শিরোনাম
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দেবদাস, আমাদের হিরো
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২০, ১৭:০৭
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দেবদাস, আমাদের হিরো
আরিফুজ্জামান রাজীব
প্রিন্ট অ-অ+

“কর্তৃপক্ষকে জানাতে চাই, আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় এখন সামরিক আস্তানার এক নৃশংস ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।” এই ছিলো সেই হার-না-মানা, রক্ত চক্ষু আর নির্মম বুটের বিপরীতে লেখা আপোসহীন পত্রের শুরুটা। প্রথম লাইনটি দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের প্রলয়-ছবি, ’৭১ এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে-ছড়িয়ে-পড়া ভয়াবহতার বয়ান ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র জীবন্ত লাশ অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দেবদাস। যেই অমানিশায় অধ্যাপক এই চিঠি লিখেছিলেন, সেই রাতও কী তার মত নৈঃশব্দে যন্ত্রণার-গহন-বেদনায় বিপন্ন বোধ করেছিলো? খুব জানতে ইচ্ছে করে। সেই ঘনায়মান অন্ধকারে উন্মত্ত মুক্তির স্বপ্নে প্রকৃতিও কী কেঁদেছিলো অঝোরে?


এটাকে সাধারণ একটা চিঠি বলা শুধু ভুলই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পবিত্রতার শরীরে যেন পঙ্কিলতার আঘাত। চিঠিটি মুক্তিযুদ্ধের এমন এক দলিল যেখানে ১৯৭১ এ ঘটে যাওয়া ঘটনাকে প্রলয়, গণহত্যার সাথে তুলনা করেই থেমে থাকেননি লেখক, বরং ঐ দলিল লাল খামে করে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। সেই থেকে পত্রটি সত্যিকারের ইতিহাস হয়ে উঠল। জেনে গেল সকল দেশপ্রেমিক মানুষ। একই সাথে, গণহত্যাকে পরোক্ষ প্রশ্রয় দেবার জন্য (বিশ্ববিদ্যালয়) প্রশাসনের প্রতি ছুড়ে দিয়েছিলেন একরাশ ঘৃণা। পাকিস্তানী ভাবাদর্শের প্রতি নিক্ষিপ্ত সেই ঘৃণার তীব্রতায় নিজের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করলেন অধ্যাপক মুজিব। নতুন নাম নিলেন, দেবদাস।


এই চিঠি যে সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় লেখা বিশুদ্ধ দেশপ্রেমের দর্পন তার প্রমাণ পাই জুবেরী ভবনে যখন তাকে ‘ভাগাড়ে’ নেয়ার জন্য পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন এসে বলল- “আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।” অবিচল দৃঢ়তায় অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের প্রতিক্রিয়া ছিলো নির্লিপ্ত ও সাবলীল। বিন্দুমাত্র মৃত্যুভয় তার চেহারায় দাগ কাটেনি তখন। অণু পরিমাণ ভীতি ও কপটচারিতা যদি তার ঐ লেখনিতে থাকতো, তাহলে হয়তো অনেক বিশ্বাসঘাতক ‘বুদ্ধিজীবির’ মত রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতেন তিনি। এই দৃঢ়তার প্রতিদানে পেয়েছিলেন সামরিক ক্যাম্পে নিষ্ঠুরতম দীর্ঘমেয়াদী নিপীড়ন। পাকিস্তানী পশুদের জঘন্য অত্যাচারে তিনি শারীরিকভাবে যেমন বিপর্যস্ত হয়েছিলেন তেমনি চিরতরে বিদ্ধস্ত হয়েছেন মানসিকভাবেও!


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে মানুষ সমীহ করে জোহা স্যারের বিশ্ববিদ্যালয় বলে। আমরা রাবির শিক্ষার্থীরা গর্ব করে বলি, আমাদের একজন জোহা স্যার ছিলেন, যিনি ছাত্র-ছাত্রীদের রক্ষার জন্য নিজের জীবন দিয়ে শিক্ষক হিসেবে তার অঙ্গীকার প্রমাণ করে গেছেন। জোহা স্যারের কথা মনে এলেই খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়- আমরা সত্যিকারের বীরের জাতি।


আর আমাদের মুজিবুর রহমান দেবদাস, সেই বীরের যোগ্য উত্তরসূরী। তার একটি চিঠির মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সামরিক ক্যাম্পের ভাগাড়ে পতিত থাকতে পারে না। সে মুক্তি চায়, সকল মানুষের জন্য। তিনি এও জানিয়ে দিলেন কাংক্ষিত মুক্তি আসে সংগ্রামের জঠর থেকেই।


এমন বীরকে আমারা ঠিক ভাবে আবিষ্কার করতেই পারি নি তার জীবদ্দশায়। যেই সামান্য স্বীকৃত দেয়া হয়েছিলো, সেটা তার কর্মের তুলনায় নস্যিমাত্র। এই পাপ আমরা মোচন করবো কীভাবে? কীভাবে পরিশোধ করবো তার ঋণ? ঐ নামটি তো সুনন্দ টেরাকোটার মত শোভা পাওয়ার কথাছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ভবনের আকরিকে, সকল ফুলের বাসনায়, শহীদ মিনার-বেদীতে। কিন্তু ৬টা বছর চষে বেড়িয়েছি রাবির চারুকলা থেকে প্যারিস রোড, ইবলিশ চত্বর থেকে বধ্যভূমি, কোথাও মুজিবুর রহমান স্যারের নাম গন্ধও চোখে পড়েনি। এমনকি যে বিভাগে তিনি কাজ করতেন, সে গণিত বিভাগে কাটিয়েছি দুই বছর (সাহায্যকারী কোর্স পড়ার জন্য); একদিনের জন্যও এই জীবন্ত লাশের কোনো স্মৃতিচিহ্নও চোখে পড়েনি।
এই লজ্জা রাখবে কোথায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়? কীভাবে পারলো একটা ইতিহাসকে এতটা উদাসীনতায় ভেসে যেতে? তাদের কী উচিত ছিলো না অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়ার? তারা কী পারতো না জোহা স্যারের পাশাপাশি এই মহীরুহের নাম, তার কর্ম, তার আদর্শের চর্চা করতে?


তাহলে প্রশ্ন উঠবে এখন এসব কথা কেন? এসব কথা এই জন্য যে মৃত্যু হয় দেহের, কর্মের নয়। অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ৫০ বছর অবর্ণনীয় কষ্ট, লাঞ্চনা সহ্য করে ইহলোকের মায়া ত্যগ করেছেন। কিন্তু তার কর্ম, তার স্বপ্ন, তার দেশপ্রেম, রাবির কল্যাণে মাথা না নোয়াবার যেই স্পৃহা, এগুলোকে তো মহাকালের গহবরে তলিয়ে যেতে দেয়া যায় না। মানুষের মাঝে, বর্তমান প্রজন্মের মাঝে অধ্যাপক দেবদাসের আপোসহীন স্বপ্ন প্রচার করা তো আমার, আপনার সকলের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব কীভাবে এড়িয়ে যাবো আমরা? কীভাবে এড়াবে রাবির প্রত্যেকটি প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী? অথবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? কিংবা পুরো দেশ?
লেখক: রিসার্স ফেলো, সাইতামা ইউনিভার্সিটি, জাপান। প্রাক্তন ছাত্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।


বিবার্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com