শিরোনাম
নিজেকে নায়ক না, মনে হলো মহানায়ক
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০১৭, ১৫:৪৪
নিজেকে নায়ক না, মনে হলো মহানায়ক
চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির
প্রিন্ট অ-অ+

সেদিন কিছু পুরানো দরকারি কাগজ-পত্রের সন্ধান করতে যেয়ে হাতড়ে হঠাৎ ২০০৪ সালের ১৯ মার্চের কিছু ছবি পেয়ে যাই। ছবিগুলো আমাকে স্মৃতির অতল মহাসাগরে ডুবিয়ে দেয়।


ফেণী জেলায় সাত মাস প্রবেশন পিরিয়ড বাদ দিলে পুলিশ বিভাগে আমার কর্মকাল শুরু হয়েছে অ্যাডিশনাল এসপি হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর। পদোন্নতি পেয়ে চিটাগং জেলায় অ্যাডিশনাল এসপি(নর্থ)হিসেবে ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, মিরেরসরাই, সীতাকুণ্ড ও সন্দ্বীপ থানার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পাই। চৌদ্দ বছর আগের ঘটনা, ২০০৩ সালের আগস্ট মাসে জামালউদ্দিন নামক ব্যবসায়ী অপহরণ ও গুমের ঘটনায় সমগ্র চিটাগং জুড়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ তীব্র সুনামির ঝড় বইছিল।


বন বিভাগের সহকারি বন সংরক্ষকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আমার সহকারি পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো কতিপয় হিন্দি সিনেমার অশুভ(?) প্রভাব। যে সিনেমাগুলোতে পুলিশ কর্মকর্তা নায়ক তার নায়োকোচিত বীরত্ব দিয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যায়। তবে চেহারা-ফিগারের যে হাল-হকিকত, তাতে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে এর থেকেও খারাপ না করে দুনিয়ায় প্রেরণের জন্যে কোটি-কোটি বার শোকর গুজার করার বাইরে নিজেকে ‘হিরো মঞ্জুর’ ভাবা তো দূর কি বাত, হিরোর চামচা হিসেবে কল্পনা করাও রীতিমত ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। ফলে পর্দার হিরো হওয়ার তুলনায় রিয়্যাল অ্যাকশন হিরো হওয়া সহজ ভেবে হিরো হওয়ার নেশায় আমাকে পেয়ে বসেছিল। আশা ছিলো, কোনো না কোনো প্রযোজক-পরিচালক আমার জীবনী নিয়ে সিনেমা বা কিছু একটা বানাবে। প্রতিটা কর্মস্থলেই নিজের স্বকীয়তা দেখিয়ে চাকরি করে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করলেও আমার সেই আশার শিঁকে এতোটাই শক্ত ও মোটা নাইলনের দড়ি দিয়ে বানানো যে, অদ্যাবধি সেই শিঁকে তো ছেঁড়েইনি, ভবিষ্যতেও কোনোদিন যে তা ছিঁড়বে না, তা আমি দুই চোখ বন্ধ করে হলফ করে বলে দিতে পারি। তবে কেউ কখনো আমার জীবন-বৃত্তান্ত নিয়ে বাংলা-হিন্দি-তামিল-গুজরাটি এমনকি কোনো আঞ্চলিক ভাষায়ও সিনেমা বানানোর কথা না ভাবলেও সাতক্ষীরার সর্বস্তরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বাংলা ও হিন্দি সিনেমা জগতের জীবন্ত কিংবদন্তী শ্রদ্ধেয় মিঠুন চক্রবর্তীর ফাটাকেষ্ট সিনেমার সাথে আমার কার্যকলাপের মিল খুঁজে পেয়ে, আমার পিতা-মাতা কর্তৃক আকিকার মাধ্যমে প্রদত্ত নামটা পাল্টিয়ে আমার নাম দিয়ে দেয় ‘ফাটাকেষ্ট’। লে হালুয়া- একে তো কেষ্ট, তাও আবার ফাটা! যাক বাবা, তবুও সান্ত্বনা এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত কিছু না কিছু তো পাওয়া গেলো! তা সে ফাটাই হোক আর ফুটোই হোক!


