শিরোনাম
কলঙ্কিত ১৫ই আগস্ট : বাঙালি জাতির স্বপ্নের অপমৃত্যুু
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২১, ১৬:১১
কলঙ্কিত ১৫ই আগস্ট : বাঙালি জাতির স্বপ্নের অপমৃত্যুু
ড. মো. রায়হান সরকার রেজভী
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুধু বাঙালি জাতির জন্য নয়, সারা বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, মুক্তিকামী মানুষের জন্য নজিরবিহীন মর্মস্পর্শী শোকের দিন। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহান নেতা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পুরো পরিবার মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। শুধু শোকের দিন হিসাবে নয়, প্রতিহিংসা ও বিশ্বাসঘাতকতার দিবস হিসাবে ১৫ আগস্ট দিনটি পালন করলেও ভুল হবে না। যেই বাঙালিদের জন্য বঙ্গবন্ধু তার সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন, কারাগারে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর, সেই বাঙালির কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে বঙ্গবন্ধু কখনও তা বিশ্বাস করতেন না। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির নানা রকম ষড়যন্ত্র, বিচারের নামে প্রহসন করে যাকে দমাতে, আদর্শ থেকে এক চুল পরিমাণ বিচ্যুত ও হত্যা করতে পারেনি, সেই বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করল কিছু স্ব-জাতি বিশ্বাসঘাতক।যাদের শরীরে বইছে মীরজাফরের রক্ত।


১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধুর ডাকনাম ছিল ‘খোকা’। বাঙালির অধিকার আদায় ও হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন সেই টুঙ্গীপাড়ার ‘খোকা’। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দুইটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়- ভারত এবং পাকিস্তান। পাকিস্তান দুটি পৃথক অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় যার একটি পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা) এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। কিন্তু জন্মের পর হতেই বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠির প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি বাঙালিদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তার উন্মেষ ঘটায়। বাঙালিদের শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম শুরু করেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তার সূচনা আমরা দেখতে পাই ভাষা আন্দোলনে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার পরেই বাংলার ছাত্র সমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন সংগঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে সোচ্চার ছিলেন, এই আন্দোলন জন্য তাকে বার বার কারারুদ্ধ হতে হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সময়ে তিনি জেলে বসেই বিভিন্ন বার্তা পাঠিয়ে ছাত্রনেতাদের দিক নির্দেশনা দেন। বায়ান্ন থেকে একাত্তর বাংলাদেশের মানুষকে শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির আলোয় আনতে দিনের পর দিন তিনি নিজে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থেকেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৫৪ বছরের জীবনের মধ্যে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল মিলিয়ে মোট ৪ হাজার ৬৮২ দিন (প্রায় ১৪টি বছর ও মোট ১৮ বার) কারাভোগ করেছেন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন দুবার (তথ্য সূত্রঃ আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদের সংসদে দেয়া বক্তব্য)। একটা জাতির স্বাধীনতার জন্য তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা ইতিহাসে বিরল। পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী আন্দোলন সংগ্রাম করার পরও স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারছে না শুধু মাত্র একজন যোগ্য, দূরদর্শি এবং অকুতোভয় আপসহীন নেতার অভাবে। আমরা বাঙালি জাতি সৌভাগ্যবান আমরা পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ তার জন্মই হয়েছিল বাঙালি জাতির হাজার বছরের আকাঙ্খা একটি স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন মানচিত্র ও কাঙ্খিত স্বাধীনতা উপহার দেয়ার জন্য। শুধু একজন সফল রাজনীতিবিদ ছিলেন না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছোটবেলা থেকেই তিনি পরোপকারি ও মানবিক ছিলেন। মানুষের প্রতি কোন অন্যায়-অবিচার দেখলে প্রতিবাদ করতেন আর দুঃখ-দুর্দশা দেখলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাইতো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ফিলিস্তিন কিংবদন্তি নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য’।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম আন্দোলনের পর, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি, যোগাযোগব্যবস্থা, খাদ্য গুদাম, শিল্প কারখানাগুলো, স্কুল, কলেজ পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে গেছিলো পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি। ভারতে আশ্রয় নেয়া এক কোটি শরণার্থী ফিরিয়ে আনা, শহীদ পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন করা সেই সাথে ১৯৭২ সালের ভয়াবহ খরা, ১৯৭৩ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি সূমহের নানাবিধ ষড়যন্ত্র অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামলে স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চার নীতির ভিত্তিতে যে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই চার নীতির ওপর ভিত্তি করেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে। দেশি-বিদেশি নানা বাধা বিপত্তি, ষড়যন্ত্র ও সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মাত্র তিন বছরে (১৯৭২-৭৫), যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে ভাবে ঘুরে দাড়িয়ে ছিল তা এককথায় বিস্ময়কর। চিরকাল নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। মাত্র তিন বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সার্বিক, টেকসই উন্নয়ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর একটি আধুনিক উন্নত রাষ্ট্র গঠনের জন্য অনেক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক সুখী-সমৃদ্ধি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলো তার শক্ত ভীত তিনি নিজেই সেই সময়ই স্থাপন করেন। বাংলাদেশ আজকে যে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে হাঁটছে তা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরেই। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার থামিয়ে দিতে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ষড়যন্ত্রকারিরা সফল হয়ে রচিত করে বিশ্বাসঘাতকতার কালো ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত ঘাতক চক্র ও নব্য মীরজাফররা বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পুরো পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ৭৫ এর ১৫ই আগস্ট। স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারিরা দীর্ঘ সময় পরিকল্পনা করে ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়া, মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করা। বাংলাদেশ আবার আলো থেকে অন্ধকারের পথে যাত্রা শুরু করে, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত গোষ্ঠি, উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির উত্থান ঘটে দেশ আবার পাকিস্তানি ভাবধারার দিকে ধাবিত হয়। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সকল অবদান ও ইতিহাস বাঙালিদের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তারা জানতো বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ বেঁচে থাকলে, তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না তাই পরিবার সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ঘাতকরা।


