শিরোনাম
এম.সি. কলেজে গৃহবধূ ধর্ষণ ও ঘাতকের হাতে নীলা রায়ের মৃত্যু!
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২০, ২০:০৫
এম.সি. কলেজে গৃহবধূ ধর্ষণ ও ঘাতকের হাতে নীলা রায়ের মৃত্যু!
শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল
প্রিন্ট অ-অ+

দেশে যেন ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের উৎসব চলছে। যাদের এসব ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কথা, দেখা যায় তারাই এখন ধর্ষণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। সিলেট এম সি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে ছাত্র নামধারী কতিপয় দুর্বৃত্ত।


আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতেমা আক্তার মিডিয়ার সামনে এসে অভিযোগ করেছেন নিজ দলের অর্থাৎ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের ভাইরা থাকে ধর্ষণ করেছে। ফেসবুকে লাইভে এসে তাকে পতিতা বানানোর ভয় দেখানো হচ্ছে।


এই যখন অবস্থা, তখন বলতেই হবে দেশের কিশোরী, তরুণী অর্থাৎ নারী সমাজ একটা ভয়াবহ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় জীবন-যাপন করছে।


আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনি কি আপনার স্কুল কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে খুবই চিন্তিত? এবং আপনি যদি অতি সাধারণ মানুষ হন, তাহলে আপনার উত্তর হবে না ভাই ভালো নেই। পাড়ার বখাটে ছেলেটার জন্য আমার মেয়েটার লেখা পড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমার মেয়েটা প্রাইভেট পড়ার জন্য কিংবা কোথাও বেড়াবার জন্য রাস্তায় বের হতেই পারেনা। কেউ বলবেন স্কুলে যেতে পারেনা কিংবা কেউ বলবেন কলেজে যেতে পারেনা। এলাকার বখাটেরা পথের মধ্যে বসে থেকে উত্যক্ত করে। বখাটেদের বাবা-মাকে বলেও কোনো লাভ হয় না। থানা পুলিশও করতে পারি না। থানা পুলিশ করলে বখাটেরা যেমন আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে, তেমনি করে আমাদের ডিজিটাল সমাজ ব্যবস্থা আমার মেয়েটারই বদনাম করবে।


সাভারের নীলা রায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বড় ভাই অলক রায় তাকে চিকিৎসা করাবার জন্য এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে পথিমধ্যে পথ আটকে দাঁড়ায় মিজানুর। বড় ভাই অলক রায়ের কাছ থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় দক্ষিণ পাড়ার নিজেদের পরিত্যক্ত বাড়িতে। নীলা রায়কে সেখানেই উপর্যুপুরী ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় সে। নীলার চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন থাকে উদ্ধার করে রক্তাত অবস্থায় স্থানীয় প্রাইম হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎকরা নীলা রায়কে মৃত ঘোষণা করেন। মিজানুরের পরিবার খুবই প্রভাবশালী। তার বাবার অর্থ-বিত্তের অভাব নেই। তাই এলাকায় তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক। যাদের সমাজে অনেক প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকে তারা মনে করে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির কাছে আশেপাশের মানুষজনসহ সবকিছুই তুচ্ছ। তাদের ধারণা তারা দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের সাথে যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন।


আজকাল পত্র-পত্রিকা খুললেই আমারা দেখতে পাই আমাদের চারিদিকে বখাটেদের দৌরাত্ব্য এতোটাই বেড়েছে যে, যা দেখলে মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে, কে কিংবা পর্দার আড়ালের কোনো অশুভ রাজনৈতিক শক্তি এসব বখাটেদেরকে এতোটা সাহস যোগায়। আবার এমন প্রশ্নও মনে আসে কোথায় বখাটেরা আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। রাষ্ট্রযন্ত্র কেন এসব বখাটের সামনে অসহায় মুখ ও বধির হয়ে থাকে। থানা পুলিশ যেনো অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে নিজেদের ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে কষ্ট পেয়ে থাকে।


