শিরোনাম
বাংলা সিনেমার হালচাল নিয়ে কিছু কথা
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০১৭, ২০:৪৫
বাংলা সিনেমার হালচাল নিয়ে কিছু কথা
আমিনুল হক পলাশ
প্রিন্ট অ-অ+

প্রথমেই বলে নিই আমি মোটেও কোনো সিনেমাবোদ্ধা নই। তবে বাংলা সিনেমার একজন মনোযোগী দর্শক। যে কোনো ভালো বাংলা সিনেমা আমি হলে গিয়ে দেখি। সুযোগ পেলে সিনেমা সংশ্লিষ্ট কারো কাছে ছবি সম্পর্কে মতামত কিংবা ভালো কাজের জন্য ধন্যবাদটুকু পৌছে দেয়ার চেষ্টা করি।


আমার ধারণা, আমার মতো দর্শকই বেশি- যারা আগপাছ না ভেবে নিখাদ বিনোদনের জন্যই সিনেমা হলে যান। ভালো সিনেমা হলে এই দর্শক শ্রেণী সিনেমা হলে যাবেই।


ঈদুল ফিতর হচ্ছে সিনেমা সংশ্লিষ্ট সবার জন্য সবচেয়ে বড় উপলক্ষ। পরিচালক কিংবা অভিনেতা অভিনেত্রীরা যেমন ঈদের সিনেমায় নিজের সর্বোচ্চ ভালো কাজটা দেয়ার চেষ্টা করেন, তেমনি হল মালিকরাও তাদের হলগুলো ধুয়ে মুছে তকতকে করে অপেক্ষা করেন দর্শকদের বরণ করে নেয়ার জন্য। তাছাড়া বর্তমানে বাংলা সিনেমা ইন্ড্রাস্টির যে অবস্থা, তাতে হল মালিকদের মূলত ঈদের ব্যবসা দিয়েই হল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয় পুঁজি তুলে আনতে হয়।


অথচ এবারের ঈদের আগে সিনেমা সংশ্লিষ্ট পজেটিভ আলোচনার চেয়ে বেশি হয়েছে নেগেটিভ আলোচনা। আলোচনার পুরোটা জুড়েই ছিলো যৌথ প্রযোজনার ছবি 'বস ২' ও 'নবাব' দেশে মুক্তি পাবে কি পাবে না তা নিয়ে। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি এবং পরিচালক-প্রযোজকদের একটা বড় অংশ উঠে পড়ে লেগেছিলো বাংলাদেশে সিনেমা দুটির মুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে।


যে সময় তাদের ব্যস্ত থাকার কথা ছিলো নিজেদের সিনেমা বানানো কিংবা অভিনয় নিয়ে, সেই সময় তারা ব্যস্ত ছিল অন্যের সিনেমাকে বাধাগ্রস্ত করতে। প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করেছি। সত্য বলতে কি আগামাথা কিচ্ছু বুঝিনি, তবে এতোটুকু নিশ্চিত হতে পেরেছি যে এই আন্দোলন থেকে আর যাই হোক বাংলা সিনেমার ন্যূনতম কোনো লাভ হবে না। অভিনেত্রী কবরী এই কারণেই বলেছেন, আন্দোলনকারীরা নিজেই জানে না তারা কেন আন্দোলন করছে।


আন্দোলনকারীদের ভাষ্যমতে, তারা বাংলা সিনেমাকে বাঁচানোর জন্য এই আন্দোলন করছেন। এখন কেউ যদি তাদের প্রশ্ন করে বাংলা সিনেমার জন্য তাদের অবদান কী বা তারা কী করেছেন? তাহলে তাদের মুখখানা বেদান হয়ে যাবে। এবারের ঈদে তাদের কার কী সিনেমা যাচ্ছে, হল মালিকরা কী চালিয়ে তাদের হল টিকিয়ে রাখবেন এর কোনো সদুত্তর তাদের কাছে নেই। তারপরও তারা স্বঘোষিত রক্ষাকর্তা হয়ে দাড়িয়েছেন বাংলা সিনেমার।


শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ঈর্ষা, প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে একটা গোষ্ঠী যেভাবে তাদেরই অন্য সহকর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোদাগার করছেন, তাতে তারা পর্দার না, বাস্তবেরই ভিলেন হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছেন। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো, এই আন্দোলনে সিনিয়র অনেক শিল্পী এক পক্ষের হয়ে কাজ করছেন, অথচ উনাদের অভিভাবক হয়ে সবাইকে আগলে রাখার কথা ছিলো!


