শিরোনাম
আমার বিনম্র শ্রদ্ধা প্রিয় লেখক
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৩৩
আমার বিনম্র শ্রদ্ধা প্রিয় লেখক
অনামিকা রায়
প্রিন্ট অ-অ+

গল্পটা বেশ পুরোনো, সাল-টাল মনে নেই। মেজদাদা বাড়িতে এসছেন সেই উপলক্ষে আনন্দ আয়োজন বসেছে আমাদের উঠোনে। আয়োজন অতি সামান্য - লটারিতে যার নাম উঠবে সে অভিনয় করে কোনো বিষয় উপস্থাপন করবে বাকিদের সে বিষয়ের নাম বলতে হবে। একে একে অনেকেরই পালা শেষ। এবার মেজদার পালা। মেজদা হাত-পা নেড়ে কীসব যেন দেখিয়েই যাচ্ছেন আমরা কেউই ধরতে পারছি না! একবার দু'হাত মুখের কাছে নিচ্ছে তো একবার আকাশ দেখাচ্ছে।! আমরা অসহায় হয়ে চেয়ে আছি। ওমন একটা অসহায় মূহুর্তে ছোট মামা বলে ওঠলেন "শঙ্খনীল কারাগার "। শব্দগুলো আমার ছোট মনের মধ্যে যেন এক দোলা দিয়ে গেলো। কী চমৎকার শব্দমালা! আমি কোনোদিন আগে শুনিনি। সেইদিন প্রথম পরিচয় আমার হুমায়ূন আহমেদের সাথে।


প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে আসত বকুল আপা, মফিজ পাগলা!! আর তাদের ঘিরে গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষের আসর জমত আমাদের বারান্দায়। কাউকে বলে বোঝানোর প্রয়োজন এখন আর নেই যে বকুল আপা, মফিজ পাগলা কোনো ব্যক্তি মানুষের নাম নয় এরা সব হুমায়ূন আহমেদের সবুজ সাথী নাটকের চরিত্ররা। কিন্তু চরিত্রগুলো এতোই জীবন্ত ছিলো যে আমার মনে হতো ওরা সকলেই আমাদের কাছের মানুষ, পরিবারের মানুষ। নাটকের গল্প যেন আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জীবন থেকে নেয়া। আমরাই যেন বকুল আপা, মফিজ পাগলা।


" নক্ষত্রের রাত" নাটকটা যখন দেখলাম মনে হলো আরে এই মবিন, মনীষার বাবাতো আমার বাবা! ওনি নিশ্চয়ই আমার বাবা সম্পর্কে জানেন। মানুষের জন্যে এত দরদ আমার বাবা ছাড়া আর কারো হতেই পারে না! মানুষের এত সাধারণ ছোট ছোট আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসাই যে জীবনের মূলমন্ত্র তাতো হুমায়ূন আহমেদই প্রকাশ করেছেন সবার কাছে। কালো মেয়ের জন্যে রং ফর্সা করা ক্রীম কিনে গভীর রাতে তো আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবারাই দিতে পারে। ওই ভালোবাসার গভীরতা কোনো বিত্তশালী বাবার থাকার কথা নয় নিশ্চয়ই।


অনাদিকাল থেকেই তো পৃথিবীতে বৃষ্টি নামে, কদম ফোঁটে। আকাশ ভেঙে ফিনকি দিয়ে পড়া জোছনায় ভেসে যায় পৃথিবী। এগুলোর মায়ায় পড়েছিতো ওনার লেখা পড়েই। মায়ের সাথে বসে যখন চাঁদ দেখতাম, জোছনায় আমাদের গা ভিজে যেত। মা গান করত- আমার সোনার ময়না পাখি....(আমার মা অবশ্য এই একটা গানই জানত!) আমাদের মা-মেয়ের গল্পটাও তো আপনি লিখে রেখে গেছেন অন্যদের জন্যে। কতবার মনে হয়েছে আমিই যেন রূপা, নীল শাড়ি-চুড়ি টিপ পরে হিমুর অপেক্ষা করছি জানালায়। রাবেয়া আপাটা বোধ হয় আমিই- গায়ের রং-এর জন্যে যার বারবার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে।


