শিরোনাম
এক বটবৃক্ষের অন্যতম স্তম্ভ মূলের জীবনের গল্প
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২০, ১৯:৩৪
এক বটবৃক্ষের অন্যতম স্তম্ভ মূলের জীবনের গল্প
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

একটি বট গাছ যেমন খুব বড় জায়গা জুড়ে জমির সমান্তরালে শাখা প্রশাখা স্তম্ভ মূলের উপর ভর দিয়ে কয়েকশো বছর বেঁচে থাকে, তেমনি হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামক বটবৃক্ষেরও চার স্তম্ভ মূল ছিলো।


বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হোটেল পূর্বানীতে সাড়ে চারটায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্যায়,অত্যাচার ও শোষণের হাত থেকে বাঙ্গালী জাতির মুক্তির লক্ষ্যে "অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন" এবং পাঁচ সদস্যের দলীয় হাইকমান্ড গঠন করেন। পাঁচ সদস্যের সেই হাইকমান্ডের চারজন তাদের জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ভালোবাসা ও ত্যাগের মহিমার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন এবং তারা হয়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় জাতীয় চার নেতা।


বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ও বিশ্বস্ত হাতিয়ার চার স্তম্ভের এক স্তম্ভ, বাংলাদেশের জাতীয় চার নেতার অন্যতম নেতা আবুল হাসানাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের জন্মদিন আজ। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জাতির জনকের নির্দেশনায় বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালনকারী জাতীয় নেতা শ্রদ্ধেয় আবুল হাসানাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী।


জাতির জনকের অন্যতম বিশ্বস্ত এ জাতীয় নেতা নাটোর জেলার অন্তর্গত বাগাতিপাড়ার তৎকালীন মালঞ্চী রেলস্টেশন সংলগ্ন নূরপুর গ্রামে মামা বাড়িতে ১৯২৬ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন। কামারুজ্জামানের স্কুল জীবন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে শুরু হলেও তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে মাধ্যমিক, ১৯৪৪ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এইচ.এস.সি এবং কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী আইন কলেজ হতে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করে রাজশাহী জজকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।


কামারুজ্জামানের রক্তে রাজনীতি,তার দাদা হাজী লাল মোহাম্মদ সরদার কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং দু'বার অবিভক্ত বাংলার লেজিসলেটিভ কাউন্সিলর সদস্য (এম.এল.সি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। কামারুজ্জামানের পিতা দীর্ঘদিন রাজশাহী অঞ্চলে মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কামারুজ্জামান ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের রাজশাহী জেলা শাখার সম্পাদক ও পরবর্তীতে ১৯৪৩-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৫১ সালে কামারুজ্জামান বগুড়া জেলার দুপ চাপিয়া উপজেলার চামরুল গ্রামের আশরাফ উদ্দিন তালুকদারের মেয়ে জাহানারাকে বিয়ে করেন। তার ছয় সন্তান, বড় সন্তান এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন বর্তমানে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র।


১৯৫৬ সালে কামারুজ্জামান তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৫৭ সালেই রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তিনি দু'বার জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা পালন করে ১৯৬৭ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বিরোধী দলীয় উপনেতা হন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবি আদায়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হতে পদত্যাগ করেন। ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবের নের্তৃত্বে আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ত্রাণ বিতরণে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের অনীহা,ডিসেম্বরের নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচিত হওয়া স্বত্তেও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করাসহ বিভিন্ন অন্যায়,অত্যাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে যখন সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে তখন কামারুজ্জামান শেখ মুজিবের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ নিরীহ বাঙ্গালী নিধনের নির্মম ইতিহাসের কালো রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে হত্যা করে হাজার হাজার নিরীহ ঘুমন্ত, অসহায় সাধারণ মানুষকে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু মূলত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর উদ্দেশ্যে বাঙ্গালী জাতির মুক্তির বার্তা দিয়েছিলেন ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই।


তারপরও তিনি গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দূরদর্শী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বেই তার মূল স্তম্ভ ও শীর্ষ নের্তৃত্বকে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার সকল দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্দেশনা মোতাবেক কামারুজ্জামান শেখ ফজলুল হক মনি,তোফায়েল আহমেদসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে বগুড়া হয়ে কলকাতা চলে যান। সেখানে বঙ্গবন্ধুর আর এক শক্তিশালী স্তম্ভ ও বিশ্বস্ত রাজনৈতিক থিংক ট্যাংক তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য নেতাকর্মীদের নিয়ে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন এবং ১৭ এপ্রিল বাংলার মাটি তথা মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায় শপথ গ্রহনের মাধ্যমে অস্থায়ী সরকারের যাত্রা শুরু করেন। অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া কামারুজ্জামান সারাদিন রাত বিভিন্ন শরণার্থী শিবির,মুক্তাঞ্চল ও সীমান্ত এলাকায় সার্বক্ষণিক স্ব-শরীরে উপস্থিত থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।


নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ও ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে লাল সবুজের পতাকা হাতে বিজয়ীর বেশে ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতাকর্মীদের সাথে দেশে ফেরত আসেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠিত সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন জাতীয় নেতা কামারুজ্জামান। ১৯৭৩ সালে রাজশাহীর দু'টি আসন সদর-গোদাগাড়ি এবং তানোর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারী কামারুজ্জামান মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নতুন মন্ত্রী সভায় শিল্পমন্ত্রী'র দায়িত্ব পান এবং বঙ্গবন্ধু কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ (বাকশাল) গঠন করলে তিনি বাকশালের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনীত হন। ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫, স্বাধীনতা বিরোধী দেশী বিদেশী কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্র ও বাংলার মীর জাফর খন্দকার মোশতাক এর প্রত্যক্ষ মদদ ও নির্দেশনায় এবং সেনাবাহিনীর তৎকালীন ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ মদদে সেনাবাহিনীর কতিপয় নরপিশাচ স্বপরিবারে বাঙ্গালী জাতির স্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে নরপিশাচরা তার শারীরিক মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারলেও তার রাজনৈতিক মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারেনি কেননা তার রাজনৈতিক চার স্তম্ভ তখনও জীবিত।


খন্দকার মোশতাক এর নির্দেশনায় কামারুজ্জামানসহ সৈয়দ নজরুল ইসলাম,তাজ উদ্দিন আহমেদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর চার জাতীয় নেতাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১৫ আগষ্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার রাজনৈতিক আদর্শের মূল স্তম্ভগুলোকে নির্মূল করার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে ভোর সাড়ে চারটায় নির্মমভাবে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। এভাবেই স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় স্বাধীনতা অর্জনের মূল নায়ক বাঙ্গালী জাতির স্রষ্টা বটবৃক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার স্তম্ভ মূলগুলোকে নির্মূল করে আবারো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে স্বাধীনতা বিরোধী কুচক্রী মহল এবং পাক হানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর, আলশামস আর রাজাকার ও তাদের প্রেতাত্মারা।


লেখকঃ মোঃ ফয়েজ উদ্দিন হাসান
সাবেক সহ-সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ


বিবার্তা/এনকে

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com