধ করছিলেন জামাতীদের অস্ত্র-গুলি-বোমার হামলা, সাহসী বীর রাসেল তখন দৌড়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন অনেকটা। সিপিবি অফিস পার হয়ে একেবারে জামাতীদের মঞ্চের কাছাকাছি, কেবল একটা বাঁশের লাঠি হাতিয়ার করে। খুব কাছ থেকে জামাতীরা তাঁর মাথায় গুলি করে। কয়েকজন সহযোদ্ধা তাঁকে উদ্ধার করে সাংবাদিকদের গাড়িতে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ছোটেন। না, রাসেল সেদিনও হারেন নি। চিকিৎসকদের সমস্ত চেষ্টাকে পরাস্ত করে রাসেল নিজের জীবন দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে আরো এক বড় ধাপ পার করে দিয়েছিলেন।
সেই ধাপ পার হয়ে পরে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের সকল চক্রান্ত প্রতিহত করে আমাদের গণতন্ত্র আজ এক সংহত অবস্থায়। শহীদ রাসেল আহমেদ খান এখনো প্রতিবছর শুধু ২৮ অক্টোবরই নয়, সারাবছর আমাদের লড়াইয়ের মন্ত্র শোনান কানে কানে।
রাসেলের মৃত্যুর পরও আরেক নাটকের ঘটনা ঘটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওর মরদেহ ছিনতাই করতে চেয়েছিলো জামাতীরা। নিজেদের কর্মী বলে দাবি করে ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে রাসেলের মরদেহ ওরা দখল করে নিতে চেয়েছিলো। সশস্ত্র জামাত ক্যাডারদের হাত থেকে সেদিন একজন রেনু বেগম (ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন ঢাকা মহানগর নেতা, বর্তমানে মাদারীপুর জেলা নেতা) দুর্দান্ত সাহসে শহিদ রাসেলের মরদেহ রক্ষা করেছিলেন। এমন দুর্দান্ত সাহসী আরো কয়েকজন সেই মুহূর্তে মর্গের কাছে থাকলে হয়তো আরো সত্য প্রকাশিত হতো। জামাত-শিবিরের দাবি অনুযায়ী তাদের পক্ষের প্রকৃত লাশ হয়তো ৬টি থেকে আরো কমে যেতে পারতো। কারণ অস্ত্র-গুলি-বোমার বিরুদ্ধে কেবল লগি-বৈঠার প্রতিরোধের অসম লড়াইয়ের চিত্র এ ছাড়া আর কিই বা হতে পারে!
এ ঘটনার পরও খালেদা জিয়া তার বশংবদ রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সাথে মন্ত্রণা করে সাংবিধানিক বিধিবিধান পায়ে দলে ইয়াজউদ্দিনকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বসিয়ে দেন। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। গণআন্দোলনের মুখেই কেএম হাসান সরে দাঁড়ান। অপসারিত হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এমএ আজিজ। যদিও আরেক অসাংবিধানিক জগদ্দল পাথর ফখরুদ্দিন আহমেদকে পর্দার সামনে রেখে আবারো জলপাই রঙা ক্যামোফ্লেক্স বাহিনী দেশের ঘাড়ে চেপে বসে। তাদের আরো দুই বছরের শাসনাবসানে অবাধ শান্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্র ও জনগণের শাসনভার আসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ১৪ দলের হাতে। এ পথে নিশ্চিতভাবেই শহিদ রাসেল আহমেদ খানের রক্তের দাগ লেগে আছে। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের সেই খুনীদের বিচার এখনো অধরা রয়েই গেছে। আমরা সেদিনের সেই খুনীদের বিচার চাই।
