শিরোনাম
নিউ নর্মাল: ভিন্ন এক পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ (পর্ব-১)
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২০, ১৭:১৬
নিউ নর্মাল: ভিন্ন এক পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ (পর্ব-১)
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথাবার্তা, আচার-আচরণ শুরু থেকেই অগোছালো। অনেকটা মনের ওপর জোড়জবরদোস্তি মনে হয়েছে। সিরিয়াস সব ইস্যুতে তারা একের পর এক হাইপোথিটিক্যাল কথা বার্তা বলে চলেছে। শুরুতে বলেছে মানুষ থেকে মানুষে করোনাভাইরাস ছড়ায় না। এটা শুনে তো ট্রাম্প সদর দরজা খুলেই রেখেছিলেন। ফলে যা হবার তাতো বিশ্ববাসী নিজের চোখেই পরখ করলেন।


পরিস্থিতির ভয়াবহতায় কয়েক দিন যেতে না যেতেই তারা মত পাল্টে ফেলেন। কয় দিন পরে আবার বললেন, ঘরে থাকলে করোনা আপনাকে ছুঁতে পারবে না। দীর্ঘ ৭০ দিন ঘরে থাকার পর এখন বলছে করোনা কোনোদিনই যাবেনা। এর সাথে মানিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আরো একটি বড় ফ্ল্যাকচুয়েটিং তথ্য হলো গত ২৫শে মে সংস্থাটি করোনায় আক্রান্ত রোগীকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সেবনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সেটি ব্যবহার না করতে সতর্ক করেছিলেন সব রাষ্ট্রকে। এখন তারা বলছে, ওষুধটির পরীক্ষামূলক ব্যবহার বন্ধ করার কোনো কারণ নেই।


মোদ্দা কথা, উনারা যেন করোনার সাথে আমাদের জোড় করে মানিয়ে নিতে বাধ্য করছেন। এখন অবশ্য সে প্রচেষ্টাই চলছে। মানুষ এখন এই অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে একসাথে বসবাসের নিমিত্তে বাধ্য হয়েই বিভিন্ন কলা-কৌশল আয়ত্ত করছে। মনের ওপর জোড় চলে না। করোনা তা বোঝে না। তাই মানবদেহে প্রবেশ-নিষেধের কলাকৌশল রপ্ত করার পাশাপাশি একে শরীরের ভিতরে আটকে মারার সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে সর্বত্র। এর সাথে বসবাসের ইচ্ছে কারো নেই। তাই মানবদেহের ইমিউনিটি ভার্সেস করোনা যুদ্ধ চলবে আরো বেশ কিছুদিন। ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত করোনা হয়তো তার এ আগ্রাসী অভিযান অব্যাহত রাখবে এবং দুর্বলকে কুপোকাত করে ছাড়বে এটা মোটামুটি নিশ্চিত।


মনে পড়ে গেলো প্রথম আলোর শ্লোগান ‘বদলে যাও, বদলে দাও’ এর কথা। আফসোস! ৫০ বছরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বদলাতে পারিনি কিছু। তাই এখন এই করোনার সাথে যুদ্ধে নিজের বদলে যাওয়া ছাড়া আর কি-ইবা করার আছে? মান্নাদের সেই বিখ্যাত গান “মেনেছি গো হার মেনেছি, তব পরাজয় মোর পরাজয়...বারে বারে তাই জেনেছি”। অন্ততঃপক্ষে বেঁচেতো থাকতে হবে। ভাবছি, এই বদলে যাওয়াটাও কি এত সহজ হবে? দীর্ঘদিনের অভ্যেস, প্রথা, বিশ্বাস, রীতিনীতি মনের মধ্যে যে কঠিন দাগ কষে রেখেছে তা কি এত সহজে মাত্র ৯০ দিনের মাথায় মুছে ফেলে ‘নিউ নরমাল’টাকে মেনে নেয়া যাবে? কিন্ত এটাই এখন বাস্তবতা।


আমরা আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে এ পরিবর্তন সইবো কি করে? ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার প্রাক্কালে বাথ রুমেই প্রথম ধাক্কাটা খেতে হবে। পুরুষলোক। দাঁড়ি-গোঁফ সেভ না করলে কি চলে? করোনাকালীন এবং করোনা পরবর্তী সময়ে আনমনে প্রশ্ন জাগবে, কে দেখবে মুখখানি মোর? থাকবে তো সাটার টানা। ব্যাস, এখান থেকেই শুরু মন খারাপের। যেখানে প্রতিদিন আপনি এ কর্ম সাধণ করতেন, সেখানে এখন আর ইচ্ছেই করছে না। এর যতই পজিটিভ ইকোনোমিক ও হাইজিনিক দিক থাকুক। মন তা মানবে না। কি করে মানবে? ইস! কত্ত্ব দামী সেভিং কিটস আপনার! সেভ শেষে গোসল সেড়ে যখন আপনি আমেরিকান ব্রান্ডের আফটার-সেভটা স্প্রে করে অফিসে যেতেন, তখনতো আশেপাশের সকলের ঘ্রাণেন্দ্রিয় ত্রাহি-ত্রাহি করতো। এখন কই সব?