আমার সাথে হুমায়ূন আহমেদের একটা গল্প আছে। আমার উপর পরম করুণাময় তাঁর করুণা বর্ষণ করেছিলেন আর তাইতো ওনার মৃত্যুর আগের বছর আমার সাথে ওনার দেখা। ওনি এসেছেন ওনার জন্মদিন উপলক্ষে পাবলিক লাইব্রেরিতে একটা বইমেলা উদ্বোধনে। আমিতো সেখানে উপস্থিত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো। ওনি ফিতা কাটলেন, কথা বললেন, বেলুন ওড়ালেন। তারপর স্টলে গিয়ে চেয়ার পেতে বসলেন। ততক্ষণে লাইন পড়েছে লম্বা অটোগ্রাফ নেবার। আমিও লাইনে দাঁড়ালাম। সবার হাতে ওনার বই। আমি তাড়াহুড়ো করে গেছি। টাকা নিতে মনে নেই। আমার হাতে কোনো বই নেই। খুবই চিন্তায় পড়লাম অটোগ্রাফ নিবো কিসে? তাছাড়া বই ছাড়া যদি অটোগ্রাফ না দেন ওনি? এসব ভাবতে ভাবতে আমি একেবারে ওনার সম্মুখে। জানি না আমার কি ঘোর লেগেছিলো তখন- ওনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন নাম কী, কোথায় পড়ি? আমি ওসবের উত্তর না দিয়ে ওনাকে বলে ফেললাম আপনার হাত ধরে আমাকে পাঁচমিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে দিবেন? ওনি আমার দিকে তাকালেন তারপর হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন নাম বল এবার। আমি নাম বললাম। আমার কাছে আরও কীসব জানতে চাইলেন। আমার মাথায় কিছুই ঢোকেনি। আমি বিশ্বজয়ের আনন্দে তখন দিশেহারা।


ওইদিনটা আমার জীবনের একটা বিশেষ দিন। যে মানুষটা আমায় বৃষ্টিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, জোছনায় দিশেহারা হতে শিখিয়েছেন তাঁকে আমি ছুঁতে পেরেছি এই আনন্দ আমার অন্যসকল বড় পাওয়ার থেকেও ঢের বেশি। ওইদিন আমি অটোগ্রাফও পেয়েছিলাম বইয়ে নয় আমার খুব প্রিয় একটা ডাইরিতে!


যেদিন আপনাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে চিরবিদায় জানাতে আমি খুউব কেঁদেছিলাম সেদিন। মনে হচ্ছিল একান্তই নিজের কেউ চলে যাচ্ছে বহুদূরে। কষ্ট হচ্ছিল খুব এই ভেবে যে আপনি আর আমাদের নিয়ে ভাববেন না, লিখবেন না কোনোকিছু। ছোট থেকেই দেখেছি আমাদের সংসার সবার থেকে আলাদা। বাঁধ ভাঙ্গা জোছনায় সবাইকে নিয়ে আনন্দ করেছি আমরা, বৃষ্টিতে নেচে গেয়ে আপনার ভাষায় বৃষ্টি বিলাস করেছি সবাই। তখন ভাবতাম আমরা বোধ হয় এমনই! পরে বুঝেছি আমাদের এমন করছেন আপনি, আপনার লেখা। 'শঙ্খনীল কারাগার' বইটা পড়ে খুব কেঁদেছিলাম আমি। মনে হয়েছিল এই বইয়ের সব চেয়ে দুঃখি চরিত্রটা আমাকে নিয়ে লেখা। আপনি যেন আমার জীবনকেই তুলে দিয়েছেন আপনার ভাষায়! বই পড়েছি অনেক ভালোও লেগেছে সেসব। কিন্তু আপনার মতো প্রিয় হয়ে ওঠেনি কেউ। আমার বিনম্র শ্রদ্ধা প্রিয় লেখক।


বিবার্তা/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com