শিরোনাম
রাজনীতিকরা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন!
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৫৬
রাজনীতিকরা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন!
এম. আবদাল হুসাইন
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশকে আমরা সম্প্রীতির দেশ বলি। সেই সম্প্রীতি রক্ষায় সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু সবার দায়িত্ব রয়েছে। সম্প্রতি কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গপূজায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা হয়েছে। সংঘর্ষে একাধিক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।


১৯৯০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে সাম্প্রদায়িক হামলার মাত্রা ছিল এক রকম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে মাত্রা হয়েছে অন্যরম। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সময় থেমে থেমে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে। এসব হামলার পেছনে যেমন সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আছে, তেমনি আছে সরকারি দলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অপশক্তি।


ধর্মীয় উৎসব পালন করতে গিয়ে মানুষ খুন হবে, মন্দির, পূজামণ্ডপ, ঘরবাড়ি ভাঙচুর হবে- এটা আমাদের জন্য লজ্জার। একবার চিন্তা করুন- যদি কেউ আপনার ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় কিংবা আপনার ওপর হামলা করে তাহলে আপনার অবস্থাটা কী হবে?


টেলিভিশন, পত্রিকা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হামলার ঘটনা দেখে মতামত দেয়া যত সহজ, বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। সাপ যাকে কাটেনি সে কখনো সাপের কামড়ের ব্যথা বুঝবে না।


মানুষ খুন কিংবা ঘরবাড়ি ভাঙচুরের পর আমরা নিজেদের কীভাবে সভ্য মানুষ দাবি করতে পারি? ‍বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো যখন কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ, আস্তিক-নাস্তিক, মুসলিম-অমুসলিম সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে চলছে, তখন আমরা মুর্খের মতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টায় লিপ্ত।


সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে এক ধর্মের মানুষের প্রতি অন্য ধর্মের মানুষের যেমন দূরত্ব তৈরি হবে, তেমনি ধর্মের প্রতি মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা কমে যাবে।


ধর্ম নিয়ে যারা আজ অতি বাড়াবাড়ি করছে তাদের কাছে প্রশ্ন, ধর্ম কি রক্তপাত কিংবা নৈরাজ্য সৃষ্টির নাম? নাকি ধর্ম শান্তির নাম?


ইসলাম সব ধর্মের উপাসনালয়কে শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখার নির্দেশ দিয়েছে এবং কারো উপাসনালয়ে হামলা চালানোকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। শুধু তা-ই নয় বরং অমুসলিমরা যেসবের উপাসনা করে সেগুলোকে গালমন্দ করতেও আল্লাহপাক বারণ করেছেন।


পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন- ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যাদের উপাস্যরূপে ডাকে তোমরা তাদের গালমন্দ করো না। নতুবা তারা শত্রুতাবশত না জেনে আল্লাহকেই গালমন্দ করবে’ (সুরা আন আম: ১০৮)।


এ আয়াতে শুধু প্রতিমা পূজারীদের সংবেদনশীলতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য নির্দেশ দান করা হয়নি বরং সকল জাতি এবং সকল সম্প্রদায়ের মাঝে বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দ্য স্থাপনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।


মহানবী (সা.) সমাজের সর্বক্ষেত্রে এবং সকল জাতির মাঝে শান্তি, শৃংখলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এমনকি খ্রিস্টানদের নাগরিক ও ধর্মীয়-অধিকারকেও তিনি নিশ্চিত করেছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা যেন বলবত থাকে সেই ব্যবস্থাও করেছেন।


খ্রিস্টানদের নাগরিক ও ধর্মীয়-অধিকার নিশ্চিতকারী মহানবী (সা.) প্রদত্ত ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের ঘোষণাপত্রে উল্লেখ রয়েছে, ‘এটি মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ (সা.) প্রণীত কাছের এবং দূরের খ্রিষ্টীয় মতবাদ পোষণকারী প্রত্যেকের জন্য ঘোষণাপত্র: আমরা এদের সাথে আছি। নিশ্চয়ই আমি নিজে আমার সেবকবৃন্দ মদিনার আনসার এবং আমার অনুসারীরা এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি।


কেননা খ্রিস্টানরা আমার দেশের নাগরিক। আর আল্লাহর কসম! যা কিছুই এদের অসন্তুষ্টি ও ক্ষতির কারণ হয় তার ঘোর বিরোধী। এদের প্রতি বলপ্রয়োগ করা যাবে না, এদের বিচারকদেরকে তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা যাবে না আর এদের ধর্মযাজকদেরকেও এদের আশ্রয় থেকে সরানো যাবে না। কেউ এদের উপাসনালয় ধ্বংস বা এর ক্ষতিসাধণ করতে পারবে না। কেউ যদি এর সামান্য অংশও আত্মসাৎ করে সেক্ষেত্রে সে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গকারী এবং তার রাসুলের অবাধ্য সাব্যস্ত হবে।


