শিরোনাম
এরশাদ যেভাবে আছেন
প্রকাশ : ১৩ জুন ২০১৭, ১৭:৩৮
এরশাদ যেভাবে আছেন
জাহিদ বিপ্লব
প্রিন্ট অ-অ+

নব্বইতে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। বলা হয়, সেদিন আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করলে এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হতো না, কিন্তু এতে ব্যাপক রক্তপাতের সম্ভাবনা ছিলো। তাই এরশাদ সেদিন বিরোধী জোটের চাহিদা মোতাবেক বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।


অনেকে ভেবেছিলেন, এরশাদের রাজনীতি বুঝি ওখানেই শেষ। কিন্তু ওই ভাবনা যে সত্য ছিল না, ইতিহাস তার সাক্ষী।


এরশাদ সেদিন ভেবেছিলেন, আমি রাষ্ট্রে যে পরিবর্তন এনেছি, তাতে নির্বাচনের মাধ্যমেই আবার আমি ক্ষমতায় আসতে পারবো।


কিন্তু প্রথমেই গ্রেফতার ও কারাবন্দী করা হলো এরশাদকে। রেহাই দেয়া হলো না তার স্ত্রী ও চার বছরের শিশু সন্তান শাদ এরশাদকেও। কথা ছিলো সবাইকে সমানভাবে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে দেয়া হবে। কিন্তু দেশ ও মানবতার শত্রু জামায়াতও রেডিও-টেলিভিশনে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারলেও জাতীয় পার্টিকে প্রচারে অংশ নিতে দেয়া হলো না। পার্টির মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে শীর্ষ সকল নেতার বাড়িতে হামলা হলো, চালানো হলো লুটপাট। জাতীয় পার্টির প্রতিটি নির্বাচনী মিছিলে চালানো হলো সশস্ত্র হামলা। প্রতিবাদ করার যেন কেউ নেই।


এমনি অবস্থায় শেষ হলো ১৯৯১-এর নির্বাচন। এই প্রতিকূল অবস্থায়ও ৩৫ আসন পেয়ে ১৮শতাংশ ভোট পেলো জাতীয় পার্টি। জেলে থেকেই পাঁচটি আসনে জয়লাভ করলেন এরশাদ।


১৯৯১ থেকে '৯৬ - এই পাঁচ বছর হামলা-মামলায় জর্জরিত হলো জাতীয় পার্টি। ৬২টি মামলা দেয়া হলো এরশাদের বিরুদ্ধে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও তত্বাবধায়ক সরকার বিমাতাসূলভ আচরণ করলো জাতীয় পার্টির সাথে। সেবারও নির্বাচনী প্রচারনায় এরশাদসহ জাতীয় পার্টির কোন নেতাকে অংশ নিতে দেয়া হলো না। অই নির্বাচনেও বন্দী এরশাদ আবারও পাঁচটি আসনে জয়ী হলেন।


নির্বাচনে কেউ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলো না। শুরু হলো সরকার গঠনের প্রতিযোগিতা। সে নির্বাচনে বিএনপি পেল ১১৬টি আসন, আওয়ামী লীগ ১৪২টি, জাতীয় পার্টি ৩২টি, জামায়াত ১৪টি। বিএনপি তখন পুনরায় ক্ষমতায় থাকার জন্য রাতের আধারে নাজিম উদ্দিন রোডের কারাগারে এরশাদকে প্রস্তাব দিলো বিএনপিকে সমর্থন দেয়ার জন্য। বিনিময়ে সকল মামলা প্রত্যাহার এমনকি আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে সরকার গঠনেরও প্রস্তাব দেয় বিএনপি। এ প্রস্তাব নিয়ে যান জাতীয় পার্টির নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশিদ ও তাজুল ইসলাম চৌধুরী। ইতিহাস ব্রেক করে শুধুমাত্র সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য জেলখানায় অনুষ্ঠিত হলো দলের প্রেসিডিয়াম সভা।
কিন্তু বাধ সাধলেন দলের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সরকার গঠনের কয়েকদিন আগে আলোচিত পীর শের-ই-খাজার ধানমণ্ডির বাড়ীতে বৈঠকে বসেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী ও মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সে বৈঠকে মিজান চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করা টোপ দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং মহাসচিবের কথায় আওয়ামী লীগকে সমর্থনের ঘোষণা দেন এরশাদ।