অফিসে যেতে এখন আর আপনাকে বাহারী কাপড়-চোপড় খুঁজতে হবে না। পরিধেয় যেমন তেমন হলেও সদা মনে রাখতে হবে ‘এসএমএস’ এর কথা। অর্থাৎ সঙ্গে নাও ‘হ্যান্ডস্যানিটাইজার’, সাবধানে পড়ো ‘মাস্ক’ ও মেনে চলতে হবে ‘সোশ্যাল ডিস্টেন্স’। এখানেই শেষ নয়। মাথায় পড়ো ক্যাপ, চোখে লাগাও চশমা নয়তো সান-গ্লাস। হ্যান্ডগ্লোভস রাখো না রাখো পকেটে কিন্ত আলগা টিস্যু-পেপার নিতেই হবে যেন লিফটের বাটনে আবার সরাসরি আংগুল না লাগে। মনে মনে দোয়া পড়ে গাড়ীতে উঠেই আরো সন্দেহ ঘণীভূত হলো ড্রাইভার ঠিক আছে তো? সেকি বোঝে সোসাল ডিস্টেন্সের সংজ্ঞা?কোথায় ছিল সারারাত সে? সে ঠিকঠাক থাকলেও তার স্ত্রী সারাদিন-রাত কোনো এক হসপিটালের করোনা ইউনিটে নার্স-এর দ্বায়িত্ব পালন শেষে বাসায় এসে কি ভোগান্তি তৈরী করেছে কে জানে? সেখান থেকে আবার ড্রাইভার কোনো ঝামেলা বয়ে নিয়ে এলো নাতো? কত-কথা জাগে মনে।


একই কথা কি ওর মনেও? পুরোটাই অবিশ্বাস আর সন্দেহ। এতো গেলো প্রাইভেট কারের কর্তা ব্যক্তিদের কথা। আর যারা অফিসে যেতে মাইক্রোবাস বা বড় বাস ব্যবহার করবেন তাদের ঝুঁকি নিঃসন্দেহে আরো কয়েকধাপ বেশী। এ যে কি এক অস্বস্তিকর অবস্থা তা ব্যাখ্যা করার নয়। অফিসে ঢুকে পড়তে হবে আরো বিপাকে। আপনি পৌছানোর আগেই সবকিছু পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে কিনা কে জানে? ক্লিনার ফ্লোরে কি করে গেলো কোনো ভরসা নেই। অফিস সহায়কের হাতে চা-নাস্তা বানিয়ে খাওয়ার কথা বেমালুম ভূলে যেতে হবে আপনাকে। সন্দেহ-সংশয় দূর করতেই নিজের চা-নাস্তা নিজে তৈরীর ব্যবস্থা করতে হবে। পাশ্চাত্য অনেক আগেই এ চর্চা শুরু করেছিল। প্রাচ্যেও এখন এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। ভুলে যেতে হবে কে কবে কব্জি ডুবিয়ে আপনাকে আদর করে খাইয়েছিল তার ইতিহাস। সবই ঠিক থাকবে শুধু আপনাকে এখন থেকে একটু তৈরী করে খেতে হবে।


আপনার কক্ষে যেই ঢুকুক মাথায় থাকবে সোশ্যাল ডিস্টেন্সের কথা। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে স্বাক্ষর করার কথা মাথায় না রাখলেও সোশ্যাল ডিস্টেন্স মানা হচ্ছে কিনা তা মনে রাখতেই হবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ভুলে গেলেও ভুলে যাওয়া চলবে না অফিস শেষে জুতো ঘরের বাইরে রাখার কথা। আর বাইরে থেকে এসে কোনো কিছু স্পর্শ করার আগে সাবান দিয়ে অন্ততঃ ২০ সেকেন্ড হাত ধোঁয়ার অভ্যেসতো এরই মধ্যে আমাদের হয়েই গেছে। এটা চালিইয়ে যেতে হবে অনন্তকাল। এসব কাজে সদা সতর্ক থাকতে আপনার এটেনশন এবং প্রিপারেশন বাবদ যে মেধা, শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় হবে তাকে যদি জাতীয় ইকোনোমিতে কনভার্ট করা যায় তাহলে এদেশের টোটাল অফিসগামী মানুষের মাসে মোট ব্যয়িত অর্থ দিয়ে তিন বছরে অন্তত একটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব বলে আমি মনে করি।