২৮ অক্টোবরের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে জনগণের সেই প্রতিরোধ সংগ্রামকে বিএনপি-জামাত চক্র ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে চলেছে এই ১১ বছর ধরে দেশে-বিদেশে। জনতার প্রতিরোধ সংগ্রামকে দমন করতে তাদের অস্ত্র-গুলি-বোমার ব্যবহারকে আড়াল করে একে কেবল লগি-বৈঠার সহিংসতা বলে আখ্যা দেয় ওরা। সেই সময়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের (যদিও জনপ্রতিরোধে একতরফা সেই নির্বাচন আর আয়োজন করতে পারেনি বিএনপি-জামাত-ইয়াজউদ্দিন-এমএ আজিজ গং) প্রচারকাজে ‘সহিংসতার ভিডিওচিত্র’ বানিয়ে প্রচার করা হয়েছে গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-জনপদে। রাজধানীতে বিদেশি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সেই ‘বানানো ভিডিওচিত্র’ ওরা প্রদর্শন করেছিলো। এখনো সেখান থেকে স্থির চিত্র বানিয়ে বানিয়ে যখন যার প্রয়োজন, তার ছবি ফটোশপে সংযোজন করে অনলাইন-অফলাইনে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ওরা। রাজাকার কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠা মাত্রই ওই জঙ্গিবাদী গং তাদের কর্তব্য স্থির করতে দেরি করেনি। তাদের বিশ্বস্ত প্রচামাধ্যম দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই ওই আন্দোলনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত কেচ্ছা-কাহিনী প্রচার করা শুরু করে। এমনকি শাহবাগের সামনের সারিতে থাকার কারণে এই নিবন্ধের লেখকের বিরুদ্ধেও ওই ঘটনার সাড়ে ছয় বছর পরে এসে ‘লগি-বৈঠার সহিংসতার খুনী’ হিসেবেও সুপরিকল্পিত অপপ্রচার চালায় ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু সরকারপক্ষ বা আমাদের পক্ষ থেকে কর্তব্য স্থির করতে একটু দেরি হয়ে যায় বৈকি। ফলে শাহবাগের একেকজন নেতৃত্বকে রং মাখানোর পর পুরো আন্দোলনকেই রং মাখিয়ে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে এক নয়া জঙ্গি প্লাটফরমের জন্ম হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ফাঁসি ও কারাদণ্ড কার্যকর, ঘাতকের দল জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে কঠোর গণসংগ্রাম ও রাষ্ট্রীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে লাগাতার সহিংসতা ও জ্যান্ত মানুষ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার মতো নৃশংসতম বর্বরতা চালিয়েও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সরকারকে এক বিন্দুও টলাতে ব্যর্র্থ হওয়া, জঙ্গিবাদী আক্রমণে বিদেশি নাগরিক খুন করে বিদেশি রাষ্ট্র দিয়ে বাংলাদেশকে চাপের মধ্যে রেখে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টাটাও আপাত ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি কারণে শত্রুপক্ষ একটু ব্যাকফুটে। এই সময়ে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ওরা বারবার ২৮ অক্টোবরের ঘটনাকে ‘লগি-বৈঠার সহিংসতা’ আখ্যা দিয়ে সামনে নিয়ে আসতে চাইবে। তাই ওদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির একযোগে লড়াইটাই এখন কাম্য। কিন্তু সেটা এখনও নানা পক্ষের পাওয়া-না পাওয়া আর স্বার্থের হিসাব-নিকাশের খাতায় বন্দী।