যারা পত্র-পত্রিকা নিয়মিত পড়ে থাকেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, প্রতিদিনের পত্র-পত্রিকায় কোনো না কোনো পৃষ্ঠায় কিশোরী ধর্ষণের খবর কিংবা বখাটেদের জন্য স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না কিংবা বখাটেদের অপমান সহ্য করতে না পেরে কিশোরী/তরুণীরা আত্মহত্যা করছে এমন সংবাদ। আবার এরূপ সংবাদও পড়ে থাকবেন যে, বখাটেদের জ্বালায় স্কুল-কলেজে ছাত্রীরা পড়াশোনা বন্ধ করে ঘর বন্দি হয়ে আছে। বখাটেদের পিতা মাতার কাছে অসহায় মেয়ের পিতা মাতারা কোনো বিচার পান না। কেউ যদি একটু বিষয়টা তলিয়ে দেখেন, তাহলে দেখবেন বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বখাটেদের অভিভাবকরা বয়সকালে এমনি বখাটে ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের উত্যক্ত করত। তা না হলে একজন লোক তার পুত্রের বখাটেপনার শাসন না করে কেন ছেলের বখাটেপনায় উৎসাহ যোগান। পরিবার থেকে যখন একটা ছেলে বখাটেপনা কিংবা দুর্বৃত্তপনায় উৎসাহ পেয়ে থাকে, তখন সেই ছেলের চোখে-মুখে কে মার সমান কিংবা কে ছোট বোনের মত তা নষ্টদের চোখে লাগে না। অবশ্য তা লাগবারও কথা নয়। নষ্টরা সকল সময় নষ্টই হয়ে থাকে।


আমরা যদি দেশে ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যানের দিকে একটু দৃষ্টি ফেলি, তাহলে দেখতে পাবো দেশে নারী কিংবা কিশোরী নির্যাতন কোভিড-১৯ ভাইরাসের মত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সংবাদ ভাষ্যমতে শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শৈথিল্যের জন্য ৮ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮৮৯টি এবং যৌতুকের ঘটনা ঘটেছে ১৬৩টি। সংবাদ পত্রে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয় যে, আইন ও শালিস কেন্দ্র হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৯২ জন নারী।


শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬৬ জন নারী। ধর্ষণের পর মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন নয় জন। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ১৯২ জন নারীকে। গত ৮ মাসে স্বামীর নির্যাতনে মারা যান ১৬৩ জন নারী। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ৫৫ জন নারী মারা যান। এসিড হামলার শিকার হন ১৭ জন নারী। শুধু নারীদের উপরই যে, এমন ভয়াবহ নির্যাতন হয়ে থাকে তা নয়। পরিসংখ্যান বলছে আমাদের কন্যা শিশুরাও যৌন সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামে দেয়া তথ্যমতে গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৩২৪ জন কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয় এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১০৪ জন শিশু।


