‘তালাবদ্ধ’ কথাটা বড্ড নিরাপদ এবং বেদনাদায়ক। আজ পর্যন্ত গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরিতে যত মৃত্যুর মিছিল হয়েছে, তার পেছনে ‘তালাবদ্ধ’ শব্দটি জড়িত।
বাসা তালাবদ্ধ করে বের হলে মালামাল নিরাপদ মনে হয়।গাড়ি তালাবদ্ধ করে রাখলে গাড়ি নিরাপদ মনে হয়।হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল খাঁচিয়ে রাখলে গবাদিপশু নিরাপদ মনে হয়। মোবাইল লক (ডিজিটাল তালাবদ্ধ) করে রাখলে মোবাইল নিরাপদ মনে হয়।টাকা, গহনা ব্যাংকের লকারে রাখলে সেটাও নিরাপদ মনে হয়। গৃহে কাজের মেয়েকে তালা মেরে বেড়াতে গেলেও নিজেরা নিরাপত্তার ঢেকুর তুলি।
অথচ আমরা এত নিরাপত্তার ভেতর জীবন তালাবদ্ধ করে রাখলে যে তা কতটা অনিরাপদ সেটা একদম ভুলেই যাই। এত নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে করতে ‘নিরাপত্তা এবং তালাবদ্ধতা’ আমাদের মানসিক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ক্লাসে একজন শিক্ষক বলেছিলেন- ‘আমরা যদি একে অপরকে বিশ্বাস করতাম, সমাজে সর্বক্ষেত্রে যদি বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে পৃথিবী তালা-চাবি যন্ত্রটির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতো। কোন কিছুতে আর তালা আটকাতে হতো না। পৃথিবীর অনেক টাকা তালাবদ্ধতার বাজেট থেকে বেঁচে যেতো।’ কথাটি আমার অনেক ভালো লেগেছিলো। ফেসবুকে এটা নিয়ে টুকটাক লিখেছিলামও একসময়।
একই বাসায় ভালোবাসার পরিবার, বিশ্বাসের পরিবার, আত্মার পরিবার, এক ছাদের নিচে বসবাস করি। অথচ প্রত্যেকের নিজস্ব লকার থাকে, তালা-চাবি থাকে। সকল সম্পর্কের অবিশ্বাস গিয়ে ঠেকে ‘তালাবদ্ধতায়’। বাবা-মা, ভাই-বোন সবার সবকিছু খোলামেলা, শুধু বিশ্বাসটুকু থাকে তালাবদ্ধ।
ফ্যাক্টরিতে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তালাবদ্ধ শব্দটি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট তো দূরের কথা, তদন্ত কমিটি তৈরি করার আগেই তালাবদ্ধতা শব্দটি প্রকাশিত হয়েছে। শ্রমিকরা বেতন, ভাতা, চাকরির নিরাপত্তা কত কী নিয়ে আন্দোলন করেছে কিন্তু; ‘তালাবদ্ধতার’ বিপক্ষে তালা হাতে জোরালো কোনো আন্দোলন আমি দেখিনি। যে তালাবদ্ধতায় তাদের জীবন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে সে বিষয়ে তাদের যথেষ্ট সচেতন হওয়া দরকার।
আজকে নারায়ণগঞ্জের সেজান জুস ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেখতে পেলাম তালাবদ্ধ ছিলো, ফলে মৃত্যু এবং হতাহতের ঘটনা এত বেশি। অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়ায় ছাদে যেতে পারলে অনেকেই হয়তো নিঃসাশ নিতে পারতো, ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কাজও কিছুটা সহজ হতো। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরিগুলোতে যে মালিকপক্ষ তালাবদ্ধ করে রাখে, তাতে কারোর জীবনের থেকে কী এমন বড় উপকার মালিকপক্ষের হয়?
তালাবদ্ধতার কারণে এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারী সকল আত্মার প্রতি সমবেদনা রইল। মালিকপক্ষ ‘তালাবদ্ধতার’ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসবে এই প্রত্যাশা করছি।
‘তালা যেন না হয় জীবনের জ্বালা’।
লেখক: সাবেক ছাত্র সংগঠক
বিবার্তা/আরকে
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]