শিরোনাম
স্বপ্ন পূরণের শহরে আবাসন নিয়ে বিপাকে শিক্ষার্থীরা
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২০, ১৫:১৪
স্বপ্ন পূরণের শহরে আবাসন নিয়ে বিপাকে শিক্ষার্থীরা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকা শহর, স্বপ্ন পূরণের শহর। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো একবুক আশা নিয়ে, প্রতিষ্ঠিত ভবিষ্যতের আশায়, উচ্চশিক্ষার আলো নিতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসে মেট্রোপলিটনে। কাঁধে একটা ব্যাগ, নীলক্ষেত বা এলাকার দোকান থেকে কেনা দুহাত মাপের চেয়েও শীর্ণ একটা তোষক, বালিশ আর ট্রাঙ্ক (সময়ের পরিবর্তনে লাগেজ ব্যাগ) নিয়ে আলো বাতাসহীন ছোট্ট ঘরের এক কোণে শুরু হয় নতুন জীবন। কেউ ভর্তি হয় কলেজে, কেউ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোথায় সেই খেলার মাঠ, কোথায় ফেলে আসা বাড়ির উঠোন, হাত পা ছড়িয়ে বসা পালঙ্ক বা ঘর! কোথায় পুকুর ঘাট, ধানক্ষেত আর কোথায়ই বা একটুকরো আকাশ। খোলামেলা গ্রামীণ বাংলার পরিবেশে বেড়ে ওঠা আঠারো বছরের শিক্ষার্থীরা যেন এক মুহূর্তেই প্রাণভরে নিঃশ্বাসও নেয়া যায় না এমন জীবনের খাঁচায় ভর্তি হয়ে যায়। উদ্দেশ্য একটাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, পরিবারের হাল ধরা, এ জাতির মানব সম্পদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে আরেকটু উজ্জ্বল করে প্রকাশ করা।


ঢাকা শহরে মানসম্মত আবাসিক সমস্যা প্রকট। আর সেটা যদি শিক্ষার্থীদের আবাসন হয় তাহলে তা মান ও সেবার দিক থেকে আরো নিম্নস্তরের। তবে কঠিন হলেও সত্য আজো উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়াতে এবং অধিকাংশ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে আবাসন সুবিধা না থাকায় সিংহভাগ শিক্ষার্থীকে বসবাসের ক্ষেত্রে অবর্ণনীয় শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করতে হয়।


আমার মনে পরে, যখন নীলফামারী শহর থেকে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, হলে সিট পেতে প্রায় ছয় মাস অপেক্ষা করতে হলো। আমাকে ঢাকায় মেস ভাড়া দিয়ে রাখা আমার মধ্যবিত্ত পরিবারেই অনেক কঠিন ছিল। ঠিক হলো জাহাঙ্গীরনগরে বোনের কাছে থেকেই ক্লাস করবো। প্রতিদিন ভোরবেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে কলা ভবনে আসতাম, সারাদিন ক্লাস শেষ করে বিকেলের গাড়িতে বোনের কাছে চলে যেতাম। কখনো খেতাম, কখনো না খেয়েই কাটাতাম।কারণ দিনশেষে একরাশ অনিশ্চয়তা ঢাকা শহরের এই ইট আর কংক্রিটের চাপে নিজেকে টিকিয়ে অভীষ্ট পূরণে সফল হব তো! এভাবেই কেটেছে প্রথম ছয় মাস। এরপর হলে সিট পেলে জীবন যুদ্ধ অনেকটাই সহজ হয়েছে। ১৫ টাকার ভাড়ায় ঢাকা শহরে মাথা গোজার একটা নিরাপদ আশ্রয় ছিল আমাদের।


কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যেন শিক্ষার্থীদের নতুন যুদ্ধের সাথে পরিচিত হলাম। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অথচ হাজার হাজার শিক্ষার্থী মেস নামক যাঁতাকলে জীবন যাপন করছে। একদিন দুই দিন না, বছরের পর বছর, পুরো শিক্ষাজীবন। মেসের জীবনে না আছে নিশ্চয়তা, সুরক্ষা, মানসম্মত জীবন যাপনের উপকরণ, না আছে অর্থের যোগান। একজন শিক্ষার্থীর বা তার পরিবারের পক্ষে মাসিক ছয় থেকে সাত হাজার টাকা যার সিংহভাগ বাড়িভাড়ায় ব্যায় করতে হয়, এটা জোগাড় করা যে কি পরিমাণ কষ্টসাধ্য তা সহজেই অনুমেয়। আর করোনা কালীন সময়ে তা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়েছে।


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বাংলাদেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজগুলোতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। যে পরিবারগুলোতে একজন সদস্যকেও ঢাকায় রেখে পড়াতে হলে পরিবারের বাকিদের সুখ, আনন্দ বা বিলাসিতা এক ঝটকায় চাপা দিতে হয় অনেক ক্ষেত্রেই। খোদ ঢাকা শহরেই এমন হাজারো শিক্ষার্থী আছে যাদের বাবা নেই, টিউশনি করে নিজের ও পরিবারের খরচ চালিয়ে নিচ্ছে। অনেকে আছে বাবা দিনমজুর, করোনার কারণে দীর্ঘদিন যাবত কর্মহীন। অনেকেই আছে যাদের ভিটে মাটি বিক্রি করে বা বন্ধক দিয়ে লেখাপড়ার খরচ চালানো হয়। এমনো শিক্ষার্থী আছে যারা বাসার গরু ছাগল বিক্রি করে মেস ভাড়া পাঠাচ্ছে। যেন করোনা শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে এসে না সংকটে পড়তে হয়, শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কয়েকদিন আগেই এক শিক্ষার্থী এসেছিল মায়ের কানের ঝুমকো বন্ধক রেখে যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়, ঋণ শোধ করতে হবে। এগুলোর কোনটিই গল্প নয়, বাস্তবতা। এর সাথে তো রোগ, শোক, স্বজন হারানো, করোনা আতঙ্ক, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সহ নানা ধরনের মানসিক চাপ আছেই।