দলের সবচেয়ে ভালো কিংবা সবচেয়ে কুশলী খেলোয়াড়টিই অধিনায়ক হয়। হয় তার নিজের পারফরমেন্স সবেচেয়ে ভালো হবে অথবা তার অনুপ্রেরণায় বাকিরা নিজেদের বেস্ট পারফরমেন্স দেবে।


চলচ্চিত্র শিল্প পরিবারের ব্যানারে আন্দোলনের কর্তাব্যক্তিদের দিকে তাকালেই আন্দোলনের হালহকিকত সম্পর্কে বোঝা যায়। মিশা সওদাগর লাস্ট কবে ভালো সিনেমা দিয়েছেন, এটা তিনি নিজেও হয়তো ভুলে গেছেন। এদিক থেকে জায়েদ খান ভালো পজিশনে আছেন। তার ভুলে যাবার কিছু নেই। কেননা তিনি জীবনেও ভালো কোন দর্শনযোগ্য সিনেমা দেননি।


রিয়াজ কিছুদিন আগে নিজেই এক টকশো তে বলেছেন তার বেইল নাই, তাই তাকে কেউ সিনেমায় নেয় না, তাই নাটক করেন। এখন তিনি নিজেই নেতা সেজে বাংলা সিনেমা বাঁচাচ্ছেন, যে কিনা ভালো ব্রেক পাবার পরেও নিজের ক্যারিয়ারটাই বাঁচাতে পারেননি।


সবচেয়ে আইরনি হলো, স্বয়ং ডিপজলও এখন নিজেকে বাংলা সিনেমার রক্ষাকর্তা ভাবছেন। যেখানে ডিপজলের মতো রক্ষাকর্তা আছেন, সেখানে ধ্বংস হবার জন্য আর কোনো ইলিমেন্টের তো দরকার নেই।


সাধারণ দর্শক কিন্তু যৌথ প্রযোজনা, যৌথ প্রতারণা, নায়ক নায়িকার ভারসাম্য এতোকিছু ভেবে সিনেমা দেখতে যায় না। মানুষ যায় বিনোদন নিতে। ভালো সিনেমা হলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে সিনেমা হলে। আয়নাবাজিই এর বড় প্রমাণ। শতভাগ দেশী সিনেমা। বিদেশী অভিনেতা নেই, বিদেশে চিত্রায়ন নেই। তাও দিনের পর দিন ব্যবসা করেছে। প্রথম দিকে অনেক বেশি হল পায়নি, পরবর্তীতে হল মালিকরাই বুকিংয়ের পেছনে ছুটেছে।


এর রেশ এখনো কাটেনি। এই ঈদেও তৈরি হয়েছে আয়নাবাজি অরিজিনাল সিরিজ নামের ড্রামা সিরিজ। এটার উদাহরণ দিলাম এই জন্য যে দর্শকদের কাছে পৌছানোর জন্য ভালো কাজই শেষ কথা। 'বস ২' এবং 'নবাব' সিনেমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সিনেমা দুটির ট্রেলার এবং প্রমো গান বের হবার পরেই বোঝা যাচ্ছিলো এ দুটি ছবি বিশেষ কিছু হতে যাচ্ছে। সিনেমা দুটি দেখতে হলগুলোতে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়, টিকেটের জন্য হাহাকার, ভাংচুর এসবই প্রমাণ করে দর্শকরা কতটা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলো সিনেমা দুটির জন্য।



আন্দোলনকারীরা এই সিনেমা দুটি প্রদর্শন বন্ধের আন্দোলন না করে এই কোয়ালিটির আরো দুই চার পাঁচটা ছবি বানালেই বরং সেটা সুস্থ প্রতিযোগিতা হতো, সিনে ইন্ড্রাস্টির লাভ হতো, আমরা সাধারণ দর্শকরা উপকৃত হতাম।


যৌথ প্রযোজনার ছবি সময়ের দাবি। এর নীতিমালা, আইন কানুন দেখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ আছে, তারাই দেখবে। জোরপূর্বক আন্দোলন করে এভাবে থামানোর আসলে কোনো সুযোগ নেই। মানুষজনের কাছে এখন প্রচুর অপশন। স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইউটিউবের এই যুগে জোর করে যেমন কাউকে কিছু দেখানো সম্ভব নয়, তেমনি বাঁধা দিয়ে থামিয়েও রাখা যাবে না। যারা সিনেমায় টাকা লগ্নি করে তারা লাভের জন্যই করা। যেভাবে ম্যাক্সিমাম লাভ পাবে তারা সেটাই করবে। কেই বা পরাজিত দলের সদস্য হতে চায়!


