শিরোনাম
অটিজম : প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা
প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০১৭, ০১:২২
অটিজম :  প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা
মো. জাহাঙ্গীর আলম
প্রিন্ট অ-অ+

রাফির বয়স ছয়। আড়াই বছর বয়স থেকে তার আচরণে কিছু অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত কারো সাথে সে মিশতে চায় না এবং সবাইকে এড়িয়ে চলে। ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করে। এখন সে তার ভাই-বোনদের সাথেও মিশতে লজ্জা পায় এবং তাদের অপছন্দ করে। কারো সাথে খেলতে চায় না। সারাদিন একাই থাকে। রাফির মা-বাবা অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েছেন, তাতে কোনো লাভ হয়নি।


অনেকে বলে রাফি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। সে আর ভালো হবে না, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। আসলে রাফি অন্য শিশুদের মতো স্বাভাবিক আচরণ করে না। সে অটিস্টিক। আমাদের দেশে রাফি’র মতো অসংখ্য শিশু রয়েছে, যাদের আচরণে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো নানাভাবে পরিলক্ষিত হয়। শুধু সঠিক তথ্য না জানার কারণে দেশে আজ হাজার হাজার শিশু অটিজমে আক্রান্ত। পরিবারের সব সদস্য আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের একটু ভালোবাসা এবং পরিপূর্ণ পরিচর্যা পেলে শিশুটি আজীবন বোঝা হয়ে থাকবে না।


প্রত্যেক মানুষকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানা অধ্যায় অতিক্রম করতে হয়। একজন স্বাভাবিক মানুষকে সামাজিক, পারিপার্শ্বিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও আচরণগত অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে নিজেকে তৈরি করতে হয়। একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর স্বাভাবিক আচরণের জন্যও এ সব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে। যা তার পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বা সমাজ তৈরি করে দেবে।


অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয়, তাই অটিজম বৈশিষ্ট্যের শিশুকে পরিবার ও সমাজের বোঝা মনে করা ঠিক নয়। বরং অটিস্টিক শিশুকে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। মস্তিস্কের অস্বাভাবিক বায়োজুলজি ও কেমিস্ট্রির সৃষ্ট সমস্যা হচ্ছে অটিজম। ঠিক কী কারণে অটিজম হয় তা নিয়ে গবেষণা চলছে। এই সমস্যার সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। শিশুর মাঝে এই বৈশিষ্ট্য দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিশুটির সাথে কথা বলার মাধ্যমে, পড়ানোর সময়, সামাজিক বন্ধনে, খেলার ছলে বিভিন্ন বিষয় শেখাতে হবে। তাকে যতটা সম্ভব হাসি-খুশি রাখতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অটিস্টিক শিশুরা অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এরা সাধারণত ছবি আঁকায়, গানে, গণিতে এমনকি কম্পিউটারে প্রচণ্ড দক্ষ হয়ে থাকে।


এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় চল্লিশ হাজারের বেশি অটিস্টিক শিশু রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে এই হার ২.৮৭ শতাংশ। সংখ্যার বিবেচনায় খুব বেশি না হলেও সামাজিক বিবেচনায় এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা। আমাদের দেশের বিবেচনায় অটিজম একটি আজীবন পরিস্থিতি। পরিবার ও সমাজ অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলে। যা ওই ব্যক্তিকে আজীবনের জন্য একটি বোঝা হিসেবে বিবেচনা করে। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ এই পরিস্থিতির শিকার। অনেক দেশ ও সমাজে অটিজম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় সারা জীবনের জন্য একজন ব্যক্তিকে এই বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। আর অটিজম সম্পর্কে ধারণা ও সচেতনতা থাকলে শিশুটি একটি সুন্দর জীবন পেতে পারে।


অটিজম বৈশিষ্ট্যের শিশু পরিবার ও সমাজ থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। সে কারো সাথে খুব একটা যোগাযোগ করতে পারে না। অনেক সময় সে নিজের কথাও কারো কাছে বলতে বা বিনিময় করতে পারে না। মোট কথা, সে নিজের মতো একটা জগৎ তৈরি করে রাখে। কাজেই এ শিশুদের একটি ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ তৈরিতে আমাদের অতিরিক্ত সময় ও শ্রম দিতে হবে। তার জন্য আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে।


বিশেষ বৈশিষ্ট্যের শিশু বা ব্যক্তিবর্গ পারিবার থেকে অবহেলার শিকার হলে আরো প্রতিকূলতা তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞগণ বলেন যে, অটিস্টিক শিশুদের প্রধানত তিনটি ক্ষেত্র বা জায়গায় সমস্যা সৃষ্টি হয়- সামাজিক, ভাষা ও আচরণগত। এসব ক্ষেত্রে যে সমস্যা হয় তা পারিবারিক ও সামাজিক উদ্যোগে সারানো সম্ভব। পরিবারে সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের যত্ন, স্নেহ ও ভালোবাসায় শিশুদের স্বাভাবিক জীবনধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব। অটিস্টিক শিশুদের পরিপূর্ণ পরিচর্যার কোনো বিকল্প নেই। ধীরে ধীরে তাকে উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন বাংলাদেশের অটিজম এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অটিজম বৈশিষ্ট্যের শিশুদের নিয়ে আমাদের দেশে ইতোপূর্বে খুব বেশি কাজ না হলেও বর্তমানে এর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অটিজম ও নিউরো ডেভেলাপমেন্ট ডিজঅর্ডার বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি, একাধিক মন্ত্রণালয় নিয়ে গঠিত স্টিয়ারিং কমিটি এবং অভিজ্ঞ, প্রফেশনাল ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে গঠিত টেকনিক্যাল গাইডেন্স কমিটি গঠন করে অটিস্টিক ব্যক্তিদের উন্নয়নসহ বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে অটিজম ও স্নায়বিক বিকাশজনিত সমস্যা সমাধানে কাজ করছে।
-২-
২০০৭ সালে জাতিসংঘের ৬২তম সাধারণ অধিবেশনে অটিজম সম্পর্কে বিশ্বে ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ২০০৮ সালের ২ এপ্রিল থেকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ পালন হয়ে আসছে। বাংলাদেশও প্রতিবছর এই দিবসটি যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করে।


অটিজম বৈশিষ্ট্যর শিশুর সার্বিক উন্নয়নে সচেতনতাই মুখ্য। পরিবার ও সমাজের সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। সঠিক পরিচর্যা ও মানুষের ভালোবাসাই পারে এ থেকে মুক্তি দিতে। অটিজম বৈশিষ্ট্যর শিশুর পরিচর্যায় তার কাছের মানুষরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই সবার আগে পরিবার-পরিজনকে অটিজম সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের আছে সর্বক্ষেত্রে সমানভাবে অংশগ্রহণ ও অধিকার ভোগ করার। পরিবার ও সমাজে মানুষের ইতিবাচক মনোভাব ও সচেতনতাই পারে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুকে একটি সুন্দর জীবন উপহার দিতে।


বিবার্তা/পলাশ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com