কী চমৎকার শিক্ষা! বিশ্বনবী, মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো, যে যে ধর্মেরই হোক না কেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের জাগতিক অবস্থান সমান। এটি নিছক একটি ঘোষণাই ছিল না। বরং মহানবী (সা.) মদিনার শাসনকাজ পরিচালনাকালে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নও করেছিলেন।


যারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে বা যারা একাজে অতি উৎসাহী তাদের জন্য মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণে একটি সতর্কবাণী দিয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন: ‘হে মানবমণ্ডলী! সাবধান, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা তোমাদের পূর্বের জাতিগুলো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’


কুমিল্লার ঘটনার পর রাজনৈতিক নেতৃত্ব একে অপরকে দায়ী করে লম্বা লম্বা বিবৃতি দিচ্ছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ডজন ডজন মামলা করছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ধরে জেলখানায় পাঠানো হচ্ছে। তাতে লাভ কী! দাঙ্গার ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য যে ক্ষতি হয়েছে, হৃদয় যে রক্তাক্ত হয়েছে, তার উপশম হবে কি?


কুমিল্লার পূজামণ্ডপের ঘটনা যদি ওই দিন সমাধান হয়ে যেত তাহলে এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ ছিলো। কিন্তু এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে হামলা কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার সুযোগ নেই। এটা পরিকল্পিত।


এখন প্রশ্ন এই হামলা যদি বিচ্ছিন্ন ঘটনা না হয়ে পরিকল্পিত হয়, তাহলে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা কী করছে? এ ঘটনার আগে কিংবা পরে কোনো মেসেজ থাকলো না কেন? উত্তেজনা বিরাজ করার পরও কেন সংখ্যালঘুদের মন্দির কিংবা পূজামণ্ডপে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়া হলো না?


সরকার চাইলে এই হামলা ঠেকাতে পারত। পারেনি তার কারণ, সরকারের মধ্যেও অপশক্তি আছে। সংকটের মূল এখানেই।


রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের দায় অবশ্যই বেশি। কারণ তারা এখন রাষ্ট্রের পরিচালক। বিরোধী দল যদি দাঙ্গার চেষ্টা করে, তাহলে ক্ষমতাসীনদের উচিত এটাকে দমন করা। কিন্তু তারা এটা করতে ব্যর্থ। এ ব্যর্থতার দায় শুধু আওয়ামী লীগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার নয়, এ ব্যর্থতা রাষ্ট্রের।


আমাদের সংস্কৃতি পূর্বাপরই বহুত্ববাদকে আলিঙ্গন করে। কাজেই এই সম্প্রীতিকে যারা চ্যালেঞ্জ করতে চাইছে কিংবা ধর্মকে পূজি করে দাঙ্গার চেষ্টা করছে তাদের সমূলে উৎপাটন জরুরি।


সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য শুধু ধর্মীয় দলগুলোকে দায়ী করা ঠিক নয়। ধর্মীয় দলগুলোর বাইরে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য অনেক সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পায়তারা করা হয়। এই আগুন খেলা থামানোর জন্য জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবী, মানবাধিকারকর্মীসহ সবার প্রতিশ্রুতিশীল আচরণের সুযোগ আছে।


সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে হামলা হলো, তাদের মন্দির ও পূজামণ্ডপে ভাঙচুর করা হলো, সেসব ঘটনা সংখ্যাগুরুদের মনে খুব দাগ কেটেছে বলে মনে হয় না। বরং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা আক্রান্তদের প্রতি তাদের সহানুভূতি প্রকাশের চেয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টাই বেশি করছেন।


কুমিল্লার ঘটনার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির নেতারা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। মূলত, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার জন্যই এটা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিকার অর্থে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কল্যাণ চাইতো তাহলে দোষারোপের রাজনীতি ছেড়ে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা ও অপরাধীদের শাস্তি বিধানে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতো।


কিন্তু তারা এ কাজ না করে শুধু ভোটের সময় সংখ্যালঘুদের বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেন; ভোট শেষ হলে সেসব প্রতিশ্রুতি আর রক্ষা করেন না। এটা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু না।


লেখক: সাংবাদিক


বিবার্তা/আরকে

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com