শিরোনাম
ডাক্তার মামুনের দিনলিপি
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২০, ১৯:৫৩
ডাক্তার মামুনের দিনলিপি
ক্যামেলিয়া আফরোজ ও শান্তা তাওহিদা
প্রিন্ট অ-অ+

১. ডা. মামুনের এক হাতে একটি বাদামী খাম, অন্য হাতে খামের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা চিঠি। অফিসিয়াল চিঠি। একদৃষ্টে তিনি তাকিয়ে আছেন চিঠির লেখাগুলোর দিকে। তড়িতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল প্রেয়সীর দারুণ প্রেমময়ী মুখ ও সাথে দু'টি গোলগাল কচিমুখও।


একদিকে পরিবার, অন্যদিকে দায়িত্ব কর্তব্যের ভার। সৎ, ধর্মভীরু, মানব সেবায় নিবেদিত একটি নাম ডা. মামুন। আগামীকাল থেকেই তার ডিউটি পড়েছে ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে, কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য। খামে চিঠিটা ভরে তিনি কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে গেলেন।


বাসায় ফিরতেই তার দুই বছরের ছোট্ট ছেলে ওয়াফি তার কোলে ঝাঁপ দিয়ে ওঠে পড়ল। সবাই বলে, পুত্রসন্তানেরা নাকি মায়েদের ভক্ত হয়। কিন্তু ডা. মামুনের বেলায় এ বিষয়টি ঠিক উল্টো। তার দুই পুত্রই বেশ বাবাভক্ত। বাবাকে কাছে পেলেই যেন তাদের রাজ্যের সমস্ত চাওয়া পূর্ণ হয়ে যায়। যতক্ষণ তিনি বাসায় থাকেন, এই দুটি বেহেশতের পুষ্পকে ঘিরেই তার সময় কেটে যায়। বাবার সাথেই খেলা করা, গল্প করা, খাওয়া, এই করে করেই সময় পার করে দেয়া। এ বিষয়টা তিনিও বেশ উপভোগ করেন। সপ্তাহের যে কয়েকটি ঘণ্টাই সময় পান পরিবারের সাথে কাটানোর জন্য, সেসব তিনি এভাবেই কাটান।


স্বামীকে অসময়ে বাসায় ফিরতে দেখে তার স্ত্রী মুন্নী বেশ অবাকই হলেন। রাতে ছেলেরা ঘুমিয়ে গেলে মুন্নী জানতে চাইল, ‘আজ অসময়ে বাসায় চলে এলে যে? কিছু হয়েছে নাকি?’ ডা. মামুন জবাব দিলেন, ‘কাল থেকে কুর্মিটোলা হসপিটালে আমার ডিউটি।’


একজন ডা. এর স্ত্রী হিসেবে মুন্নীকে আর কোনো কিছুই বিস্তারিত বলতে হলো না। যা বোঝার, সে তা বুঝে নিল। আর বুঝে নিল বলেই স্বামীর মুখের দিকে সে তাকাতে পারছিল না। বুকে এক অনিশ্চিত আশঙ্কামাখা হাহাকার যেন আগুনের হলকার মত ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল।


২. পরদিন সকালে ডা. মামুন কুর্মিটোলা হসপিটালে যোগ দিলেন। প্রতিদিন অসংখ্য করোনা আক্রান্ত রোগী হসপিটালে আসছেই। কেউ সেবা পাচ্ছে তো কেউ পাচ্ছে না। অনেককেই ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলো ডাক্তারেরা। জনবল কম থাকায় অনেক সময় অনেক রোগী ঠিকঠাক সেবাও পাচ্ছিলেন না। পরিস্থিতি অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একদিন এক রোগী নিজের বেড ছেড়ে পুরো হসপিটালজুড়ে চিৎকার করতে করতে অনেক বাজে কথা বলে গিয়েছে। চোখের সামনে অনেকগুলো মৃত্যুও দেখলেন ডা. মামুন। মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলেও নিজেকে শক্ত রেখেছেন। তবে যখনই কারো মৃত্যু দেখতেন, তখন কেন যেন অজানা আশঙ্কায় পুরো পরিবারের মুখটাই ভেসে আসত চোখের সামনে। তবু নিজেকে সামলাতেন।


নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, ৭ দিনের ডিউটি শেষে যেন তিনি ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকেন। ডা. মামুন আইসোলেশনের ১৪টি দিন বাড়ির বাইরে থাকার চেয়ে বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরিবার থেকে দূরে থাকার চেয়ে পরিবারেই থাকতে পারবেন, সেটাই সান্ত্বনা। নাইবা হলো ধরাছোঁয়া।


ডিউটি শেষে নির্ধারিত সময়ের আইসোলেশনে যেতে হবে। বাসায় সেভাবেই ব্যবস্থা করে রাখা আছে। সব গুছিয়ে রেখেছে মুন্নী। বাসায় প্রবেশের আগে তিনি মুন্নীকে ফোনকল দিলেন। মুন্নী দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেল অন্য রুমের বারান্দায়। এই ফাঁকেই ডা. মামুন তার জন্য নির্ধারিত রুমে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দরজা লক করে দিলেন।


এই ১৪টি দিন যে কী পরিমাণ গাঢ় অসহ্যকর হয়ে ওঠছিল, তা মামুন সাহেব অনুভব করতে পারছিলেন। তিনি ও মুন্নী, দু'জন মিলে তাদের ৮ বছরের ছেলে ওয়াসিকে আইসোলেশনের ব্যাপারটি কিছুটা বুঝাতে পারলেও ছোট্ট ওয়াফিকে কিছুতেই কিছু বুঝানো সম্ভব হয়নি। মামুন সাহেব ছোট্ট ওয়াফির কান্না শুনতে পান, কিন্তু দরজা খুলে বাইরে গিয়ে তার কান্না থামাতে পারেন না। ওরা বাবার সাথে খেলতে চায়, গল্প করতে চায়। "বাবা, বাবা" বলে ডেকে ডেকে দরজার পাশেই ঘুমিয়ে যায় কাঁদতে কাঁদতে। কিন্তু তারা কি জানে, তাদের ডাক্তার বাবা বেশ নিরুপায়?


