শিরোনাম
পাখির জন্য ভালোবাসা
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৭:০১
পাখির জন্য ভালোবাসা
বদরুল হায়দার চৌধুরী
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি), চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কেন্দ্রের বৃক্ষশোভিত আঙ্গিণাটি এখন পাখির কলকাকলিতে মুখর। হরেক রকমের পাখি - ঘুঘু, শালিক, চড়ুই, দোয়েল।


আগে কখনো এখানে এতো পাখির মেলা বসতো না, কিন্তু এখন বসছে। কারণ,আঙ্গিনার বৃহৎ বৃক্ষগুলোর চূড়ায় পাখির জন্যে নিরাপদ বাসস্থান করে দেয়া হয়েছে। মাটির ছোট ছোট কলস গাছের শাখায় বেঁধে দেয়া হয়েছে, যাতে পাখি ওখানে বাসা করতে পারে। শুধু কী বাসা, সাথে দেয়া হয়েছে খাবারও।


এমন অনুকূল পরিবেশ পেয়ে দিন দিন বাড়ছে নানা জাতের পাখির সংখ্যা। আর খবরটি জানাজানি হতেই প্রতিদিন আসছে বহু পাখিপ্রেমী মানুষ। তারা পাখি দেখছে, পাখিদের ছবি তুলছে, ভিডিও করছে।


এই ছোট্ট একটি কাজ এতোটা সাড়া জাগাবে, পরিবেশ এতটা পাল্টে যাবে, তা কেউ ভাবতেও পারেনি।


গত বছর ২১ নভেম্বর বাউবি’র চট্টগ্রাম অফিসের আঙ্গিনায় পালিত হয় পাখির অভয় আশ্রম কর্মসূচি। এর অংশ হিসেবে এ অফিসের আঙ্গিনা ও এর বৃক্ষগুলোকে পাখির বসবাস ও বিচরণের অনুকূল করা হয়। গাছে গাছে বাসা বেঁধে দেয়া হয়, দেয়া হয় খাবার। আঙ্গিনার চারদিকে পাখির জন্যে ভালোবাসার আকুতি জানিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয় ফেস্টুন।


এখানে বলে রাখি,বাউবি’র চট্টগ্রাম অফিসের লাগোয়া বৃহৎ জায়গা নিয়ে অবস্থিত একটি বাংলো। ওখানে থাকেন চট্টগ্রাম কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ বিভাগের কমিশনার। বাংলোর চারপাশে রয়েছে ছোট-বড় ৪/৫শ' গাছ। এর প্রতিটিতেই রয়েছে একাধিক পাখির বাসা। চট্টগ্রামের চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এখন পাখির বংশবৃদ্ধি, পাখি নিয়ে গবেষণা এবং চিড়িয়াখানাকে পাখির জন্যে নিরাপদ করতে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে। বাউবি’র চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কেন্দ্রের বর্তমান ৫৫ হাজার শিক্ষার্থীর অনেকেই এখন পাখি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। এসবই হয়েছে ক্ষুদ্র এ উদ্যোগটির পর।


গত বছরের কথা। শীতে বেড়াতে যাই বান্দরবানে। বিভিন্ন স্থান ঘুরে হাজির হই নীলগিরিতে। মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকি এর অপার সৌন্দর্য্য। হঠাৎ মনে হলো, দীর্ঘ ৩/৪ ঘন্টা অবস্থানকালে একটি পাখিও দেখা যায়নি, বিষয়টা কী ? এত গাছ, এত ছায়া, এত বন ! কিন্তু পাখি কোথায় ?


আমার অনুসন্ধিৎসু মন ছুটে চললো সেদিকে। অনেক চেষ্টার পর জানা গেল, এখানকার পাখিগুলো বড্ড অসহায়। মনের আনন্দে উড়তে চাইলেও পারে না। কারণ,এখানকার অধিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একটি ছোট অংশের সুনিপুণ হাতে এরা মারা পড়ছে। এদের শিকারী হাত থেকে পাখিদের বাঁচার কোনো উপায় নেই। বনে বনে দিনমান ঘুরে এরা পাখি ও পশু শিকার করে।


ব্যথিত মন নিয়ে ফিরি চট্টগ্রামে। ভাবি, আর দেরী নয়। এখনই পাখি বিষয়ে গণসচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। তারই অংশ হিসেবে বাউবি’র অফিস আঙ্গিনায় গত ২১ নভেম্বর চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের জড়ো করে ওই কর্মসূচিটি পালন করি।


শুধু বাংলাদেশের বান্দরবান নয়, সারা বিশ্বেই পাখির প্রতি সহিংসতা বেড়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশের পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম-উল হক বলেন, সারা পৃথিবীতে কোনো গবেষণায় জানা যায়নি যে, পাখি মানুষের ক্ষতি করে। বরং নানাভাবে এরা মানুষের উপকার করে।


পাখিরা ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের ফসল রক্ষা করে, পানির অসুস্থ ও দূর্বল মাছ খেয়ে অন্যান্য সবল মাছ ও জলজ উদ্ভিদকে রক্ষা করে, ইঁদুর খেয়ে কৃষকের উপকার করে। পাখির বিষ্টা হাওর, বাওর ও বিলের মাটিতে মিশে ওই মাটি ফসফরাস ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ হয়। ফলে মাটির উর্বরাশক্তি বেড়ে যায় কয়েকগুণ।


সারা বিশ্বে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১২ শ প্রজাতির পাখি এখন বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশেও ৪৬৬ টি প্রজাতির পাখি বাস করে। এর মধ্যে ১২/১৩ প্রকার পাখি এখন আর দেখা যায় না। ভাবা হচ্ছে, খাদ্য ও বসতি নষ্ট হওয়ায় এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমাদের দেশে যা পাখি আছে, তার ৫০% পরিযায়ী। এরা এদেশে আসে, একনাগাড়ে সারা বছর থাকে না।


