'সহজ কথা যায় না বলা সহজে'
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১৩:৩৬
'সহজ কথা যায় না বলা সহজে'
হাবিবুর রহমান রোমেল
প্রিন্ট অ-অ+

'এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর ঢাকারে...
এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর আহারে...'


গানটি গেয়েছেন সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড চিরকুটের পিন্টু আর সুমি। অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের পপসম্রাট গুরু আজম খানের সেই বিখ্যাত গান—


'আলাল ও দুলাল
তাদের বাবা হাজি চান
চানখা পুলে প্যাডেল মেরে পৌঁছে বাড়ি'


এখন চানখার পুলে কাউকে প্যাডেল মেরে বাড়ি পৌঁছাতে দেখা ঈদের চাঁদ দেখার মতো ঘটনা। এখন এই শহরে প্রায় প্রতিদিন জাদুর দুর্ঘটনা ঘটে, সেইসব দুর্ঘটনায় প্রাণহীন হয়ে লাশকাটা ঘরে পড়ে থাকে সকালে কাজে বেড়িয়ে বাড়ি ফেরার বিস্তর পরিকল্পনা করা জলজ্যান্ত মানুষটি।


ঢাকায় এখন বাইসাইকেল চালানোর চিন্তা মানে পাঞ্জাবির পকেটে টাকা রেখে গুলিস্তানে হাঁটা। এই শহরে যেটুকু ফুটপাত আছে, তার যতটুকু মনুষ্য ব্যবহারের উপযুক্ত— তাতেও একটা কতৃপক্ষ স্টিল/লোহার পাইপ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে দিয়েছে মোটরসাইকেল যেন ফুটপাতে উঠতে না পারে। বিষয়টি এমন, মরারে মারছ কেন? মরায় নড়েচড়ে কেন! অথচ এই শহরে মোট জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি দশ লক্ষ। মোটরসাইকেল বিষয়ক এক জরিপ বলছে, রাজধানী ঢাকার নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আছে সাড়ে ৮ লাখ। এর বাইরে আরও প্রায় অর্ধ লাখ মোটরবাইক চলে ঢাকার রাস্তায়। এদের জন্য ফুটপাতে চলাচলকারীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। অথচ আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকলে নিশ্চয়ই এমনটা হতো না।


এখন কাজের কথায় আসি। তারমানে আগের কথা সব অকারণ! অনেকটা তাই। ওই যে 'সহজ কথা যায় না বলা সহজে'। 


গত ৮ এপ্রিল ২০১৭ সালে রাজধানীতে সাইকেলের জন্য আলাদা লেন চালু করার দাবি জানিয়েছে সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিশ্ব সাইকেল লেন দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সভায় এই দাবি জানানো হয়। সভা শেষে সাইকেল রেসের আয়োজন করা হয়। রেসটির নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। রেস শেষে ঢাবি উপাচার্য বলেন, সাইকেল এমন একটি বাহন যেটা দূষণমুক্ত এবং যানজটমুক্ত নগরের জন্য সহায়ক। উন্নত বিশ্বে সাইকেলের জন্য রাস্তায় আলাদা লেন আছে। আমাদের দেশে সাইকেল চালানোর জন্য মানসিকতা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীসহ চলাচলকারীরা সাইকেলে চলাচল করলে যানজট কমে যাবে।


বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান সাইকেল লেন আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে প্রচুর যানজট ও দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচল করায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, যা আগামীতে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। এ জন্য দুই মেয়রের উচিত সাইকেলের জন্য দ্রুত আলাদা লেন তৈরি করা। সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস বলেন, ছয় বছর ধরে সাইকেল লেনের দাবি করে আসছি। দুই মেয়র আশ্বাসও দিয়েছিলেন, কিন্তু আজও বাস্তবায়ন হয়নি।


তারপর ২০২০ সালের ৬ নভেম্বর সাইকেলের জন্য রাজধানীর সড়কগুলোতে আলাদা লেন করার আহ্বান জানিয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। তিনি বলেছেন, এতে সরকারি পরিবহনের জ্বালানি সাশ্রয় হবে। পরিবেশ রক্ষা পাবে, রাস্তায় যানজট কমবে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে সরকারকে আহ্বান করতে পারি, আমরা পৃথক সাইকেল লেন চাই। এটা সারা পৃথিবীতে আছে।


তারপর? তারপর ঢাকার সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। ঢাকায় উড়ালসড়ক হয়েছে, এলিভেটর এক্সপ্রেস হচ্ছে, মহাসড়কের লেন বাড়ছে, এক্সপ্রেস ওয়ে হয়েছে, মেট্রোরেল হলো, পাতাল রেল হবে; কিন্তু সাইকেল জন্য আলাদা লেন হবে না।


কিন্তু আলাদা সাইকেল লেন হলে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষকে কাজ শেষে লোকাল বাসে গাঁজাভর্তি হয়ে জ্যাম ঠেলে নির্জীব শরীর নিয়ে কবীর সুমনের গানের মতো  'দশ ফুট বাই দশ ফুট' ঘরে ফিরত হতো না। হয়তো দশ কিলোমিটার দূরে দশটার অফিস ধরতে তিনঘণ্টা আগে রওনা দিতে হতো না। হয়তো প্রতিদিন কন্ডাকটারের সাথে দশটাকার ভাড়া বিশটাকা নিয়ে তক্কবিতক্ক করতে হতো না, ঢাকার বায়ুমান অতো দূষিত হতো না, বায়ুদূষণ জনিত রোগ কমত, জ্বালানি খরচ সাশ্রয় হতো, ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ কমত এবং ঢাকার সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে আসতো।


তারপরও কেন না! আপনি দেখবেন— বাস বলেন, সিএনজি বলেন, রিকশা, ব্যটারি-চালিত রিকশা যাই বলেন না কেন মূল্যবান প্রাইভেট বাহনকে বাঁচতে ওই চালক আপনার উপর গাড়ি চড়িয়ে দিবে। কারণ মূল্যবান ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষতি হলে সে ক্ষতিপূরণ মেটানো তাদের সাধ্যের বাইরে। বরং রাস্তায় গরিব আহত হলে—মরলে তেমন কী ক্ষতি? ফলে ওই তাপানুকূল ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়া দেশের নীতি নির্ধাকরা যদি আমাকে-আপনাকে মানুষ মনে করত, মনে করত আমাদের এই জীবনেরও একটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ অর্থ আছে, মনে করত আমাদের রক্ত-ঘাম-শ্রামে বিনিময়ে তারা আলিশান অট্টালিকায় নানা অজুহাতে নানা বিধিতে নানা সত্যের আদলে অসত্য কথন, নানা চর্বিতচর্বণ করে অর্থের অন্তেষ্ট্যিক্রিয়াটা করে। তা না হলে অতসব উন্নয়নের আগে শহরজুড়ে একটা পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ, অর্থসাশ্রয়ী, স্বাস্থকর সাইকেল লেন হতো।


লেখক : হাবিবুর রহমান রোমেল, লেখক ও সাংবাদিক।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com