পাকিস্তানি শাসকদের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈমাত্রেয় সুলভ আচরণে এক সময় আওয়ামী লীগ সহ বাঙালির নানা সংগঠন স্বাধীকারের প্রশ্ন উত্থাপন করে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বাঙালির সীমাহীন বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায্য অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার সুনিশ্চিত দলিল হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৬ সালের ৬ দফা।
৪ ফেব্রুয়ারি ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী নিয়ে লাহোরে পৌঁছান। তখন তিনি ছিলেন দলের সেক্রেটারি আর সভাপতি ছিলেন আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। তাসখন্দ চুক্তির ভিত্তিতে ৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলগুলোর ঐতিহাসিক সম্মেলনে অংশ নেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লা খানের নেতৃত্বে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী দল নিয়ে জাতীয় এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
পরের দিনের আলোচ্যসূচিতে স্থান পাওয়ার জন্য সাবজেক্ট কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা পেশ করেন আয়োজক পক্ষ গুত্ত্বারোপ না করে বরং বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে পত্রিকায় রিপোর্ট করা হয়। এর প্রতিবাদে ৬ ফেব্রুয়ারি সম্মেলন বর্জন করে বঙ্গবন্ধু লাহোরে অবস্থানকালেই অনানুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উত্থাপন করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে সাংবাদিকদের ৬ দফার ব্যাখ্যা দেন বঙ্গবন্ধু। ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে ৬ দফা উত্থাপন করা হয় এবং ১৩ মার্চ আর একটা মিটিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা পাস করা হয়। এরই মাঝে ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬ দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক পুস্কিকা প্রকাশ করা হয়। লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে ২৩ মার্চ লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা পেশ করেন বঙ্গবন্ধু। প্রণয়নের পর আতাউর রহমান খান সহ তৎকালীন পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী নেতার কাছে সমর্থন আদায়ের জন্য যান বঙ্গবন্ধু। কারো সায় না পেয়ে আর আইয়ুব খানের "অস্ত্রের মুখে ছয় দফার জবাব হবে" হুমকিতে বঙ্গবন্ধু নিজেই পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে ছয় দফা নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৬ দফা জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, জহুর আহমদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট সহ প্রায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণ করেন বঙ্গবন্ধু।
৮ মে নারায়ণগঞ্জে পাট কারখানা শ্রমিমকদের র্যালিতে অংশ নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্যের অভিযোগে ও প্রতিরক্ষা আইনে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ১৩ মে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পল্টন ময়দানের জনসভায় ৭ জুন হরতাল ও মাসব্যাপী কর্মসূচির ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। সামরিক জান্তার ১৪৪ ধারা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ ও গুলি উপেক্ষা করে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মজুর আম জনতা ৬ দফার দাবিতে কর্মসূচিতে অংশ নেয়।
৭ জুন তেজগাঁওয়ের বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক সিলেটের মনু মিয়া স্বৈরশাসকের গুলিতে প্রাণ হারানোর প্রেক্ষিতে প্রচণ্ড বিক্ষোভে টঙ্গী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এ পুলিশ ও ইপিআর এর গুলিতে শফিক, শামসুল হক সহ ১১ বাঙালি শহীদ হন। পুলিশ প্রায় ৮০০ লোক গ্রেফতার ও অগনিত মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ৬৭'র এপ্রিলে হাজতবাসী বঙ্গবন্ধু কে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। অবশেষে সব কারাবন্দীর মুক্তির পর প্রায় তিন বছর অন্যায় কারাভোগ শেষে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হয়। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনকে মূলে রেখে ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ৬ দফার প্রস্তাবনাসমূহঃ
১। শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি
দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারী ধরনের। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। এবং এই পরিষদ ও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।
২। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবল দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরংকুশ।
৩। মুদ্রা বা অর্থ সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দুটির যে কোনো একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ-
ক) সমগ্র দেশের জন্যে দুটি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্য কেবলমাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থ বিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
৪। রাজস্ব, কর বা মুদ্রা সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনোরুপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটা অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
৫। বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা
ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধিন থাকবে।
গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমানহারে অথবা সর্বসম্মতহারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোনোরকম বাধা-নিষেধ থাকবে না।
ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
৬। আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
লেখক: কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা, সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বিবার্তা/জাহিদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]