শিরোনাম
করোনা প্রতিরোধে জীবন-জীবিকার সমন্বয়হীনতা কেন?
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২১, ১৩:৫৮
করোনা প্রতিরোধে জীবন-জীবিকার সমন্বয়হীনতা কেন?
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

অদৃশ্য এক শক্তি জীবন-জীবিকাকে করে তুলেছে বিপন্ন। বিশ্ববাসী এ শক্তি থেকে টিকে থাকার জন্য অবলম্বন করছে বিভিন্ন পন্থা। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। এসব পন্থার মধ্যে রয়েছে - লকডাউন, আংশিক লকডাউন, সম্পূর্ণ লকডাউন, সাধারণ ছুটি কিংবা শাটডাউন। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সংক্রামিত ব্যক্তির কথা জানা যায় ৮ মার্চ, ২০২০ সালে। রোগের সংক্রামণ কমানোর জন্য মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ধাপে ধাপে সাধারণ ছুটি, লকডাউন ও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।


বাংলাদেশে করোনার প্রথম ঢেউয়ে ধারণা করা হয়েছিল, শীতকালে এ ভাইরাসের প্রকোপ আরো বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে এর অবস্থা ছিল বিপরীত। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে সংক্রামণের গ্রাফ কিছুটা ওপরের দিকে উঠলেও ডিসেম্বর মাস থেকে সেটি দ্রুত নিচের দিকে নামতে থাকে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সংক্রামণের হার ৩ শতাংশের নিচে নেমে আসে। কয়েক মাসের ব্যবধানে শহরাঞ্চলের অনেক লোক কর্মহীন হয়ে পড়ে। বাসাভাড়া দিতে না পেরে একসময় কাজের সন্ধানে শহরমুখী মানুষ দিশেহারা হয়ে গ্রামে ফিরতে থাকে। শুরুর দিকে গ্রামে ভাইরাসটির বিস্তার কম থাকলেও শহরকেন্দ্রিক মানুষের গ্রামে ফেরায় গ্রামেও তার প্রভাব পড়তে থাকে। কোভিড রুখতে ছুটি ও বিধিনিষেধে থমকে যায় খেটে খাওয়া মানুষের জীবন, যাদের কেও কেও পেশা বদলে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে।


এখনো পর্যন্ত টিকা প্রয়োগ ছাড়া কোন সংক্রামণ রোগই নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। যদিও টিকা আবিষ্কার সময় সাপেক্ষ। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানী-গবেষকরা দ্রুততার সাথে এ রোগের টিকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের নানাবিধ কার্যক্রম দৃশ্যমান। সরকার শুরুর দিকে দ্রুততার সাথেই টিকা আমদানির বিষয়ে ভূমিকা রেখেছে। প্রথম দিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রজেনেকা ভ্যাকসিনের তিন কোটি ডোজ কেনার চুক্তি থাকলেও দুই কিস্তিতে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এসব নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। দেশ যেখানে করোনার ভয়াল থাবায় নিমজ্জিত সেখানে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ব্যস্ত তাদের আখের গোছাতে। সরকারপ্রধানের কঠোর হুশিয়ারি উপেক্ষা করে মানবতাবিরোধী গোষ্ঠী এখনো তৎপর অসাধু কাজে। তার প্রভাব পড়ছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ওপর।


করোনার প্রথম ঢেউয়ের প্রভাব থেকে দেশ যখন ধীরে ধীরে স্থিতিশীল পরিবেশের দিকে অগ্রসরমান তখনই আঘাত হানে দ্বিতীয় ঢেউ। আমরা প্রায় নিয়ন্ত্রণমূলক একটা অবস্থা থেকে গভীর খাতে নিমজ্জিত হোলাম। আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে যখন এর প্রকট আকার ধারণ করে তখন বিধিনিষেধ মানাতে আমাদের অনীহা প্রকাশ পায় যা ফুটে ওঠে সীমান্তে চলাকালীন নানা কার্যক্রম থেকে। বাংলাদেশে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রথম তথ্য পাওয়া যায় মে মাসের শুরুর দিকে। তখনো দেশের সীমান্তদারগুলোতে কঠোর নজরদারি অনুপস্থিত। তার ফল ভোগ করছে পুরো দেশ।


