শিরোনাম
নির্বিঘ্ন হোক পথচলা
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:২৭
নির্বিঘ্ন হোক পথচলা
আশিকুজ্জামান
প্রিন্ট অ-অ+

বিশ্ব যখন আধুনিকতায় ধাবমান, দেশ যখন উন্নতির মমহাসড়কে গতিশীল, তখন জীবনের গতিময়তা অনস্বীকার্য। জীবনের গতিময়তার যেমন রয়েছে বিচিত্র রকমফের, তেমন রয়েছে পথের। যে পথ চলার, সে পথ হতে হবে বন্ধুর, নিরাপদ।


আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অন্য সব পথের চেয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ শান্তিময় করাই ঢের চ্যালেঞ্জ। চারদিকে যখন বেসালাম পরিস্থিতির অস্থিতিশীল অশনির লাগাম টেনে ধরতে হিমশিম কর্তৃপক্ষ, তখন রাস্তাঘাটে চলাচলের নির্বিঘ্ন যাত্রার বেহাল অবস্থা বাকী অসংগতির সমর্থক।


দিবসকেন্দ্রিক আদর যত্ন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক ও অবিচ্ছেদ্য রীতি। সারা বছর শহীদ মিনার যখন বাঙালির পদধূলিতে দলিত-মথিত, তখন ফেব্রুয়ারি এলে পরে শুরু হয় ধোঁয়া মোছা আর নান্দনিক কারুকার্য। হ্যাঁ, যে পথের কথা বলছিলাম তা চলার পথ।


সড়ক, নৌ, আকাশ এই পথে প্রত্যেকের রয়েছে অনিবার্য সখ্যতা। রয়েছে নানা স্মৃতি বিস্মৃতি। মধুর স্মৃতি অজানায় থাকে, ভেসে উঠে বিভীষিকা দুঃসহ দুঃখের দৃশ্যপট। ধরুন, দু'দিন বাদে ঈদ আপনি ফিরছেন বাড়িতে, কোনো এক বাহনে চড়ে, স্বজনদের আবেগ উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। নিমিষেই টিভির স্ক্রল আপনার স্বজনদের দিলো যে তৈরি থাকতে হবে লাশ গ্রহণ করতে, সাথে দাফন-কাফনের সব ব্যবস্থা। এ চিত্রের বরণ করতে হয় বছরে অনন্ত দু'ঈদে শত পরিবারের। শুধু এ দেশে নয়, বিশ্বের বহু দেশ সড়ক দুর্ঘটনার অনিবার্য পরিণত বরণ করে আসছে স্মরণাতীত কাল থেকে।


২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। ১৯৯৩ সালের এই দিনে চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন এক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে নায়ক কাঞ্চন লড়াই করে যাচ্ছেন শান্তির পথচলা নির্বিঘ্ন করতে। তাঁর "নিরাপদ সড়ক চাই" সংগঠনের জোর দাবিতে সরকার ২২ অক্টোবর এই দিনকে "জাতীয় নিরাপদ সড়ক" দিবস ঘোষণা করেছে। তাঁর সংগঠনের বিস্তৃতি এখন দেশজুড়ে।


তবে কি শান্তির পথচলা এখন নির্বিঘ্নে?


প্রতিনিয়ত লাশ হতে হয় সড়ক পথে, এই পথেই হারিয়েছি আমরা মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদকে।


তবে দায় কার?


সহজভাবে যদি বলা হয় সরকারের দায়, তবে তা কোনো দিন সমাধানযোগ্য নয়। আপনি, আমি, আমরা সবাই আজ সমানভাবে দায়ী।