মায়ের স্মার্টফোনে ভিডিও কল দিয়ে বাবাকে পাশের রুমে দেখে দরজায় অনবরত আঘাত করতেই থাকে দু'ভাই মিলে। তাদের বাবার কাছে সেই আকুলতামাখা "বাবা, বাবা" ডাক আর দরজার শব্দ অসহায় আর্তনাদের মত শোনায়! তিনি কানে আঙুল গুঁজে দেন। তবু চোখকে তো আর বন্ধ রাখা যায় না। দু'টো চোখ ভিজে যায় বারবার।


৩. সেদিন ওয়াফি মেঝেতে পিছলে পড়ে মাথায় আঘাত পায়, কিন্তু বাবা ছেলের কাছে ছুটে যেতে পারেন না। ছেলেরা দরজায় উঁকি দিয়ে বারবার বাবাকে ডাকতেই থাকে। ডা. মামুন মনে মনে ভাবেন, 'আইসোলেশন মেনে চলা এত কঠিন কেন! "উনি নিজেও হয়ত এতকিছু মানতেন না। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন, তার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। শরীরে জ্বর জ্বর ভাব, সাথে হালকা কাশি, চোখ দু'টোও কেমন নিদ্রাহীনের মত বেশ লাল হয়ে আছে।


ডিউটির শেষ দিনেই দু'জন রোগী মারা গিয়েছিলো, তাদের ডেথ সার্টিফিকেট দিতে হয়েছে তাকেই। তাই তিনি নিজেও কোভিড-১৯ পজিটিভ কি না, এমন আশঙ্কাটুকু একেবারেই উড়িয়ে দিতে পারছেন না।


রমজান মাস চলছে। প্রতিদিন মুন্নীই ঘুম থেকে জেগে মামুন সাহেবের রুমে সেহেরি দিয়ে যায়। আজ মুন্নী ফোনকল দিয়ে বলল, "ওয়াফি জেগে আছে। আমি উঠলেই সে আমার সাথে চলে আসবে।। তুমি টেবিল থেকে খাবার টা বেড়ে নিয়ে রুমে ফিরে যাও, তারপর আমি উঠছি।"


ডা. মামুন খুব সন্তর্পণে দরজা খুলে ডাইনিং রুমে এসে প্লেটে খাবার তুলছেন। ওদিকে মুন্নী মোবাইল রেখেই দুশ্চিন্তাময় চোখ দু'টো আধবোজা করে শুয়েছিল। বেডরুম থেকে ডাইনিং রুম পুরোই দেখা যায়। ওয়াফি দেখল, তার বাবা ডাইনিং রুমে। সে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে এক দৌড়ে বাবার কাছে ছুটে গেল এবং ডা. মামুন কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলেন, তার ছোট পুত্রকে তিনি মনের অবচেতনেই কোলে তুলে নিয়েছেন।


আহ, ভেঙে গেল এত কঠিন প্রতীজ্ঞার আইসোলেশনের দেয়াল। জিতে গেল, পিতৃত্ব আর স্নেহের বন্ধন। মৃত্যুর মত এটাও জীবনের এক অমোঘ সত্য। এই যে পুত্রকে ছুঁয়ে দিল সে, এখন তো পুত্রও আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে! কেন এমন হলো? কেন এমন দীর্ঘ প্রতীজ্ঞা এই এক পলকের দুর্বলতায় খানখান করে ভেঙে গেল। ডা. মামুন ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তার গলার এমন ভেজা কণ্ঠে ওয়াফি ভড়কে গেল। বাবাকে তো সে কখনও কাঁদতে দেখেনি! ওদিকে তন্দ্রাবিষ্ট মুন্নীর ঘোর ভাঙল স্বামীর ক্রন্দনের শব্দে। সাথেসাথেই সে লক্ষ করল, তার পাশে ওয়াফি নেই!


৪. অবশেষে আশঙ্কাটা সত্যে পরিণত হলো। মনে মনে তিনি হয়ত জানতেন একদিন আজকের দিনের মত একদিন আসবে। কারণ আইসিউতে শেষ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যে মানুষগুলো আসে তাদের নির্লিপ্ত চোখের চাহনিকে ডাক্তার হিসেবে তিনি যে আগ্রায্য করতে পারেন না। নিমেষেই স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বোন, পরিজনের চেহারা ঝাপসা হয়ে যায়। তখন বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে আসা মানুষগুলোর সংগ্রামকে নিজের সংগ্রাম লাগে। একসাথে সেই সংগ্রামে কখনো জেতেন, কখনো হারেন। কিন্তু আজই প্রথম একা পরাজিত সৈনিক মনে হচ্ছে নিজেকে।


আজ শরীরের জ্বরটা আগের থেকে বেড়েছে। মুখ বিস্বাদ। দুদিন ধরেই এমন লাগছিল দেখে গতকাল নিজেই একা একা টেস্ট করার জন্য হাসপাতালে স্যাম্পল দিয়ে এসেছিলেন। সে খবর আজ এল। এবার তিনি আর নিজের মনকে ডা. মামুনুর রশীদ হিসেবে বোঝাতে পারলেন না। সন্তানের পিতা হিসেবে বুকের ভেতরটা হাহাকার করতে লাগল। দুদিন আগেই তো ছোট ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এখন কী হবে?


লেখক: শিক্ষক ও লেখক


বিবার্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com