করোনা ভাইরাস জীবনঘাতী হলেও এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। অথচ কঠোর বিধিনিষেধ নিমিষেই শিথিল হতে দেখা যাচ্ছে। করোনা মহামারীর এই ঢেউয়ে জীবন-জীবিকা দুই-ই এখন হুমকির সম্মুখীন। সম্প্রতি প্রকাশিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর এক গবেষণা বলছে, করোনাকালে দেশের শ্রমিকদের মাত্র ৮ শতাংশ সরকারের দেয়া খাদ্য ও অর্থ সহায়তা পেয়েছে। করোনার সময় কেবল শহরাঞ্চলেই ১০ লাখ শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। মজুরী কমেছে অনেক শ্রমিকের।


শুরুর দিকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায়দের পাশে সরকারি সহায়তার দৃশ্যপট বর্তমানে ভিন্নরূপ। কঠোর বিধিনিষেধের যাঁতাকলে পিষ্ট খেটে খাওয়া মানুষ। ক্ষুধার কাছে করোনা তুচ্ছ! যিনি দিন চুক্তির মজুরিতে পরিবারের দুবেলা আহার জুটাতেন, পণ্য ফেরি করে গামছায় করে চাল নিয়ে বাসায় ফিরতেন, রিকশা/ভ্যানের প্যাডেলে চলত যার পেট তিনি এখন অসহায়। এর আকার প্রকট হয়েছে দ্বিতীয় মেয়াদের লকডাউন এপ্রিলের গত ৫ তারিখে শুরু হলে। ক্রমাগত অবস্থা যে কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছিল তা আমাদের গত ঈদে ফেরিতে পদদলিত হয়ে মা-বাবা-সন্তানের লাশ মনে করিয়ে দেয়। দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তি খুলনা বিভাগের যশোর জেলায়। আমার আবাস্থল উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা খুলনা শহরে হওয়ায় খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট আমি কাছ থেকে অনুভব করছি। দু-কেজি চাল খোলা বাজারে দু-টাকা কমে কিনতে, করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমাদের মতো যাদের মাস গেলে বেতন নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, তারা কি বুঝবে এই সব মানুষের না খেয়ে থাকার কষ্ট?


আমাদের সমাজে যেকোনো দুর্যোগ এলে একপক্ষ সুযোগসন্ধানীর ভূমিকায় দৃশ্যমান হতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে যারা প্রাপ্য তারা অগোচরেই থেকে যায়। এবারো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ত্রাণ লুটপাট, টিকা নিয়ে অবৈধ কারসাজি, করোনার ভুয়া রিপোর্ট ইত্যাদি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিছে সুযোগসন্ধানীদের কর্মতৎপরতা। সরকারের অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ এসব অসাধুদের কারণে নিষ্ফল হয়।


ঘরে যদি আগুন লাগে বাঁচার জন্য ১০ তালার উপর থেকে লাফ দিয়েও মানুষ বাঁচতে চায়। অথচ সে তখন অনুধাবন করতে পারে না নিচে পড়ে গিয়েও তার মৃত্যু হতে পারে। প্রায় দেড় বছর ধরে চলা এই মহামারীতে নাজুক সকলেই জানেন স্বাস্থ্যবিধি। কিন্তু তারা মানছে না কেন? ওই যে বললাম আগুন থেকে বাঁচার জন্য লাফ দেয়। তেমনই করোনার ঝুঁকিকে চ্যালেঞ্জ করেও না খেয়ে মরতে চায় না। এছাড়া দীর্ঘদিন ঘরবন্দি কর্মহীন মানুষের মাঝে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, পারিবারিক কলহসহ নানা ধরণের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। চলমান এই বিপদজনক অবস্থা থেকে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার জন্য বিকল্প ব্যবস্থায় টিকা সরবরাহ, স্বাস্থ্যবিধি পালনে আইন-কানুনের কঠোর প্রয়োগের সাথে সাথে কর্মহীন মানুষের করে দিতে হবে জীবিকার পথ। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ, সমাজে বিত্তবানদের সদিচ্ছা ও সমানুভতি পারে কর্মহীনদের কিছুটা দুর্দশা লাঘব করতে।


করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে সহায়তায় যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন তারা যেন অমানবিক না হন। আরা যারা সরকারের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক। সরকারের যথাযথ কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন, ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যহীন সমাজ দৃশ্যমান হোক।


লেখক: মৌসুমী খাতুন
সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/জহির

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com