পাঁচ বছরেরও অধিক সময় জেলে থেকে মুক্তি পান এরশাদ। মুক্তি পাওয়ার পর মানিক মিয়া এভিনিউতে বিশাল জনসভায় সম্বর্ধনা দেয়া হয় এরশাদকে। কিন্তু এই জনসভা সুখকর হয়নি। দলের এক নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জু আরেক প্রবীণ নেতাকাজী জাফরের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। সরকারের খুব ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় সে মুহুর্তে নাজিউরের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি এরশাদ।


আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে দেয়া হয় মন্ত্রীত্ব। বিরোধী দলের মহাসচিব হয়ে সরকারের মন্ত্রীত্ব নেয়ায় বিব্রত হতে হয় এরশাদকে। একপর্যায়ে মঞ্জুকে মন্ত্রীত্ব দেয়া বাদ দেয়ার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন এরশাদ। এতে ক্ষুব্ধ হন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এরশাদ সম্পর্কে প্রকাশ্যেই বিরূপ মন্তব্য করেন তিনি। এক পর্যায়ে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় মঞ্জুকে। মঞ্জুও এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে মিজান চৌধুরীকে নিয়ে আরেকটি জাতীয় পার্টি গঠন করেন। এতে সরকারের প্রকাশ্য ইন্ধন ছিলো বলে জাপা নেতাদের দাবি। এরপর এরশাদ প্রকাশ্যেই বলেন, ''আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়ার প্রতিদানে আমার দল ভেঙ্গে দিলো।''


২০০১-এর নির্বাচনের আগে সরকারের বিভিন্ন অনিয়মের সমালোচনা করেন এরশাদ। একপর্যায়ে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটে যাওয়ার ঘোষণাও দেন। সরকার বিষয়টিকে সহজভাবে নেয়নি। হঠাৎ করে একটি দুর্নীতি মামলায় এরশাদকে সাজা দেয়া হয় আর নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। সরকারের চাপে চারদলীয় জোট ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ।


২০০৭-এর নির্বাচনের আগে আবারও টানাটানি শুরু হয় এরশাদকে নিয়ে। সেসময় প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতির কারণে বিএনপিকে সমর্থন না দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৪দলকে সমর্থন দিয়ে এক মঞ্চে উঠেন এরশাদ। আর ১৪ দলীয় জোট বাতিল করে হলো মহাজোট। লিখিত চুক্তি হলো মহাজোট ক্ষমতায় এলে এরশাদকে রাষ্ট্রপতি করাসহ জাতীয় পার্টিকে সমানুপাতিক হারে মন্ত্রীত্ব দেয়া হবে।


এবার ক্ষমতাসীন বিএনপিও এরশাদের এ বিষয়টিকে সহজভাবে নেয়নি। এবারও হঠাৎ করে একটি মামলার রায় দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য করা হয় এরশাদকে। এতে ফুসে উঠে রাজনীতির ময়দান। চলতে থাকে একের পর এক সহিংসতা। যার ফলে আসে ১/১১।


দুই বছর পরোক্ষ সেনা শাসনের পর নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে জয়লাভ করে মহাজোট। কিন্তু মহাজোট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হলো না জাতীয় পার্টির। এরশাদের সহোদর জিএম কাদেরকে নামে মাত্র মন্ত্রীত্ব দেয়া হলেও দলের আর কোন নেতাকর্মীকে কোন ধরণের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলো না। মহাজোটের অংশীদার হওয়া সত্বেও সারাদেশে দলীয় নেতাকর্মীদের ক্ষমতাসীনদের দ্বারা অপমান ও অপদস্থ হতে হয়েছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্তেও জাতীয় পার্টি বা এরশাদের কোন মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি আওয়ামী লীগ।


২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি নিজ সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিলে দেশের সিংহভাগ রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি এরশাদও নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেন। এতে বেকায়দায় পড়ে সরকার। সরকার এ নির্বাচনে বৈধতা পাওয়ার জন্য এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলুকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে। এরশাদ নির্বাচন বয়কট করার জন্য প্রার্থীদের নির্দেশ দিলেও রওশন-আনিস-বাবলু মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করার জন্য দলীয় প্রার্থীদের নির্দেশ দেন।


নির্বাচনের কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই অসুস্থতার নাম করে এরশাদকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকেও মুঠোফোনে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেন এরশাদ। নেতা এরশাদের এ অনুরোধে রাতারাতি ২১৭জন প্রার্থী তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেন।


বিবার্তা/বিপ্লব/হুমায়ুন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com