পাখি কমে যাওয়ার আরো অনেক কারণ রয়েছে। জলজ উদ্ভিদ কমে যাওয়া, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন প্রকার ফাঁদ, বিষটোপ ও জালের মধ্যমে পাখি ধরা ও মারা, কৃষিজমিতে কীটনাশক ব্যবহার, খাদ্যাভাব ইত্যাদি পাখি বিলুপ্তি ও সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ। পাখি শিকার বন্ধ হলে, পাখির বাসস্থান ও খাবারের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করা গেলে, অবশ্যই পাখির কলকাকলি বৃদ্ধি পাবে। ফিরে আসবে পরিবেশের ভারসাম্য ও নান্দনিকতা।


তবে সবই খারাপ খবর নয়। সরকার, বিভিন্ন সংগঠন ও কিছু ব্যক্তির উদ্যোগের ফলে আমাদের দেশে পাখি বিষয়ে সচেতনতা পূর্বের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে পাখির আগমন ও সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেশের কয়েকটি হাওর ও বিল এলাকা, পাখির প্রজাতি ও সংখ্যাধিক্যের কারণে Rasmar Site ev Important Birds Area (IBA) হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। হাইল, টাঙ্গুয়া, হাকালুকি হাওর, বাইককার বিল, সোনাদিয়া, নিঝুম দ্বীপ ইত্যাদি এলাকায় ঈগল, কালেম, বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা, বাটান ও বুনো হাঁসের ওড়াউড়ি দেখা যায়।


বাউবি’র চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কেন্দ্রের মতো আরো কিছু ছোট উদ্যোগের কথা জানা যায়, যা পরবর্তিতে বড় উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার উত্তর পাড়ার তরুণ আহমদ উল্লাহ, পাখির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যে বিপ্লব শুরু করেছেন। গ্রামের তরুণদের সংগঠিত করে তিনি পাখি রক্ষায় ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছেন। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার কুঞ্জবন এলাকার মনসুর সরকার তাঁর এলাকায় পাখি শিকার,পাখি ধরা, পাখি খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। গ্রামের মানুষ তাঁর এ নিষেধাজ্ঞা মেনে চলছেন। যশোরের নাভারণ উপজেলার চন্দরপোল গ্রামের তোতা মিয়া পাখির সাথে সখ্য সৃষ্টিই করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর গ্রামের লোকেরা দেখছেন, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতিদিন কিভাবে হাজার হাজার পাখি চলে আসে। অন্যরা ডাকলে আসে না। রাজবাড়ি শহরের আব্দুল্লাহ স্বপন স্বীকৃতি পেয়েছেন পাখিবন্ধু হিসেবে। আহত, রুগ্ণ পাখি ধরে এনে এদের সুচিকিৎসা দিয়ে তিনি চিকিৎসা দেন, সুস্থ হলে বনে নিয়ে ছেড়ে দেন। গত সাত বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন।


উপরোক্ত উদ্যোগগুলো খালি চোখে ছোট মনে হলেও মানুষের উপকারী বন্ধু পাখিদের রক্ষায় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহে পাখির প্রতি এখন আর কেউ নির্দয় আচরণ করে না। এ ধরণের উদ্যোগ সারা দেশে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে, সকল সচেতন মানুষ, সংগঠন ও সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। তাহলেই বন্ধ হবে পাখির প্রতি সহিংসতা।


পাখি যে মানুষের কত বড় বন্ধু, একটি নিদর্শন উল্লেখ করে, আজকের এ লেখার ইতি টানবো। ঘটনাটি ব্রাজিলের একটি ছোট দ্বীপ এলাকার এক জেলে ও একটি কৃতজ্ঞ পেঙ্গুইন পাখিকে নিয়ে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো এক দিন এ দ্বীপের জেলে জোয়াও পেরেরা ডিসুজা প্রতিদিনের মত মাছ ধরতে, সমূদ্রের পাড়ে পায়চারি করছেন। সমূদ্রের ব্যাপক এলাকা তখন ভাসমান অপরিশোধিত তেলে নাকাল। দূরে চোখ পড়তেই পেরেরা ডিসুজা দেখেন, একটি পেঙ্গুইন পাখি বাঁচার জন্যে পাখা ঝাপটাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখেন, শরচা অপরিশোধিত তেলের মাখামাখিতে পাখিটি বেশ কষ্ট পাচ্ছে। পাখিটিকে তিনি পরম মমতায় পানি থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কয়েকদিন পরিচর্যা করে তাকে সারিয়ে তোলেন। সুস্থ হলে পেঙ্গুইনটিকে আবার প্রকৃতিতে ছেড়ে দিয়ে আসেন। পেঙ্গুইনটি পেরেরার মমতা ভুলে যায়নি। কৃতজ্ঞ পাখিটি বেশ কিছু দিন পর আবার বন্ধু পেরেরার কাছে ফিরে আসে। পেরেরাও তাকে হতাশ করেননি। পেঙ্গুইনটিকে পরম মমতায় আবার আগলে রাখেন। তিনি পেঙ্গুইনটির নাম দেন দিনদিন। ২০১১ সাল থেকে দিনদিন বছরের ৮ মাস বন্ধুর বাড়িতে থাকে। শুধু প্রজণনের ৪ মাস চলে যায় আর্জেন্টিনা ও চিলির পেঙ্গুইন আবাসস্থলে।


একে যদি ভালোবাসা না বলি, তবে কাকে বলবো ভালোবাসা!


লেখক : আঞ্চলিক পরিচালক, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com