শিরোনাম
দর্পণে আপন মুখ
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:৫৪
দর্পণে আপন মুখ
শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি
প্রিন্ট অ-অ+

আমাদের চারপাশের নানা অরাজকতা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, প্রাথমিক শিক্ষায় কি ভিডিও আর সেলফির ব্যবহার শেখানো হয়েছিল আমাদের? নৈতিক শিক্ষা নামের কোনোকিছুর সাথে পরিচিত আমরা? ছোটবেলা থেকে ‘যত্রতত্র ময়লা ফেলবেন না’ শুনে বড় হওয়া এই আমরা ডাস্টবিন রেখে সারা দুনিয়ায় ময়লা ফেলে বেড়াই।


খুব সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে বললাম। চারদিকে দৃষ্টি যত প্রসারিত করা হলে আরো বড় বড় অসঙ্গতি চোখে পড়বে। অন্যের দোষটা ধরার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখা যায় না?


জ্বি না। আমি কোনো বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষরূপী জানোয়ারের পক্ষে সাফাই গাইছি না। সে কি করে, কারা দায় স্বীকার করলো, কারা কাদা ছোড়াছুড়ি করলো, কারা ধোয়া তুলসী পাতা, কার কোপানোর স্টাইল দেখে কী মনে হয় - এসব নিয়ে কোনো কথাই বলছি না। আমি আমার নিজের প্রতিই লজ্জিত। চিপস খাওয়ার পর প্যাকেটটা আমি রাস্তায়ই ফেলি। যত্রতত্র থুতু ফেলতে আমার গায়ে লাগে না। ভিড়ের মাঝে কেউ ‘অশ্লীল কথা’ বললে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে পারি না আমি। কেউ ভয় দেখালেই সুরসুর করে ম্যাও ম্যাও করি আমি। প্রতিবাদ করার যোগ্যতা নেই আমার।


কেনই বা করবো? সমাজের কথা চিন্তা করার দায় পড়েছে নাকি আমার? কিছু বলার আগেই ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়া হয় আমাকে, তোর সমস্যা কি? তুই এত বেশি বুঝিস কেন? আর কারো লাগে না, তোর এত লাগে কেন?


তাই ওসব আগেই ছেড়েছি। দেশের কথা ভাববার মতো বিলাসিতা করার সামর্থ্য নেই আমার। নিজেকে নিয়ে, নিজের পরিবার নিয়ে সার্ভাইব করতে গিয়েই হিমশিম খাবার দশা! ওই মাঝে মাঝে কেউ কারো সাথে একটু-আধটু দুষ্টুমি করলে ফেসবুকে দুই-চার লাইন লিখে খুব সুশীল বনে যাই! বেশ কিছু লাইকও জুটে যায়! কেউ কেউ কমেন্টে বাহবা দেয় খুব! তারপর?


একের পর এক মেয়ে তনু হয়, খাদিজা হয়! আমার কী তাতে! আমি তো ভালোই আছি ! মাস গেলেই বাবা টাকা পাঠাচ্ছে, তা থেকে কিছু বাঁচিয়ে টিপ, চুড়ি কিনছি। আর কি লাগে! কাউকে নিয়ে ভাববার কিছু নেই তো! শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববো, ওমুকের বদনাম করবো, তমুকের সাফল্য দেখে হিংসে করবো, তমুকের কোনো ক্ষতি হলে ফেসবুকে মায়াকান্না কাঁদবো, ব্যাস! দায়িত্ব শেষ! দশজন চিনবে, কিছু লোক লুলাবে, কারো চোখের বিষ হবো, কেউ কেউ সামনাসামনি প্রশংসার ঝড় তুলে আড়ালে ফাউল বলবে, এই তো জীবন!


তনু খুন হওয়ার পর খুব লাফিয়েছিলাম! কার কি ছেঁড়া গেছে তাতে! এখন আর মোটেও বলবো না ‘আমিই খাদিজা’। আমি খাদিজা হতে যাবো কোন দুঃখে! আমি তো ইমি!


দেশের ১৬ কোটি মানুষের কেউই খাদিজা নয়! প্রোপিক চেঞ্জ করে কেউই তনু হয়ে যায়নি! আচ্ছা, আমার আশপাশে কোনো বদরুল নেই তো? গতকাল তনু, আজ খাদিজা, আগামীকাল আমার পালা নয় তো?


আচ্ছা, আমাদের সমস্যাটা কোথায় বলুন তো! আমাদের সমস্যাটা হচ্ছে নিজের মধ্যে। প্রতিটা মানুষ যদি নিজের ভেতরের ছোট ছোট ভুলগুলো শুধরে নিতে শুরু করে, বড় কোনো সাইকো তার মাঝে আর বাস করতে পারবে কি? কিন্ত কেউ তো শোধরাবে না!


পেটে ভাত নেই, পকেটে টাকা নেই। নৈতিকতার বুলি শোনার মত কোনো চু*র ভাই আছে নাকি! জ্বি হ্যাঁ! আমিও আগামীকালই রাস্তায় পলিথিন ফেলবো। বাবার বয়সী রিক্সাওলাকে বাপ-মা তুলে গালি দেবো।


কেউ কিছু বলবে নাকি! কেউ কখনো কি কিছু বলে? বদরুলরা গণধোলাই খায়, গ্রেপ্তার হয়, কিন্ত বদরুল তৈরি হওয়া বন্ধ হয় না! তাহলে কেন করবো না অরাজকতা? সিস্টেম তো করে নিতেই পারবো! ভাই-ব্রাদারের অভাব আছে নাকি!


আমি নির্লজ্জ! আমি নীচ, আমি বেয়াদব, আমি ম্যানারলেস! আমি সাইকো। আমিই বাংলাদেশ! দেশের প্রতিটা তরুণই আমার মতো। কারো কিচ্ছু যায়-আসে না। তনুরা মরছে মরুক! খাদিজারা কোপ খাচ্ছে খাক! কার কী যায়-আসে তাতে? আমার তো কিচ্ছু যায়-আসে না তাতে! তবুও...


আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে লজ্জা লাগে মাঝে মাঝে। এখনো পুরোপুরি অমানুষ হয়ে যাইনি তো!


এখনো আড়াই বছর আছে। পাথর হবার ট্রেনিং তো চলছেই। সামনে কেউ খুন হলেও রা করবো না। উলটো দৌঁড় দেবো। কাছে ভালো ডিভাইস থাকলে ভিডিওও করে ফেলতে পারি! ভিউয়ার বাড়াতে হবে না! আমার কেন লজ্জা করবে? কেন বিবেকে বাঁধবে তনুর বাবার, খাদিজার বাবার করের টাকায় আমি হলে থাকি বলে? কেন লজ্জা লাগবে আমি সমাজবিজ্ঞানে পড়ি বলে? কেন সমাজের এই দুর্দশায়ও রিসার্চার হতে ইচ্ছে করবে আমার? কেন একবারের জন্য হলেও মনে হবে যে, দেশটার এখন প্রয়োজন আমাকে? আমি তো বিসিএস ক্যাডার হবো! ফেসবুকে পোস্ট দিলে আর আরেকজনের ঘাড়ে দোষ চাপালেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়! মনুষ্যত্ব, বিবেকের মা... বাপ....!


মাঝে মাঝে ভয় হয়, এরপর আমার পালা নয় তো!


লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com