শিরোনাম
ভিনদেশী ভাষা বর্জন করে সর্বত্রই বাংলা ভাষার প্রচলন দরকার
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:৫৪
ভিনদেশী ভাষা বর্জন করে সর্বত্রই বাংলা ভাষার  প্রচলন দরকার
হায়দার মোহাম্মদ জিতু
প্রিন্ট অ-অ+

উপনিবেশিক শাসনামল থেকে আজ অবধি আমাদের মাটি ও সংস্কৃতি প্রতিনিয়তই বলৎকারের স্বীকার ! যদিও পূর্বে অর্থাৎ স্বাধীনতার পূর্ব সময়ে তা ছিল খুল্লাম খুল্লাম। আর এখন হচ্ছে নিতান্তই ভদ্রতার সহিত ! কিন্তু সত্যিকার অর্থে সেই বলৎকারের ধারা এখনো অব্যাহতই রয়ে গেছে।


১৯০ বছরের ব্রিটিশ শোষণ, অতঃপর ২৩ বছরের পাকিস্তানি শোষণ, সবমিলিয়ে আমাদের শোষণের গল্পটা প্রায় ২১৩ বছরের। এই দীর্ঘ শোষণের যাঁতাকলে যে কারোর মুণ্ডু বিকৃত হবে এমনটাই স্বাভাবিক। তবে যখন শোষণের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্ত আকাশে ডানা মেলার সময়, তখনও যদি মগজে উপনিবেশিকতার ঘ্রাণ পাওয়া যায় তবে তা সত্যিই সমস্যামূলক।


তখনকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রায় সব বিষয়েই বৈষম্যের ধারা অব্যহত ছিল। তবে যে বিষয়টি সব চেয়ে বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছিল, তা হল সাংস্কৃতিক বৈষম্য। নৃবিজ্ঞানের ভাষায় সংস্কৃতি হল জীবন যাপনের পুরো বিষয়টাই। অর্থাৎ জীবন ধারণের কোনো কিছুই সংস্কৃতির বাইরে নয়।


সংস্কৃতিকে প্রকাশের একটি অন্যতম মাধ্যম ভাষা। বাঙ্গালীর সেই ভাষাতেই প্রথম আঘাত করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি জিন্নাহ সাহেব। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি উত্তাল সমুদ্রের মতো সকল ব্যারিকেড ভেঙ্গে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার ঐক্যবদ্ধ ছাত্রজনতা। শহীদ হয়েছিলেন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, সফিউরসহ আরো অনেকে।


বাংলার দামাল সন্তানেরা ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সংগ্রামের ধারা অব্যহত রাখতে পেরেছিল বলেই বাঙ্গালী তার স্বাধীনতার স্বপ্নটাকে বুক পকেটে পুরতে পেরেছিল। কিন্তু এখন এই শতকে এসে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তার পুরোটা হয়তো আজও আমরা আমাদের করে নিতে পারিনি!


বর্তমান বিশ্বে পরিচিতি লাভ এবং অর্থনীতির লাভ-খতিয়ানে পর্যটন শিল্প বেশ বড় একটা মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন। তবে বিশ্বের দীর্ঘতম এই সমুদ্র সৈকতটি আমাদের হয়েও বারবার যেন মনে করিয়ে দেয় আমাদের দাসত্বের কথা! ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তখনকার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিং আরাকান উদ্বাস্তু এবং আঞ্চলিক রাখাইনদের মাঝে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে নিয়োজিত করেছিলেন এই উপকূল অঞ্চলে। সাফল্য পাওয়া এই ব্যক্তি নিজের কাজ শেষ করার পূর্বেই গত হন। তাই তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পরবর্তীকালে সেখানকার একটি মার্কেটের নামকরণ করা হয় কক্স মার্কেট। কিন্তু আমাদের শ্রদ্ধার মাত্রা আবার অত্যধিক! তাই কিনা বিবর্তিত করতে করতে আমরা পুরো সমুদ্র সৈকতের নামই করে ফেলেছি কক্সবাজার! যদিও এর পূর্ব নাম ছিল পালংকি।