সেই রাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য এবং নিকট আত্মীয় আরো যাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।


বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব- দীর্ঘ ২৪ বছরের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আড়ালে থেকে সারাজীবন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্কটে সংগ্রামে ছিলেন নির্ভীক সহযাত্রী। বঙ্গমাতা আজীবন বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী ছিলেন সেই সাথে সারা জীবন স্বাধীনতা ও দেশের মানুষের জন্য নিরবে কাজ করে গেছেন।


শহীদ শেখ কামাল- হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ২য় সন্তান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব শহিদ শেখ কামাল। ছাত্রলীগের একজন সক্রিয়, আদর্শবাদি একনিষ্ঠ কর্মী ও দক্ষ সংগঠক হিসেবে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা, ১১ দফা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে শহীদ শেখ কামাল সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন এবং আশেপাশের সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে শেখ কামালের অবদান ছিল বীরোচিত। মাত্র ২২ বছর বয়সে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ও তখনকার ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে ফার্স্ট বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের কঠিন প্রশিক্ষণ শেষে শেখ কামাল মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি এডিসি হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংগঠিত করেছেন। গেরিলা বাহিনীর সংগঠনে ও তাদের প্রশিক্ষণে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। শেখ কামাল শুধু একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও তরুণ রাজনীতিবিদই ছিলেন না, ছিলেন একজন অপাদমস্তক ক্রীড়াপ্রেমি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক। আবাহনী ক্রীড়াচক্র, নাট্যচক্র, ঢাকা থিয়েটার ও স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠিসহ আরো অনেক সংগঠন তিনি গড়ে তুলেছিলেন। মাত্র ২৬ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে শেখ কামাল রাজনীতি, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে অবদান রেখে গেছেন, তা চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তার মতো দক্ষ সংগঠক আজ বেঁচে থাকলে এ দেশের ক্রীড়াঙ্গন, সংস্কৃতি অঙ্গন, রাজনীতিতে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আসত।


শহীদ শেখ জামাল- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল। মাত্র ১৭ বছর বয়সী বঙ্গবন্ধুর মেজো ছেলে শেখ জামাল ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট সকালে কাউকে না জানিয়ে তারকাঁটার বেড়া দেয়া পাকিস্তান বাহিনীর ধানমন্ডির বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান। পালানোর সময় পাকিস্তান সেনাদের হাতে তিনি যদি ধরা পড়তেন তাহলে তার মৃত্যু ছিল অনিবার্য। সেখানে তিনি মুজিব বাহিনীর ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরের একজন যোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের পর ব্রিটেনের স্যান্ডর্হাস্ট একাডেমি থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের পোস্টিং হয় ঢাকা সেনানিবাসের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে। মাত্র দেড় মাস ছিল তার চাকরিকাল। কিন্তু এই দেড় মাস সময়ে একজন চৌকস সেনা কর্মকর্তা হিসাবে তিনি তার কর্মকুশলতা ও চমৎকার পেশাগত দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন। নিজের নিষ্ঠা এবং দক্ষতা দিয়ে কয়েক সপ্তাহেই তিনি অফিসার ও সৈনিকদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।


শহীদ শেখ রাসেল- বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার জন্মের পর থেকেই বাবা দীর্ঘদিন রাজনৈতিক বন্দি হয়ে কারাগারে থাকায় রাসেলের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে বাবাকে ছাড়া। ১৫ আগস্ট কালো রাতে ১১ বছর বয়সী শিশু শেখ রাসেল কেঁদেকেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। মায়ের লাশ দেখার পর মিনতি করেছিলেন ‘আমাকে হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন’। ঘাতকদের নির্মম, নিষ্ঠুর হৃদয় সে দিন তলাটে পারে নাই ছোট শেখ রাসেল। ঘাতকেরা নির্মম বুলেটে ক্ষতবিক্ষত করে ছোট্ট রাসেলকে।


