আমরা যেন ক্রমশ প্রকৃতির নিষ্ঠুর আচরণের মধ্যে পড়ছি। যেমন, কিছুদিন আগে সিলেটের হাওর এলাকায় ভয়াবহ বন্যা এসে ভাসিয়ে নিলো ক্ষেতের ফসল, বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড় ধসে প্রাণ হারালো অনেক মানুষ। আর দেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে বন্যা এখন যেভাবে আঘাত হানছে তাতে বিষয়টি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
কারণ অনুসন্ধানে এখন আর বিশ্নেষণের প্রয়োজন পড়ে না। আমরা সবাই জানি, আমরাই প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে নিষ্ঠুরভাবে বিঘ্নিত করছি, নদীতে বাঁধের পর বাঁধ দিয়ে নদীর গতিশীলতা বন্ধ করে দিচ্ছি, ভাটিতে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভারত। সম্ভবত এমন কোনোনদী নাই যেখানে তারা বাঁধ দেয়ন।
আর আমরাও নদী দখল ও দূষণে এগিয়ে আছি পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে। দেশে এমন কোনো নদী নাই যা আমাদের দ্বারা নষ্ট হয়নি। যার ফলে পানির কোনো চাপই নিতে পারে না এই নদীগুলো। আর এর ফলাফল ভোগ করতে হয় পুরো জাতিকে।
সম্প্রতি বানভাসি মানুষের দুর্ভোগের কিছু চিত্র দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিলো। কয়েক দিনের পরপর অফিস ছুটি থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে গিয়েছিলাম দিনাজপুরে ছোট ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে। তখনও জানতাম না যে দিনাজপুরে আমাদের জন্য কী চরম দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে।
১১ আগস্ট সন্ধ্যায় আন্তঃনগর ট্রেনে ভালোভাবেই পৌছালাম দিনাজপুর। ছোট ভাই রেল স্টেশন থেকে নিয়ে গেল শহরের উপকণ্ঠে তার বাসায়। প্ল্যান হলো, পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়বো দিনাজপুর শহর দেখতে। কিন্তু সকাল হতেই জানলাম নতুন এক খবর - শহরের পাশের নদীগুলোর পানি বাড়ছে হু হু কর।
সামান্য দূরেই নদী। গিয়ে দেখি, নিচু এলাকার প্রায় সব বাড়ীঘরে পানি উঠে গেছ। লোকজন বলাবলি করছে, উজানে সব বাঁধ খুলে দেয়ায় প্রচন্ড পানির চাপে অনেক জায়গার বাঁধ ভেঙ্গে গেছ।
কোথায়ও আর যাবার সুযোগ না থাকায় শহর ও তার আশপাশের এলাকাগুলো দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম শহরের উঁচু এলাকায় বেশ কিছু বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। আমার জানামতে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সবচেয়ে উঁচু জেলাগুলোর একটি দিনাজপুর। স্বাভাবিকভাবেই বন্যার প্রকোপ থেকে মুক্ত থাকে উত্তরবঙ্গের এ জেলাটি।
এর মধ্যে ১৪ তারিখ সকালের টিকিটও কিনলাম ঢাকায় ফেরার জন্য। ১২ তারিখ সন্ধ্যায় দেখলাম বানের পানি আমরা যেখানে থাকছি তার খুব কাছে এসে গেছে। পরদিন ১৩ আগষ্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসার সামনের অবস্থা দেখে আমার হতবাক হবার পালা। বাসার সামনের রাস্তায় থৈ থৈ পানি, একতলার টিনশেড বাসায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে, মানুষ যে যেভাবে পারছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছ। কেউ মালপত্র মাথায় নিয়ে কোমরপানি ভেংগে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছে।
সিদ্ধান্ত হলো, দ্রুত এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। ছোট ভাই চলে গেল শহরের কোন আবাসিক হোটেল পাওয়া যায় কিনা তা দেখার জন্য। এক ঘন্টার মধ্যে খবর পেলাম হোটেলের রুম ঠিক করা হয়েছে। ততক্ষণে বাসায় ভেতরে বন্যার পানি আরও বেশ খানিকটা ঢুকে পড়েছে।