এসব স্বার্থের দ্বন্দ্ব আর তত্ত্বকথার উর্ধে উঠে দেশের প্রয়োজনে, জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে যুথবদ্ধ লড়াই আবার চাঙ্গা হোক যে লড়াইয়ের মন্ত্র শিখিয়ে গেছেন শহিদ রাসেল আহমেদ খান। এই লড়াইয়ে হয়তো আবারো প্রাণনাশ হবে। আমাদের মধ্যে আরো কাউকে কাউকে হয়তো আবারো শহিদ রাসেলের সারিতে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু লড়াইটা জারি থাক। না হলে পুরো বাংলাদেশই তো শত্রুর হাতে জিম্মি হবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা, আমাদের কিংবদন্তীরা মুক্তিযুদ্ধ করে, মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে দেশের জন্য, অস্তিত্বের জন্য লড়াই করে গেছেন, প্রাণ বিলিয়েছেন হাজারে হাজার। আমরা তো সেই আদর্শে বলীয়ান। লড়াই থেকে আমরা পিছিয়ে আসব কেন? এ লড়াইয়ে যুথবদ্ধতা সন্নিবেশিত হোক।
কিন্তু যুথবদ্ধতার পথে আজ একটি বড় কাঁটা সুকৌশলে বিছিয়ে দেয়ার কাজ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। ২৮ অক্টোবর কিংবা তার আগে-পরের রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে যাদের একটি দিনের জন্যও দেখা যায় নি, সেই তারাই আজ শহিদ রাসেলদের রক্তমাখা গণতন্ত্র আর ক্ষমতার সুবিধা নিতে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। আমাদের নেতৃত্ব, আমাদের আইকনরা আজ সেই সুবিধাবাদীদের চক্রেই বন্দী। এই সুবিধাবাদী গোষ্ঠিই কিন্তু ওই আমলেও বিএনপি-জামাতের ক্ষমতাশালীদের কাছের লোক ছিলো। আর বিপরীতে সেদিনের রাজপথে রক্ত ঝরানো, ঘাম ঝরানো, লাঠিপেটা-টিয়ার শেল কিংবা রাবার বুলেটে বিক্ষত হওয়া পরীক্ষিত কর্মিরা এখন চরম মাত্রায় অবমূল্যায়িত। যারা সেদিন রাসেলের সহযোদ্ধা ছিলেন, পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছিলেন পল্টনের রাজপথে, ওই ঘটনায় যাদের জীবন আজ মৃত্যুকে সঙ্গি করে হেঁটে চলে প্রতিনিয়ত, তাদের অনেকেই আজ রাসেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে সামান্য স্মৃতিচারণ করার মতো সুযোগও পান না। আর যারা সেদিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে টেলিভিশনের পর্দায় পল্টনের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই সরাসরি সম্প্রচার দেখেছেন আর বিরক্তি ও আক্ষেপ নিয়ে বলেছেন, “এই দেশটা শেষ হয়ে গেলো, এদের দিয়ে আর কিচ্ছু হবে না”, তারাই আজ অনেক কিছু হবার দৌড়ে সামনের সারিতেই। হাজার প্রতিবাদ, হাজার গলা ফাটানোতেও কাজের কাজ কিচ্ছুটি হয় না। প্রতিবাদ করলেই মনে করা হয়, এই বোধহয় পাওয়া-না পাওয়ার ভাগিদার হতে চাইছে। কিন্তু এটুকু একটিবারের জন্যও বোঝার চেষ্টা করা হয় না যে সেদিনের রাজপথের যোদ্ধারা রাজপথেই থাকতে ভালোবাসেন, তারা কেবল পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে চান, এর বেশি কিছু নয়। উর্ধতনদের কানে জল ঢুকবে ঠিকই যেদিন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতিটি ঘটবে আর আগের সেই সুবিধাবাদীরা আবার তাদের পুরনো স্থানেই ফিরে যাবে।
ফলে যুথবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা প্রচণ্ডভাবে অনুভ‚ত হলেও তৃণমূলের ক্ষমতা নেই সেই মালা গাঁথার। মালাটি গাঁথুন, যারা সুঁচ-সুতো হাতে নিয়ে আছেন। না হলে বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে। লড়াইয়ের ময়দানে রাসেল হতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই, কিন্তু খালি মাঠে নিত্যনতুন জীবিত রাসেল যে তৈরি হচ্ছে, এসব জীবনের দাম কে দেবে?
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক নতুন কথা; প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী
বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]