শহীদ শেখ আবু নাসের- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ আবু নাসের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ৯ নম্বর সেক্টরে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে নিহত হন তিনি।


শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভগ্নিপতি শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি। তিনি বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি ও বেগম আরজু মনি- বঙ্গবন্ধুর মেজো বোন শেখ আছিয়া বেগমের বড় ছেলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনি। ১৯৬০-৬৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন, গণবিরোধী শিক্ষানীতি ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফাসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান গেরিলা বাহিনী মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন শেখ ফজলুল হক মনি এবং তিনি ছিলেন যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তাকে বাংলাদেশের যুব রাজনীতির পথিকৃৎ বলা হয়। ১৫ আগস্টের সেই রাতে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনি ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ কন্যা বেগম আরজু মনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যান শেখ ফজলুল হক মনির জ্যেষ্ঠপুত্র পাঁচ বছর বয়সী শেখ ফজলে শামস পরশ ও কনিষ্ঠপুত্র শেখ ফজলে নূর তাপস (তিন বছর)।


শহীদ সুলতানা কামাল খুকী- বঙ্গবন্ধু পরিবারে শহীদ শেখ কামাল ভাইয়ের নববধূ হয়ে আসা সুলতানা কামাল খুকী, ছিলেন দেশ সেরা অ্যাথলেট। তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাতকরা। বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সুলতানা কামাল খুকী ছিলেন বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের হয়ে লং জাম্প ও ১০০ মিটার স্প্রিন্টে রুপা ও ব্রোঞ্জ পদক জয়ী প্রথম অ্যাথলেট। তিনি ছিলেন স্প্রিন্ট আর লং জাম্পে ন্যাশনাল রেকর্ডধারী। সুলতানা কামালের নামটাও স্মরণীয় হয়ে থাকবে বর্তমান প্রজন্মের অ্যাথলেটদের কাছে। দেশের ক্রীড়াঙ্গন চিরকাল ঋণী থাকবে শেখ কামাল ও সুলতানা কামালের কাছে, কারণ তাদের হাত ধরেই নতুন ধারার সূচনা হয় এদেশের ক্রীড়াঙ্গনের।


শহীদ পারভীন জামাল রোজীর- পারভীন জামাল রোজী ও শহিদ শেখ জামালের সংসার জীবন ছিল মাত্র আঠাশ দিনের। হাতের মেহেদী পাতার রং মুছে যাওয়ার আগেই তার জীবনে নেমে আসে ১৫ আগস্টের কালো রাত।


এ ছাড়াও বেবী সেরনিয়াবাত (১৫ বছর), আরিফ সেরনিয়াবাত (১১ বছর), সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু (মাত্র ৪ বছর), শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্ণেল জামিল উদ্দিন আহমেদকে ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশের বাইরে থাকায় সেদিন মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রাণে বেঁচে যান জাতির পিতার দুই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
পৃথিবীতে এইরকম পরিকল্পিত, জঘন্যতম ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের আর কোনো নজির নেই যেখানে অন্তঃসত্ত্বা নারী, নিষ্পাপ শিশু, কিশোর কাউকে বাদ দেয়া হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অ্যাক্ট বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। তারা সেখানেই থেমে থাকেনি, জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলে বিভিন্নভাবে তাকে বার বার হত্যার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে ঘাতকরা। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সকল অবদান ও ইতিহাস বাঙালিদের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে যা করা দরকার ছিল তার সব চেষ্টাই করেছে। নানা রকম অপপ্রচার, মিথ্যাচার, গুজব চালিয়েছিল ঘাতক ও বাংলাদেশ বিরোধী এই চক্রটি। কিন্তু সব রকম মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইনডেমনিটি অ্যাক্ট বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করে। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে সেই বিচার কাজ আবার বন্ধ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২০০৯ সালে সেই বিচার কাজ শেষ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিতে ও সোনার বাংলা নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছোট বোন শেখ রেহানা নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল, তারা সফলত হননি, বরং তারাই আজ ইতিহাস থেকে বিলিন হয়ে যাচ্ছে।
তাই কবি শামসুর রাহমান যথার্থই বলেছেন-
‘‘ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে চিরকাল,
গান হয়ে নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা,
যাঁর নামের ওপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পাখা মেলে দেয় জ্যোৎস্নার সারস,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পতাকার মতো দুলতে থাকে স্বাধীনতা,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর ঝরে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।”


বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাছে একটাই প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধুর শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঠিক ইতিহাস শিক্ষার্থী ও নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি।


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে নির্মমভাবে নিহত সকল শহীদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।


সহকারী অধ্যাপক,
ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এবং কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।


বিবার্তা/ইমরান

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com