শিক্ষা আজ আপামর মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। সকলেই জানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আজকের যুগে শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষা এখন শুধুই উচ্চবিত্তের আভিজাত্য প্রকাশ নয় বরং নিম্নবিত্তের টিকে থাকার লড়াই,হাতিয়ারও।এই লড়াইয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসন না থাকা, উচ্চমূল্যে নিম্নমানের মেস ব্যবস্থা, সেই মূল্য যোগানে শিক্ষার্থী ও পরিবারের গলদঘর্ম হওয়া প্রকারান্তরে সুষ্ঠু শিক্ষা জীবনকেই ব্যাহত করছে।


বিশ্বমহামারি পরিস্থিতিতে সকলেই বিপর্যস্ত। এই বিপর্যয়ে শিক্ষার্থীরাও দীর্ঘদিনের মানবিক ও অর্থনৈতিক হতাশায় নিমজ্জিত রয়েছে।কবে ক্লাস-পরীক্ষায় পরিপূর্ণভাবে ফিরতে পারবে,আবার সেই তারুণ্যোজ্জ্বল জীবন ফিরে আসবে তার নিশ্চয়তা নেই,তেমনি অর্থনৈতিক বিপর্যয় তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনকেও প্রভাবিত করবে-এমন হতাশা তাদের লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলেছে।সর্বশেষ মেস/বাড়ি ভাড়া না দেয়ায় শিক্ষার্থীর সনদসহ মালপত্র ফেলে দেয়ার ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে জাতি হিসেবে আমাদের মানবিক বিপর্যয়ের নিদর্শন। গত কয়েকদিনের নিউজফিডে ঘুরেফিরে বারবার আসছে-বাড়ি ভাড়া বকেয়া থাকায় একজন বাড়িওয়ালা শিক্ষার্থীদের জিনিসপত্র ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে।সাথে ফেলে দিয়েছে শিক্ষার্থীর জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ,রাতদিন এক করে অর্জন করা সনদগুলো।যে সনদের পেছনে ছিল বাবা মা,পরিবার,শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের অক্লান্ত পরিশ্রম। আমার মনে হচ্ছে আমি এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি,মনে হচ্ছে আমার প্রিয় শিক্ষার্থীদের সমাজ টেনে ধরে অন্ধকার গহ্বরের দিকে ফেলে দিচ্ছে।ওরা হাউমাউ করে কাঁদছে,বলছে আমার সনদগুলো কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না,আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।


সত্যিই কি এমনটা প্রয়োজন ছিল!আজ না হোক কাল,কাল না হোক পরশু কি ওরা ভাড়া পরিশোধ করতো না? এই ক্রান্তিকালে আমরা কি একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারতাম না সকলের ভাল সময়ের?ওদের ঐ বাক্সপেটরা বা লেপ তোষক কি আমরা কয়েকটাদিন নিজের কাঁধে রাখতে পারতাম না? ওদের সার্টিফিকেটগুলোকে কি নিজের সন্তানের সার্টিফিকেটের মতো কয়েকটাদিন আগলে রাখতে পারতাম না?যেভাবে ওদের মা হয়তো আচল দিয়ে মুছে যত্ন করে রাখতো? আমাদের ভবিষ্যৎ কি আমাদের জন্য আজও বোঝা রয়ে গেছে,ওদের কি আমরা সম্পদ ভাববো না কোনদিনই? এতটাই কি অমানবিক আমরা? করোনা কি আমাদের আরেকবার একটু মানবিকতার শিক্ষা দিতে পারলো না?


প্রধানমন্ত্রী, এই ক্রান্তিকালে আপনাকে ছাড়া মানবিক আর কাউকে খুঁজে পাই নি আমি।সবাই এখনও নিজের চিন্তায় ব্যস্ত।আপনার কাছেই অনুরোধ করছি,এই ছেলে মেয়েগুলোর জন্য কিছুটা স্বস্তির ব্যবস্থা করে দিন।নতুন প্রাণগুলো অঙ্কুরেই যেন অমানবিকতায় ম্লান না হয়ে যায়।বাড়িওয়ালার ঘরে যদি ওদের ভাড়া ছাড়া খাবার না থাকে বলুক, আমরা চাল পৌঁছে দিচ্ছি, তবুও যেন শিক্ষার্থীদের সনদগুলো ডাস্টবিনে ফেলে না দেয়।ঢাকা শহরে ওরা সেবা ও মানের তুলনায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই থাকে সারাবছর,করোনার এই কয়েকটা মাস বাড়িওয়ালাদের একটু ন্যায্য ভাড়ার হিসাব কষতে বলুন।


সারাবছর ওদের মানবিক বিকাশে সহ শিক্ষা কার্যক্রমে অনেক অর্থ বরাদ্দ হয়,করোনাতে যার অধিকাংশই বন্ধ আছে।সেই অর্থ থেকে আবাসন সুবিধা নেই এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো তো যেতেই পারে।এক্ষেত্রে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নিতে পারে। তরুণ প্রজন্মের কাঁধের বোঝা আমরা আজ একটু লাঘব করি।আর একটু মানবিক হই,আর একটু মানবিক আচরণ করি। সন্তানসম শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষার সাথে মানসম্মত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার নীতিমালা প্রণয়নে অগ্রসর হই।প্রয়োজন শুধু একটু স্বদিচ্ছার।


রিতু কুন্ডু
সহকারী অধ্যাপক
লোক প্রশাসন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।


বিবার্তা/জহির

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com