আমরা যদি উপরের পরিসংখ্যানের একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা করতে যাই, তাহলে দেখতে পাব দেশে নারী নির্যাতন, কিশোরী ও কন্যা শিশু নির্যাতন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই নির্যাতন বাড়ছে এই জন্য যে, দেশের এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাদের বখাটেদের দলে টানার জন্য এবং অনেক ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলা কিংবা কর্তাব্যক্তিদের ইচ্ছাকৃত অবহেলা পরিলক্ষিত হয় বখাটেদের দৌড়াত্বের ক্ষেত্রে। বখাটেদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে দেশের কিশোরী/তরুণীরা আত্মঘাতী হয়ে থাকে কিংবা বখাটেদের হামলায় মৃত্যুবরণ করে থাকে। আমরা প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দেখে থাকি, কিন্তু সমাধানের ব্যাপারে যাদের কিছু করার কথা তারা কিছুই করছেন না। আমাদের এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদরা এতোটাই লাগামহীন হয়েছেন যে, তারা তাদের রাজনৈতিক ভিত্তিকে শক্ত কাঠামোর মধ্যে দাঁড় করার জন্য এমন সব লোকদের কিংবা বখাটে সন্ত্রাসীদের দলে টানেন, যা দেখে সত্যিকার অর্থে যারা দেশের জন্য কিছু করতে চান সেইসব হৃদয়বান রাজনীতিবিদরা রাজনীতির পথ আর ধরেন না। কেননা সচেতন ব্যক্তিবরা ভালো করেই জানেন, রাজনীতির মাঠে এখন এমন সব মানুষের আমদানি হয়েছে, যাদের ঠেলায় ভালো মানুষরা মানুষের জন্য কিছু করতে পারবেন না। একটা কথা সবারই মনে রাখা উচিত দেশের রাজনীতির মাঠে যখন একশ্রেণীর নষ্ট রাজনীতিবিদদের প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে যায়, তখন নীলা রায়ের মতো কিশোরীরা রাস্তার বখাটের দ্বারা আক্রন্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করবেই। তা রাষ্ট্র কিংবা কেউ ঠেকাতে পারবে না। কেননা রাজনীতির মাঠে নষ্ট রাজনীতিবিদরা নিজেদের পদ পদবী ঠিক রাখার জন্য আজ যা ইচ্ছা করতে পারেন। এমনকি নিজের আপন বন্ধু কিংবা সন্তানকেও যদি বলি দিতে হয়, তা-ও তারা করতে পারবেন। একটা বখাটে কিভাবে সাহস পায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের কন্যাদের উত্যক্ত করার কিংবা গৃহবধূকে ধর্ষণ করার কিংবা ছাত্রীদের জড়িয়ে ধরার কিংবা ভাইয়ের হাত থেকে জোর করে টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে হত্যা করার। বখাটের দল তখনই সাহস পায়, যখন একটা বখাটে কিংবা বখাটের দল বুঝে যে, সে যতই দুর্বৃত্তপনা করুক না কেন, একজন পর্দার আড়াল থেকে তাকে কিংবা তাদেরকে কেউ না কেউ কিংবা একজন রক্ষা করে যাবেই।


এমনি এমনি সাভারের মিজানুর কিংবা সিলেট এম.সি. কলেজের কতিপয় ছাত্র নামধারী ধর্ষক কিংবা বরগুনার রিফাত হত্যা মামলার আসামি ক্রসফায়ারে নিহত নয়ন বন্ড সৃষ্টি হয়না। তাদের মত ভয়ঙ্কর মানুষদের এক শ্রেণীর ক্ষমতাবানরাই সৃষ্টি করে থাকেন। বখাটেদের জন্য পর্দার আড়ালে থাকা একশ্রেণীর ক্ষমতাবনরা সাহস না যোগালে বখাটে কিংবা সন্ত্রাসীরা কি সাহস পাবে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কিংবা বখাটেপনা চালিয়ে যাওয়ার?


এখন স্বাভাবিক ভাবেই একটা প্রশ্ন আসতে পারে, এই যে এম.সি. কলেজের ছাত্রাবাসে গৃহবধূ ধর্ষিত হলো কিংবা আপন দলের বড় ভাই দ্বারা একজন ছাত্রী ধর্ষিত হলো কিংবা নীলা রায়ের মতো একজন কিশোরী চলার পথে কিংবা ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করতে গিয়ে রাস্তার বখাটের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, তার দায় কি রাষ্ট্রের নয়? আমাদের সমাজটা কি এতোটাই পঁচে গেছে যে একজন ভাই তার বোন কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে নির্ভয়ে যেতে পারবে না কিংবা একজন স্বামী তার প্রিয়তমা বধূকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে পারবে না কিংবা একজন ছাত্রী কি তার নিজ দলের বড় ভাইদের কাছে নিরাপদ থাকবে না। সাধারণ মানুষ মনে করে রাষ্টের কর্তা ব্যক্তিরা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযত ভাবে পালন করছেন না বলেই, আমাদের পথ-ঘাট, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস সবকিছু ধর্ষক-দুর্বৃত্তদের দখলে চলে গেছে। তাই দেশবাসী মনে করে আমার এই দেশমাতৃকাকে ধর্ষক ও বখাটে শূন্য করতে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য করার জন্য রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।


লেখক: আইনজীবী, কবি ও গল্পকার।


বিবার্তা/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com