এবার এক নজরে দেখার চেষ্টা করি করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের কি কি অভ্যাস, চর্চা, বিশ্বাস, প্রথা, রীতিনীতি বদলে দিতে পারেঃ ক্রিকেটে থুথু মেখে বল করা, সোশ্যাল ডিস্টেন্স মেইটেইন না করে সিনেমা-নাটকের শুটিং এর সময় ক্লোজ-শর্টে কাজ করা, শুটিংকালীন এর-ওর হাতে ভাজা পোড়া খাওয়া, কাজের লোকের ওপর নির্ভর করা, যখন তখন হ্যান্ডসেক করা, অহেতুক জড়িয়ে ধরা, প্রেমিক প্রেমিকার হুটহাট চুমো খাওয়া, মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া, পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটির দিনে বাইরে ডিনার করা, যথা-তথা রেস্টুরেন্টে বসে এটা-ওটা খাওয়া, নাইট ক্লাব, বার ইত্যাদিতে বসে একসাথে গায়ে-গায়ে লেগে আড্ডা দেয়া, যত্রতত্র ক্লোজ-শর্টে সেলফি তোলা, অহেতুক লং-ড্রাইভে গিয়ে বড়-রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া, হাত না ধুয়ে খেতে বসা, শপিং মলের কেনাকাটায় কাপড়-চোপড় বা পন্য সামগ্রী হাতিয়ে বেড়ানো, ডিসপ্লেতে রাখা নতুন পোষাকের ট্র্যায়েল কালচার, বাসে, লেগুনায়, টেম্পোতে, লঞ্চে, প্লেনে এমন কি প্রাইভেট কারে গাদাগাদি করে বসা, মন খারাপের দিন ভার্সিটির হল থেকে বেরিয়ে গাউছিয়া, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, চন্দ্রিমায় অহেতুক ঘুরে একটু গা গরমের বাহানা করা, নিউমার্কেট এর চিপায় রুবেল আর সাজাহানের দারুন যত্ন করে খালি হাতে বানানো সস্তার ঝাল-চানাচুর-মুড়ি খাইয়ে ২০ টাকায় বন্ধুত্ব রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করা, টিএসসিতে ছোলা, বুট আর বউ-জামাই চানাচুরের স্বাদ, সহসা জিভে জল আনা পানিপুরী আর বেলপুরীর টক-ঝাল নেশা, আয়োজন করে হাকিম চত্বরে তোমায় নিয়ে এক কাপ আয়েশী চা খাওয়া, আর সংগে একটা সিগারেটতো থাকছেই। না হলে কি করে হবে বিশ্বটা আমার?


বদলে যাবে কবিতা উৎসব, বইমেলা, বদলে যাবে রি-ইউনিয়ন উদযাপন। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার দিন শেষ। প্রকৃতি নারাজ। তাই, সৌভাগ্য হারিয়েছি মুক্ত বায়ু শোষণের। হজম করতে হবে নিজের ছেড়ে দেওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিজেরই। শরীরকে বঞ্চিত করতে হবে শতভাগ ফ্রেস অক্সিজেন প্রাপ্তি থেকে। মাস্ক পড়ে করতে হবে সবকিছু। বদলে গেছে লাশ দাফন প্রক্রিয়া। বুকে পাথর বেঁধে দূরে দাঁড়িয়ে সহ্য করতে হবে মা-বাবা সন্তানের শেষকৃত্য।


এখন আর মানুষের মৃত্যু আমায় কাঁদায় না। সেই কবে করোনা পূর্বসময়ে কোনো এক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে মোবাইলে লিখে রেখেছিলাম “ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইনাইলাহি রাজেউন” বাক্যটি। কিন্ত এর প্রয়োগ যে এত ব্যাপক হবে তা কল্পনাও করিনি। করোনাকালীন প্রতিদিন বাতাসে ভেসে আসছে একটির পর একটি দুঃসংবাদ। তাই কষ্ট করে এখন আর কোনো সমবেদনার কথা লিখিনা। শুধু কপি-পেষ্ট করে ঐ বাক্যটি যথাস্থানে বসিয়ে দিয়েই ড্রপ-ডাউন করে প্রসঙ্গ পাল্টাই।


আমি না হয় প্রসঙ্গ পাল্টে নিজেকে আড়াল করে আপাততঃ মন ভালো রাখার মিথ্যে সান্ত্বনা খুঁজি। কিন্ত যিনি চলে গেছেন তিনিতো শুধু একক একটি সংখ্যা ছিলেন না। ছিলেন অনেক সংখ্যক মানুষের নির্ভরতার প্রতীক। যার চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের স্বপ্নের কবর রচিত হলো। আর সংখ্যা! সেটাতো সরকারের আদমশুমারীর হিসেব। সেই হিসেবের খাতায় আপনার আমার জীবিনের কি-বা মূল্য আছে? শুধু মনে রাখতে হবে, করোনাকালীন গত তিন মাসে আমরা ঠ্যাকায় পড়ে যা শিখেছি সেগুলোকেই এখন কাজে লাগাতে হবে। এসব শিক্ষাকে আপদকালীন লার্নিং না ভেবে দীর্ঘকালীন অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। কেবল তাহলেই আমরা বৈশ্বিক ‘নিউ নরমালে’ নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হবো। নইলে সবকিছু ভেঙে পড়বে।


লেখক: প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিতুল, ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/আবদাল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com