এখন হলিউডের অনেক মুভি মুক্তির প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশের সিনেপ্লেক্সগুলোতে প্রদর্শিত হয়। কই সেসবের বিরুদ্ধে তো আন্দোলন হয় না। 'বস ২' ছবির ব্যাপারে বলি, 'বস' ছবি কলকাতার হলেও মোটামুটি বাংলা সিনেমা দেখে এমন কেউই বাকি নেই এটা দেখার। তাই 'বস ২' নিয়ে কমবেশি অনেকেরই আগ্রহ ছিলো। এটা যদি বাংলাদেশে মুক্তি না পেত তাহলে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মাঝেই এটা অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে যারা দেখার অবশ্যই দেখতো। এখন এটা বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়ায় ১২০ এর অধিক সিনেমা হল হাউজফুল বিজনেস করছে। আরো বেশ কিছুদিন করবে। এতে তো আমাদের হল মালিকরাই লাভবান হলেন। হল না টিকলে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি টিকবে না, সহজ হিসাব। আন্দোলনকারীরা বাংলাদেশের হল টিকিয়ে রাখার জন্য কী করছেন, কয়টা ছবি দিচ্ছেন বছরে?


শাকিব খান আর জাজ মাল্টিমিডিয়াকে বহিষ্কার করেছে আন্দোলনকারীরা। কী হাস্যকর ব্যাপার! আন্দোলনকারীদের একজন ও কি বলতে পারবেন যে, তারা এদের বিকল্প হবার যোগ্যতা রাখেন? গত এক দশকে এ দেশের হলগুলো টিকিয়ে রেখেছে শাকিব খান নামটি। তার অভিনয় আপনার পছন্দ হোক বা না হোক, তাকে পছন্দ করেন বা না করেন এই সত্য অস্বীকার করতে পারবেন না। টিভি চ্যানেলগুলোয় এখনো ঈদে শাকিবের ছবিই চালানো হয়, মফস্বলের হলগুলো এখনো ঈদে শাকিবের পুরনো ছবি দেখিয়েই ব্যবসা করে, গ্রাম গঞ্জের চায়ের দোকানে শাকিবের ছবিই দিনভর চালানো হয়। আর তাকেই কিনা বহিষ্কার করা হলো?


এখন পর্যন্ত বস ২ এবং নবাবের যেসব রিভিউ পড়েছি তা থেকেও বোঝা যাচ্ছে, শাকিব কলকাতার জীৎকেও সমানতালে টেক্কা দিচ্ছেন তার অভিনয়, স্ক্রিন প্রেজেন্স দিয়ে। আর এই শাকিব খানকে বহিষ্কার করে বাংলা সিনেমার কী উপকারটা হবে আমার বোধগম্য হচ্ছে না।


অন্যদিকে জাজ এর কল্যাণে এদেশের দর্শকরা প্রথম ঝকঝকে প্রিন্টের ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছে। এদেশে সিনেমা ব্যবসায় তাদের লগ্নি ৭০ কোটি টাকার উপরে। কই আর কেউ তো এই মৃতপ্রায় ইন্ডাস্ট্রিতে এর অর্ধেক টাকাও লগ্নি করেনি। এদের বিকল্পটা তাহলে কী?



বাংলা সিনেমা ভালো অবস্থায় নেই। চাতক পাখি যেমন এক ফোটা বৃষ্টির জন্য হা করে অপেক্ষা করে থাকে তেমনি দর্শকরাও সারাবছর অপেক্ষায় থাকে একটা ভালো সিনেমার জন্য। অথচ এই সিনেমা শিল্পেও আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ছিলো। সেই গৌরবের ধারক বাহকরা যখন নিজেদের আসল কাজ ফেলে একে অন্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আমাদের মতো সাধারণ দর্শকদের হতাশ হওয়া ছাড়া কোনো গতি থাকে না।


সিনেমা নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সবার সুমতি হোক, এই অচলাবস্থার অবসান ঘটুক, প্রচুর ভালো সিনেমা তৈরি হোক, সিনেমা হলগুলো বাঁচুক, বাঁচুক বাংলা সিনেমা।


বাংলা সিনেমার জয় হোক।


বিবার্তা/পলাশ/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com