শিরোনাম
আমজনতার বাজেট পর্যালোচনা
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২০, ২১:৫৫
আমজনতার বাজেট পর্যালোচনা
রিপন আশরাফ
প্রিন্ট অ-অ+

বৃহস্পতিবার (১১ জুন) জাতীয় সংসদে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শিরোনামে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই বাজেট করোনায় স্থবির হওয়া অর্থনীতিকে সচল রাখার বাজেট। গতানুগতিক অনেক নিয়মের বাইরে গিয়ে সরকারকে এই বাজেট তৈরি করতে হয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মত ঘাটতির গোল্ডেন রুল ৫ শতাংশের নিয়ম ভেঙে ঘাটতি ৬ শতাংশ বাধ্য হয়ে ঘোষণা দিতে হয়েছে।


বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫.৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট এডিপি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা, রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা, ব্যাংক ঋণ ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা- যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে এ ঘাটতি মেটানো হবে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি অন্যান্য উৎস থেকে ৪৮ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। বাজেটের প্রায় ৩ ভাগের এক ভাগই ঋণ নির্ভর। এই ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই সরকারের নাভিশ্বাস উঠে যাবে।


আবার এই দুঃসময়ে দরিদ্র মানুষের জীবন ও জীবিকার সমাধান আগামী বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত বিবেচনায় সামাজিক সেফ্টিনেটে সরকারের বরাদ্দ মাত্র ৩১ হাজার পাঁচশত কোটি টাকা। করোনা ভাইরাসের মহামারী তো শুধু আগামী ৫ মাস এটা কেউ বলতে পারেনা । এটা কেবল শুরু। যা দীর্ঘায়ীত হবে বাংলাদেশে। এই বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে একই কারণে বাজেট রিভিউ করে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আয় দারিদ্র বৃদ্ধির রাশ টেনে ধরতে হবে যতটা সম্ভব বিচক্ষণ পদক্ষেপে।


এ বাজেটের মাধ্যমে সরকারের ব্যাংক নির্ভরতা আরও বৃদ্ধি পাবে। কারণ সরকার বলেনি প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার বিপুল অভ্যন্তরীণ ঋণ বাণিজ্যিক ব্যাংক না বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া হবে। মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকেই সরকারের ভরসা। দীর্ঘ মেয়াদে এই ব্যংক ঋণ নিলে যা সংকট উত্তরণ না ঘটিয়ে সংকট বাড়াবে।


এর কারণ চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে সরকার ব্যাংক থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে সরকার ১৯টি প্যাকেজে এক লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন- যা সরবরাহের দায়িত্ব মূলত ব্যাংকগুলোর। ব্যাংকের ওপর এমনিতেই তারল্য সংকট রয়েছে; এ প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে ও দেশের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তারা বেশি বিপদে পড়বেন। সরকার নিজেই ব্যংকে ঋণের জন্য ধর্না দিলে দেশের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তারা ঋণ পাবার দৌড়ে অনেক পেছনে পড়ে যাবে। এতে করে উৎপাদনের ও আয়ের চাকা মসৃণ ভাবে চলবে না এটা অনুমান করে বলার চাইতে বাস্তবতার নিরিখেই বেশি উপলব্ধি হচ্ছে। উদ্যোক্তারা এই বাধায় পড়লে ( ইতিমধ্যে প্রণোদনার টাকার বাস্তবায়ন ব্যংক করতে পাড়েনি) তাদের ব্যবসা স্থবির হলে এই খাট সংশ্লিষ্ট প্রাইভেট সেক্টরের অনেক মানুষের জীবিকা নিয়ে টানাটানি তৈরির বিশাল আশংকা থাকে যৌক্তিক ভাবেই। এই ঘটনার প্রভাব স্থানীয় ও জাতীয় বাজার নির্ভর অর্থনীতিকে পক্ষাঘাতে ফেলে দিবে।


কিছু কার্যকর পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করলে বাজেটের বাস্তবায়ন সংকট খানিকটা প্রশমিত হয়।


১) বাণিজ্যিক ব্যংকের বদলে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে প্রস্তাবিত ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করা। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রাইভেট সেক্টরের দিকে যত্নবান হতে পাড়বে।
২) অর্থ সংস্থান ও তারল্য বাধা কাটাতে সরকার প্রবাসী ধনী ব্যক্তিদের নিকট থেকে তাদের জন্য স্পেশাল বন্ড কিংবা ওয়েজ অনার্স বন্ড কিনার ব্যবস্থা করা।


৩) সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দের সুফল পাওয়া যায়না সরকারি অদক্ষতা জনিত দুর্বল বাস্তবায়নে। সাইকো সোশ্যাল ট্রমার কবলে পড়া ভিক্টিমদের বিরাট অংশ এই বরাদ্দ অর্থ পায়না। এর সুফল পেতে প্রাইভেট পা্র্টনারশীপ মডেলে এনজিওদের সাথে কাজ করলে অপেক্ষাকৃৎ বেশি দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সাথে এই সমস্যা কাটানোর ব্যবস্থা করা। এই জায়গাটিই বড় মনোযোগে দেখতে হবে। কারণ চরম দারিদ্র লাফিয়ে ১০.৫% হতে ২২% এর ঘরে পৌঁছে যেতে কয়েকমাস মাত্র সময় নিবে। যার পূর্বাভাস বিশ্বব্যাংক দিয়েছে।


৫) স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বরাদ্দ যেটা হয়েছে তার বাস্তবায়ন সঠিক করতে হলে ব্যয় দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নিতি বহাল করা। কারণ ২ হাজার টাকার পিপিই ৪৭০০ টাকায় কেনা হয় আর ডাক্তারদের ৫০০ টাকার চশমা ৫ হাজার টাকায় কেনা হয় তাহলে স্বাস্থ্যখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়েও এদেশের মানুষের চিকিৎসা সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। সরকার এই দুর্নীতির লাগাম টেনে সুফল পেতে এনএসআইকে কাজে লাগালে সফলতার পরিমাণ বাড়বে।


৬) অভ্যন্তরীণ অর্থ সংস্থানের অন্যতম উৎস সঞ্চয়পত্রের চার্জ বৃদ্ধি ও ক্রয় সীমার অংক আরো বৃদ্ধি করার উপায় বিবেচনায় নিলে বাজেটের ঘাটতি আহরণ কিছুটা সহজ হবে।


৭) আমদানি এলসির বিপরীতে আমদানি-রফতানি নির্ভর অসাধু শিল্প মালিকদের দ্বারা বিশেষ কৌশলে অর্থ পাচার রোধ করতে জিরো টলারেন্স নিতে হবে। টাকা পাচারকারীদের দ্বারা জনগণের করের ৩৮% টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে যা এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। এটা রোধ না করতে পারলে রাজস্ব অর্জনের লক্ষ অধরাই থেকে যাবে।


সব শেষে এডিপির ২ লাখ ৫ হাজার টাকার স্বচ্ছ বাস্তবায়ন করতে হলে ব্যয় দুর্নীতির ব্যাপকতা রোধের বিকল্প নেই। দুর্নীতির ব্যাপকতায় এডিপির সুফল কাংখিত হয় না। দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে করোনার চরম অশনি সংকেতের মোকাবেলায় ভবিষ্যতে উদ্বৃত্ত অর্থ ধাপে ধাপে চরম দারিদ্র হওয়া মানুষদের খাদ্য নিরপত্তা সহায়তায় কাজে লাগবে আশা করা যায়।


লেখক: রাজনৈতিক-অর্থনীতির গবেষক।


বিবার্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com