যে যেভাবে ছিলাম ঠিক সেভাবেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্ত্রী আর দুই কন্যাকে নিয়ে পানির রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম মূল শহরের দিকে। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তা জীবনেও ভাবিনি, যদিও আমার গ্রামের বাড়ী মানিকগঞ্জ এলাকার সব জায়গাই বর্ষার সময় প্লাবিত হয়ে যায়। তবুও সেখানে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় না। কারণ সেখানকার সব মানুষই জানে বর্ষায় পানি আসবে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও নৌকার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা হয়। অন্যদিকে দিনাজপুরের মানুষ বন্যার সাথে খুব কমই পরিচিত। কেউ কেউ ১৯৮৮ সালে বন্যা দেখেছে কিন্তু এর পরে আর কখন্ও এমন বন্যার মুখোমুখি হয়নি।
এরই মধ্যে হাজার হাজার মানুষ শহরের উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। যারা দেখেননি তারা কল্পনাও করতে পারবেন না যে বানভাসি মানুষগুলো কি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে।
আবাসিক হোটেলে ওঠার পর জানতে পারলাম দিনাজপুর থেকে যাবার সব ট্রেন-বাস বন্ধ। মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পড়লো। আবার ছুটলাম রেল স্টেশনের দিকে, জানলাম সব টিকেট ফেরত নেয়া হচ্ছে। কারণ, ট্রেন লাইন ডুবে গেছে।
এরপর গেলাম বাস কাউন্টারগুলোর দিকে। সেখানেও একই অবস্থা, কেউ বাস চলাচলের সাহস পাচ্ছে না। কিছুটা সাহস পেলাম নাবিল কাউন্টারে যেয়ে, তারা জানালো ১৪ তারিখ সকালে তারা দু’টো বাস ছাড়বে তবে যেতে পারবে এমন নিশ্চয়তা নেই। তারপরও টিকেট কেটে নিলাম।
পরদিন সকালে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাস কাউন্টারে সবাইকে নিয়ে হাজির। অবশেষে বাস ছাড়লো সকাল ১০টায়, শহরের উঁচু রাস্তাগুলো ঘুরে পঞ্চগড় যাবার রাস্তায় উঠলো। বাস থেকে দেখলাম হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর রাস্তার দুপাশে শুধু পানি আর পানি, রাস্তার উপরই আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ভাবলাম, পানি তো রাস্তা ছুঁই ছুঁই করছে। রাস্তা ভেসে গেলে ওরা কোথায় উঠব? না, এভাবে আর ভাবতে ভাল লাগছিলো না। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারি তিনি যেন সবাই রক্ষা করেন।
অবশেষে রাত ১ টায় ঢাকা পৌছালাম। সাথে করে নিয়ে এলাম একরাশ করুণ অভিজ্ঞতা।
এসব কথা বলার এখন একটাই কারণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। ফেসবুকে একজনের বক্তব্য বেশ ভাল লাগলো, ’'বস্তুত দক্ষিণ এশিয়ার এইরূপ বন্যার কোন সমাধান নেই। নদীগুলোতে পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে না–মানবসৃষ্ট বাধার কারণে।
প্রকৃতির বার্তাটি কিন্তু অতি স্পষ্ট। হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত সবগুলো নদীর সকল বাঁধ, ড্যাম, জলবিদ্যুত কেন্দ্র ইত্যাদি তুলে নেয়া না হলে আগামীতে নেপাল-বিহার-আসাম-উত্তর প্রদেশ-পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের জন্য আরো ভয়াবহ ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে।
অনন্তকাল ধরে বছর বছর, ত্রাণ-পুনর্বাসনের গোলকধাঁধাঁ থেকে বেরিয়ে এসে– বন্যার আঞ্চলিক সমাধান খোঁজাই বেশি জরুরি।’
এ কথার সাথে আমি একমত, আপনিও একমত হন।
বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]