হতাহতের দায় নিয়ে দুষছে একে অন্যকে। পরিবহন মালিকরা বলছেন ড্রাইভারদের দায় অনেকাংশে, ড্রাইভার বলছে গাড়ির ফিটনেস ঠিক করার কাজ মালিকের। তবে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, যানবাহনের উচ্চগতি, নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, আইন প্রয়োগে অনীহা, সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও অসচেতনতাই দুর্ঘটনাকে তরান্বিত করে। বিভিন্ন গতির যানবাহন একই রাস্তায় চলাচল, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, চালকের মাদকাসক্ততা, ট্রাফিক সিগনাল না মানা, ড্রাইভার- মালিক আন্তরিকতার সম্পর্ক না থাকা, যানবাহনে অডিও সিডি প্লেয়ার চালানো, চালকের মোবাইল ব্যবহার, সড়কের বেহাল দশা, যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেয়া, চালক মালিকের অপরিমিত শক্তি, পথচারীর জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ তোয়াক্কা না করাকেই দুর্ঘটনার কারণ বলে মোটা দাগে বলছেন সড়ক বিশেষজ্ঞরা। তবে কোনো পক্ষেরই যে একদমই দায় নেই তা কোনো দাগেই বলা যাবে না।


অন্যদিকে সড়ক পথে যে অসংখ্য পরিবহণ শ্রমিকের প্রাণ যায় তা কেউ অস্বীকার করবে না।


নানা প্রতিষ্ঠানের করা পরিসংখ্যানে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র। এ পরিসংখ্যানে পিছিয়ে নেই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে ২১ হাজারের বেশি মানুষ। প্রতিবছর দেশের ক্ষতি হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ২ শতাংশ।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এআরআই বলছে, গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২৬,৬৮৬ জন।


পুলিশ দপ্তরের পরিসংখ্যানে ২০১৬ সালে ২,৫৬৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২,৪৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক পরিসংখানে দেখা যায়, গত ঈদুল আযহায় ২৭২ টি দুর্ঘটনায় ৩২২ জন প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে ৭৫৯ জন।


নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর হিসেব মতে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৪,১৪৪ জন, আহত ৫ হাজারের অধিক।


বেসরকারিভাবে করা পরিসংখ্যানগুলো মাননীয় সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এম.পি জাতীয় সংসদে অতিরঞ্জিত বলে মন্তব্য করলেও ঈদের আগের দিনগুলোতে মানুষের বাড়ি ফেরা নিরাপদ করতে রাস্তায় তাঁর কর্মতৎপরতা ভূয়ষী প্রশংসা পেয়েছেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সড়ক বিভাগ সরকারের কয়েকটি বিভাগের সমন্বয়ে দেখ ভাল করা হয়।


সড়ক দুর্ঘটনা ঠেকাতে যেমন সরকার বসে নেই, তেমনি নানা বেসরকারি সংগঠনের নানা আয়োজনে সচেতনতা বৃদ্ধির নানা অনুসঙ্গ বছরজুড়ে চোখে পড়ার মতো। তবে কেন থামছে না এ নির্মমতা? মৃত্যুর অনিবার্য পরিণতি বরণ করার বিভীষিকাময় এ পথের দুঃখ?


শুধু কি সড়ক পথ? রেল, নৌ, আকাশ সবখানে রয়েছে আমাদের বিস্মৃতি। পিনাক ৬ লঞ্চের নির্মম পরিণতি আজও কেউ ভোলেনি। নদী পথে নৌযানের সংঘর্ষ, নৌযান জট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নৌঘাঁটের কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকেরদের অপ্রত্যাশিত বিব্রতকর আচরণ যাত্রীদের নিত্য সঙ্গী।


স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বহনকারী বিমানের ত্রুটি দেখে আঁতকে উঠি। মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের নিহতের ঘটনায় চালককে শাস্তি ঘোষণার প্রতিবাদে দেশে পরিবহনখাতে যে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল তা দেশবাসী চাক্ষুষ সাক্ষী।


সমস্য সমাধানের দায় শুধু সরকারের একার নয়। সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের প্রবল সদিচ্ছাই পারে সমস্যাকে প্রকট থেকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে। দূরপাল্লার যানচালকদের বেতন-ভাতাসহ মোটিভেশনাল নানা প্রশিক্ষণ কাম্য। সড়কে খবরদারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত আন্তরিক তৎপরতা জরুরি।


আসুন, আমরা যার যার জায়গা থেকে আইন ও দায়বদ্ধতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। পথ হোক নির্বিঘ্ন, পরিচ্ছন্ন হোক গন্তব্য। শান্তিময় হোক পথচলা।


লেখক : শিক্ষার্থী ও সংগঠক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com