‘জাতীয়তাবাদ’ চিন্তাটির পক্ষে বুজুর্গরা কড়া কড়া যুক্তি উপস্থাপন করলেও এই বিষয়টিকে নিজের কাছে কিছুটা সমস্যাজনকই মনে হয়! কেননা ‘জাতীয়তাবাদ’ চিন্তার সাথে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের বিষয়টি জড়িত। যার কারণেই পৃথিবীব্যাপী এত কাঁটাতার! হয়তো এই বিষয়টি না থাকলে আমাদের পৃথিবী হতো এক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অনুকূল!
কিন্তু অসম্ভব শৃঙ্খলিত এই ব্যবস্থার বিপক্ষে না দাঁড়িয়ে এর পক্ষে দাঁড়াবার জন্যে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে, যার প্রধানটি হলো এই ‘জাতীয়তাবাদ’ নামক স্ফুলিঙ্গের কারণেই বাঙ্গালী হিসেবে আমরা অর্জন করেছিলাম ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র।
স্বাধীনতার সংগ্রাম চলাকালীন বাংলা ও বাঙ্গালীর বুক চিতিয়ে দাঁড়াবার স্পর্ধাস্বরূপ এই জাতীয়তাবাদের চেতনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অনুষঙ্গ ছিল। তাছাড়া সংবিধানে বর্ণিত চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের ভেতর জাতীয়তাবাদ একটি। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এই চেতনা যেন ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আত্মকেন্দ্রিকতার আফিমে মজে গেছে!
অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায়নে বলেন, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনতার অকৃত্রিম ভালোবাসার স্ফুরণই জাতীয়তাবাদের মৌলিক ভিত্তি।
স্বাধীনতাপূর্বকালীন সময়ে ‘আমাদের’ শব্দটির গুরুত্ব ছিল অত্যধিক। তখন অধিকার আন্দোলনের বিষয়টিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনতার একাত্মতা ছিল। সব বিষয়েই বাংলা ও বাঙ্গালীর ‘আমাদের’কেন্দ্রিক নিজস্বতা ছিল। তাকিয়ে দেখলে দেখা যায়, তখন বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদের মূলে ছিল বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ, পতাকা, মানচিত্র কিংবা এককথায় পুরোটা ছিল বাংলাদেশকেন্দ্রিক।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখলে মনে হয়, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের চেতনা যেন শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কিছু দিবসকেন্দ্রিক! এর পক্ষে যুক্তিও আছে। আর যুক্তির চাইতে বেশি উত্তম যদি আপনি আপনার চারপাশের বিভাজনের কাঁটাতারগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন।
গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে শুধু কাঁটাতার দিয়ে কখনোই ভিনদেশী আগ্রাসন ঠেকানো সম্ভব নয়! কারণ, বিশ্বের চৌকস রাষ্ট্রগুলো এখন সরাসরি অস্ত্রসম্বলিত যুদ্ধ বন্ধ করে খুব ঠাণ্ডা মগজে ভিনদেশী দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে সুসম্পর্ক বজায় রেখে ভিনদেশী বাজার ধরতে পারলে রথ দেখা ও কলা বেচা দুটোই একসাথে হয়ে যায়!
প্রয়োজনে ব্যবহৃত মুঠোফোনে আমরা প্রতিদিনই প্রায় কয়েক শ’ কোটি টাকা খরচ করছি। কিন্তু এই টাকা আমাদের দেশে নয়, বরং চলে যায় ভিনদেশে! যদিও আমাদের নিজেদেরই একখানা দেশীয় মুঠোফোন কোম্পানি আছে।
অনেককে বলতে শুনেছি, আমাদের দেশীয় এই কোম্পানির নেটওয়ার্ক নাকি দুর্বল। তবে অজুহাতে জর্জরিত সেই মানুষদের কিন্তু কখনোই এই নেটওয়ার্ক উন্নত করার ব্যাপারে পরামর্শ বা দেশের জিনিস ব্যবহারে যে দেশেরই উন্নয়ন হবে - এমনটা বলতে শুনিনি।
নিত্যদিন আমরা যে সমস্ত পণ্য ব্যবহার করি, যেমন মোবাইল, মোটরবাইক, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, ল্যাপটপসহ প্রায় সব কিছুই আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, দেশীয় এসব পণ্য ব্যবহার না করে আমরা ভিনদেশী পণ্য ব্যবহারে আগ্রহী। অথচ কিছুদিন আগেও নেপাল আমাদের দেশ থেকে প্রায় ২৫০টি মোটরবাইক আমদানি করেছে।
আরেকটু নিমগ্ন দৃষ্টিতে সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, ভিনদেশী পণ্য ব্যবহার ও সংস্কৃতিচর্চাকে এদেশেরই কিছু মানুষ জাতে ওঠার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করেন! তাদের ঘরে প্রায় সার্বক্ষণিকভাবে চালিত হয় ভিনদেশী চ্যানেল। শুধু তাই নয়, অনেকেই শেষ কবে দেশের খবর কিংবা দেশীয় অনুষ্ঠান দেখেছেন সেটাও হয়তো বলতে পারবেন না।
যথার্থ জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণ চাইলে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার অগ্রযাত্রা কেউ দাবায়ে রাখতে পারে না। আর সে জন্যে চাই দেশীয় ব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং কোনো ক্ষেত্রে সমস্যা মনে করলে সর্বপ্রথম নিজ উদ্যোগে ঘুরে দাঁড়ানো এবং অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করা।
জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতি পূর্ণ আস্থা পোষণকারী মানুষ কখনোই ভিনদেশী পণ্য, রাজনীতি বা সংস্কৃতির জয়গান গাইতে পারেন না। আবার এই জাতীয়তাবাদের চেতনা কারোর ভেতর হুট করে প্রত্যাশা করাটাও অযৌক্তিক। কারণ, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পরিবার থেকেই একটি মানুষ প্রথম শিক্ষা পায় তার দেশীয় ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে। সেক্ষেত্রে পরিবারকেই সর্বাধিক গুরুত্ববহ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
ইতিহাসের পাতায় আমাদের জাতীয়তাবাদের যে স্ফুরণ আজও লিপিবদ্ধ, সেই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিটি মানুষ তার দেশকে ভালোবেসে এগিয়ে নিয়ে যাবে - প্রত্যাশা আজ এটুকুই।
লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]