সেন্টমার্টিন দ্বীপের ক্ষেত্রেও তাই। তখনকার ব্রিটিশ এবং বার্মা সাম্রাজ্যের মাঝে সংঘর্ষের অন্যতম কারণ - এই দ্বীপটির নাম দিয়ে গেছেন ব্রিটিশরা। তারপর অবধি এটি সেই অবস্থাতেই রয়ে গেছে। যদিও আমাদের ভাষায় একে আমরা নামকরণ করেছি নারিকেল জিঞ্জিরা। তবুও দেখা যায়, সেখানে যাবার জন্যে যত প্রকার যানবাহন আছে সেগুলোর টিকেট থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্রই উপনিবেশিক এই ছায়া অর্থাৎ নামকরণের এই বিষয়টি আজও অব্যাহতই রয়ে গেছে।


শুধু পর্যটন শিল্পে নয়, বাংলাদেশের আইন-আদালত, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজের নাম প্রায় সর্বত্রই এখনো বৈদেশিক ধারা অর্থাৎ বৈদেশিক ভাষার যথেচ্ছা ব্যবহার প্রবাহমান।


রাজধানী ঢাকার একটি এলাকা ধানমণ্ডি ঘুরে দেখলে হয়তো মনে হবে লসএঞ্জেলেস, প্যারিস কিংবা বিদেশের অন্য কোনো শহর। কেননা এখানকার স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে বাড়ি, খাবার দোকানগুলোর নাম প্রায় সবগুলোই ভিনদেশী নামের !


বিশ্ব ইতিহাসে আমরা একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্যে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেছি। আবার এটাও হয়তো সত্য যে, সেই দেশের মানুষই এখন ভিনদেশী ভাষার ব্যবহারকে জাতে উঠার একটা মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।


ছোট্ট একটা সত্য তুলে ধরছি, বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক তার মেয়েকে বাংলা মিডিয়াম স্কুল থেকে সরিয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। কারণ, ওই বাংলা মিডিয়াম স্কুলটিতে তার কম্পাউন্ডারের মেয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে!


যে ভাষার জন্যে বাঙ্গালী রক্ত দিয়েছিল, আজ সেই ভাষাকেই তাঁরা লাঞ্ছিত করছে। ভাবের আদান-প্রদানেও ব্যবহার করছে পাঁচমিশালী কায়দায়। কারো দানে কিংবা ফাও ফাও আমাদের পতাকা, মানচিত্র এবং জমিন আসেনি। এর জন্যে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। কাজেই যারা হুট করে জাতে ওঠার মাধ্যম হিসেবে ভিনদেশী ভাষাকে আওড়াচ্ছেন, তাদের দৈন্যদশা দেখে লজ্জাই হয়।


বাংলা ও বাঙ্গালী ভিক্ষার থলি হাতে দাঁড়িয়ে থাকবার জন্যে জন্মায়নি। ইতিহাস তারই সাক্ষ্য বহন করে, এঁরা মহাকাশ জমিন সর্বত্রই বুক চিতিয়ে দাঁড়াবার জন্যে জন্মেছে।


বৈশ্বিক সংস্কৃতিতে টিকে থাকতে ভিনদেশী ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অবশ্যম্ভাবী। তবে সেটা নিজ ভাষা এবং সংস্কৃতিকে বঞ্চিত করে নয়।


পূর্বের ন্যায় এবারও ২১ ফেব্রুয়ারি নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে সকল ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। তবে বোধ করি, ভিনদেশী ভাষাকে বর্জন করে দেশের সর্বত্রই যদি বাংলা ভাষার সঠিক প্রচলন ঘটানো যায় তবেই হয়তো ভাষা শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানানো হবে।


লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com