চিটাগং জেলায় অ্যাডিশনাল এসপি (নর্থ) হিসেবে কর্মকালে আমি ববি দেওলের (ওই ব্যাটা কিন্তু আমার পছন্দের নায়ক নন) কোনো একটা হিন্দি সিনেমার (নাম মনে নেই) দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম, যেখানে ববি দেওলকে খারাপ লোক ধরেই ‘নো ওয়ারেন্ট, নো অ্যারেস্ট, নো টক – ফয়সালা অন দ্য স্পট’ বলেই প্যাঁদাতে দেখা যায়। চিটাগং জেলায় মাত্র নয় মাসের কর্মকালে যেমন পেয়েছি সফলতা, তেমনি ছিলো চিটাগং উত্তর জেলার বিশেষ করে ফটিকছড়ি, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ার জনগণের বুক ভরা ভালোবাসা ও প্রাণ খোলা আশীর্বাদ। যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী হুমকী-ধামকি এবং শেষ পর্যন্ত মামলা করেও আমাকে এক বিন্দুও ভীত-সন্ত্রস্ত করতে পারেনি। কেনোই বা পারবে? নিজেকে তো নায়ক ভাবতাম; নায়করা কি কখনো ভয় পায়?। তবে সিনেমার নিয়ম অনুযায়ী নায়কের পরিবারবর্গ কিন্তু ঠিকই ঠ্যালা কাহাকে বলে, কতো প্রকার ও কি কি উদাহরণসহ বুঝতে পেরেছেন। উনারা হিরোর মতো সাহসী ও ড্যাম কেয়ারিং (নাকি আবাল?) হলে হিরোকে তখন চাকরি-বাকরি খুইয়ে প্রডাকশন বয় হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করতে হতো। সেই ঠ্যালা সামলানোয় আমার তৎকালীন পুলিশ সুপার এবং বর্তমানে ডিআইজি (অপারেশন্স) হিসেবে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান, পিপিএম মহোদয়ের অবদান অস্বীকার করলে তো আমি দুনিয়ার সেরা বেঈমান হয়ে যাবো।


ধুত্তরি! আজ আমিতো ‘সন্ত্রাস দমনের ইতিবৃত্ত’, বা ‘আমার দেখা চট্টগ্রাম জেলা’বা এ জাতীয় কোনো লেখা লিখতে বসিনি। যে জন্যে লিখতে বসেছি তা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ভুলবোই বা না কেনো? চিটাগং জেলায় আমার নয় মাসের কার্যকাল যে মহাকাব্যের ছন্দে সাজানো অনেক গল্পের সমষ্টি। যদি কোনোদিন সময়-সুযোগ পাই, তাহলে সেই গল্প-সমষ্টি আপনার সামনে হাজির করে আপনার দর্শন যন্ত্রে কিঞ্চিৎ যন্ত্রণা প্রদানের হুমকী প্রদান করছি। তবে আমার লেখার (এমনকি বক্তৃতারও) মূল সমস্যা কিন্তু একটাই, যা আগেও ছিলো, এখনো আছে এবং আমি নিশ্চিত যে তা ভবিষ্যতেও থাকবে- আর তা হলো হিউমার বা রসবোধের নামে কঠিন সিরিয়াস বিষয়গুলোকে তরল বা বায়বীয় করে ফেলা।


যা হোক, এখন তো আমি শুধু ২০০৪ সালের ১৯ মার্চে তোলা কিছু ছবির পটভূমি আর ক্যাপশন লিখতে বসেছি। তা আপনি আছেন তো আমার সাথে? নাকি ধৈর্য্য হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়েছেন?


তখন ফটিকছড়ি মৃত্যু উপত্যকা হিসেবে পরিচিত ছিল। জামায়াত-শিবির সমর্থিত সন্ত্রাসীদের আধিপত্য ছিল একচেটিয়া। চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নকালীন প্রতিক্রিয়াশীলতা বিরোধী ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কারণে একাধিকবার কাঁথা-কম্বলসহ ঘটি-বাটি সম্বল হারিয়ে শিবির কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে শেষ-মেশ হল থেকে বিতাড়িত আমি (সুযোগ পেলে সে ইতিহাস আলাদাভাবে লিখবো) জামায়াত-শিবিরের নির্মমতা ও পাশবিকতার উপর বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলাম। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনাকারী, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বাস্তব জীবনে কাজে লাগে না, লাগে না বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, সেই সব দুর্মুখোদের মুখে ছাই দিয়ে আমি আমার শিক্ষা জীবনে অর্জিত জ্ঞান কর্মজীবনে সফলভাবে কাজে লাগাই। ধ্বংস হতে থাকে সন্ত্রাসীদের একের পর এক আস্তানা। বলে রাখা ভালো যে, সন্ত্রাস নির্মূলের জন্যে আমার পুলিশ সুপার মহোদয় আমাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন। কোনো কাজ করতে কখনোই আমাকে পূর্বানুমোদন নিতে হয়নি।


যাই হোক, একটা সময় আমার মনে হলো যে, শুধু পুলিশী অভিযান তৎকালীন চিটাগং জেলার সন্ত্রাস নির্মূলে যথেষ্ট নয়। তাই সভা-সমাবেশ করে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে শুরু করলাম। হঠাৎ একদিন সব দলের অংশগ্রহণে জনসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।


বললেই কি আর সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব!


বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকার তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সমগ্র চিটাগং জেলায় তখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন মাত্র দুজন- রাউজানের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী মহোদয় (বর্তমান সংসদেরও মাননীয় সংসদ সদস্য) এবং ফটিকছড়ির মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মো. রফিকুল আনোয়ার মহোদয় (বর্তমানে প্রয়াত)। ফজলে করিম চৌধুরী সাকা চৌধুরী কর্তৃক প্রদত্ত মিথ্যে খুনের মামলায় জর্জরিত ছিলেন। রফিকুল আনোয়ারও খুব ভালো অবস্থায় ছিলেন না। সে সময়টায় আমি ছিলাম তাঁদের অন্যতম ভরসাস্থল। দু’জনের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, সাকা চৌধুরীর নিজ প্রয়োজনে দু’একবার আমাকে ফোন করার বাইরে অন্য কোনো মাননীয় সংসদ সদস্যের সাথে আমার নয় মাসের কর্মকালে কোনোদিন কোনো কথাই হয়নি। এরকম অবস্থায় সামান্য একজন আডিশনাল এসপির দ্বারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে নিয়ে সভা করা রীতিমতো মহাশূন্যে দুঃসাহসিক অভিযাত্রার শামিল। আমি সেই অভিযাত্রার সিদ্ধান্তই নিয়ে বসলাম।


রফিকুল আনোয়ারকে ফোনে আমি তাঁকেসহ ফটিকছড়ির সকল প্রাক্তন সংসদ সদস্যবৃন্দ, সব দলের শীর্ষ নের্তৃবৃন্দ, অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ এবং সকল ইউপি চেয়ারম্যানবৃন্দকে মঞ্চে নিয়ে বিবিরহাট (ফটিকছড়ি উপজেলা সদর)কলেজ মাঠে ‘সন্ত্রাসকে না বলো, শান্তির জন্যে হ্যাঁ বলো’স্লোগানকে উপজীব্য করে সর্বস্তরের জনসাধারণের অংশগ্রহণে একটি সভা আয়োজনের কথা বলতেই তিনি ভয়ে আঁতকে উঠলেন। তবে তাঁর ভয়টা তাঁর নিজেকে নিয়ে নয়, আমাকে নিয়ে। তিনি আমার অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমাকে সতর্ক করলেন। শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, আরও কিছু ক্ষেত্রে আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসা আমি অনুভব করেছি। কিন্তু আমি তো নিজেকে হিরো ভাবতাম! হিরোরা কি কখনো পিছু হটে! তাই আমাকে নাছোড়বান্দা দেখে তিনি শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন।


অন্যদিকে সৈয়দ নজীবুল বশর মাইজভান্ডারী (বর্তমানে মাননীয় সংসদ সদস্য) মহোদয়কেও ফোনে রাজী করিয়ে ফেললাম। অবশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আমন্ত্রণসহ বাকি কাজগুলো সম্পাদনে তৎকালীন ওসি (বর্তমানে সহকারি পুলিশ সুপার, ডিএসবি, ঢাকা জেলা) জনাব মো. মাহবুবুর রহমান, পিপিএম ও তার সহকর্মীদের ভূমিকাই মুখ্য।


অবশেষে কাঙ্খিত সেই দিনের সূর্য উদিত হলো। ১৯ মার্চ ২০০৪ সাল। এসপি মহোদয়ের কাছ থেকে বিদায় ও আশীর্বাদ নিতে গেলাম। তিনি আমাকে সাহস যোগালেন। পাশাপাশি সতর্কও করলেন- ব্যর্থ হলে সমূহ বিপদ।


অনেক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হলো এবং এক সময় শেষও হলো। পরদিনের জাতীয় দৈনিকসহ সব মিডিয়ার অন্যতম গুরুত্ববহ সংবাদ। সবার সাথে ভাগাভাগির জন্যে ক্যাপশনসহ ঐ সমাবেশের কিছু ছবি সংযুক্ত করলাম।


ব্যর্থ হয়নি আমাদের কর্মসূচী। ব্যর্থ হয়নি ফটিকছড়ির জনগণের প্রচেস্টা। সব নেতৃবৃন্দ সভাস্থল ত্যাগ করলেন। মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে আমি সাধারণ জনতার উচ্ছ্বাস দেখছিলাম। শত শত হাত আমার দিকে এগিয়ে আসছে। শুধুমাত্র একবার ছুঁয়ে দেখতে চায়। অনুভব করলাম, বাংলাদেশে শুধুমাত্র একজন পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষেই সম্ভব রাজনীতিবিদদের চেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করা।


নিজেকে আর নায়ক মনে হলো না! মনে হলো মহানায়ক!!


লেখক : এডিশনাল ডি আই জি (ক্রাইম & অপারেশন্স),বাংলাদেশ পুলিশ, রংপুর রেঞ্জ


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com