শিরোনাম
সবকিছু দেখে আমাদের প্রাণটা ঠিকই কাঁদে
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২০, ১৯:০৫
সবকিছু দেখে আমাদের প্রাণটা ঠিকই কাঁদে
ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন
প্রিন্ট অ-অ+

গত বছরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভাইয়ের অসুস্থতা ও চিকিৎসার পর্বটা আমি খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। অপারেশনের পর এপ্রিলে উনার খবর নিতে কয়েক ঘন্টার জন্য সিঙ্গাপুর পর্যন্ত গিয়েছিলাম। অসুস্থতা ও চিকিৎসার খুঁটিনাটি আমি রেকর্ড করে রেখেছি, ইচ্ছে আছে এটা নিয়ে বিস্তারিত লিখবার। কাদের ভাইয়ের প্রতি আমার আগ্রহের অনেক কারণ আছে। আমরা যখন ছাত্রলীগ করতাম, তখন কেন্দ্রীয়ভাবে আমাদের দেখভাল করতেন ওকে কমিশন, অর্থাৎ ওবায়দুল কাদের ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ অনেক সভাতেই ওকে কমিশনের সদস্যরা মাঝে মধ্যে উপস্থিত থাকতেন। এছাড়া, কাদের ভাইয়ের সাথে একসাথে পুরোনো ঢাকার অনেক জনসভায় ও বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের সভায় বক্তৃতা করেছি। অনেক স্মৃতি জমা আছে আমাদের।


ধর্মভীরু হিসেবে ঘনিষ্ট মহলে আমার একটা বদনাম আছে। আর দশটা সাধারণ মানুষের মত আমিও মৃত্যুর ব্যাপারে সৃষ্টিকর্তার উপরে বিশ্বাসী। এই বিশ্বাসের উপরে আস্থা রেখেই বলি, তেসরা মার্চ সকালে বাসা থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে আনার পরে আইসিইউতে মনিটরে যখন কাদের ভাইয়ের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, মনিটরে হৃদস্পন্দনের রেখাটি সরল হতেই ভাবি যখন উপস্থিত ডা. রিজভি ভাইয়ের উদ্দেশ্যে চীৎকার করে উঠেছিলেন, 'রিজভি ভাই, লাইন সোজা হয়ে গেছে', তখনি কিন্তু যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। আল্লাহ হায়াত রেখেছিলেন এটা যেমন সত্য, তখন রিজভি ভাইয়ের তৎপরতাও কিন্তু উল্লেখ করার মত। কয়েকজন মিলে সাথে সাথে ট্রলিতে করে অনেক ঝুঁকি নিয়ে তাকে পাশের বিল্ডিংয়ে হৃদরোগ বিভাগের সিসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।


তখন আমি অধ্যাপক রিজভি ভাই, অধ্যাপক মোস্তফা জামান বাবুল, অধ্যাপক কামরুল হাসান মিলনদের তৎপরতা লক্ষ্য করেছি। কেবল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে নয়, তারও অধিক মমতায় তারা রাতদিন কাদের ভাইয়ের চিকিৎসার সাথে ছিলেন। এই মমতার ভিত্তি ছিল, আমাদের ছাত্রলীগের সেই পুরোনো বন্ধন। আমি জানি, এখানে আপনাদের অনেককিছু বলবার আছে। কেন শুধু রাজনীতির কারণেই এরা কাদের ভাইয়ের চিকিৎসায় বেশি গুরুত্ব দেবেন? বিষয়টা বোধ হয় এত সরলও নয়! কিংবা আমি হয়তো বোঝাতেও পারছি না। কাদের ভাইকে বাঁচিয়ে রাখতে এক্স-ছাত্রলীগের ডাক্তাররা রীতিমত জমের সাথে যুদ্ধ করেছে।


এবারের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে কথা বলছি, মার্চ থেকে খুবই জোরেশোরে চিৎকার করেছি। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর পর্যন্ত তা পৌছায়নি। কেমনে পৌছাবে? যে মানুষটা ছাত্র জীবনে শিবিরের কর্মী ছিলেন, কর্ম জীবনে বিএনপিপন্থী ড্যাব করেছেন, তাকে আমরা অবসরের পরে রীতিমত এক্সটেনশন দিয়ে শীর্ষ পদে রেখে দিয়েছি। তিন মাস সময় পেয়েও যিনি কাজের কাজ কিছুই করেননি, দুয়েকটা প্লাটফর্ম তৈরি করে কিছু দালালকে দিয়ে তোষামোদী করানো ছাড়া। আজ যখন চারিদিকে অশনি সংকেত, তখন কাচুমাচু করে বলছেন, 'সংক্রমণ বেশি হলে মোকাবেলা অসম্ভব'।


বলার আগে একবারও বুক কাঁপেনি? একবারো এর পেছনে নিজের ব্যর্থতা কতটুকু ভাবতে ইচ্ছে করেনি? ছাত্রজীবনে যে মানুষটা চরম ছাত্রলীগ বিদ্বেষী ছিলেন, তাকে দেখি মিডিয়ায় এসে করোনাক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সম্পর্কে নিয়ম করে জাতির সামনে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করতে। তিনি জাতির সাথে কেন এই 'ব্লাফিং গেম' খেললেন? তিনি কি ভেবেছিলেন, তিনি একাই এপিডেমিওলজি বোঝেন? কেন দেশব্যাপী করোনা টেস্ট করার সুযোগ না বাড়িয়ে সবকিছু এতদিন নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখলেন? এই প্রতারণা, এই লুকোচুরির কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, তা কি ইতালি, স্পেন দেখার পরেও বোঝেননি? স্বাস্থ্য অধিদফতরে উচ্চ পদে যতজন আছেন, তাদের মধ্যে কতজন ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ডের?


২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, তখন অধ্যাপক শাহ মনির স্যার ডিজি হলেন, সেই সময়টা আমাদের জন্য স্বর্ণ সময়। তখন আমাদের ছাত্রলীগের ছেলেরা সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিল। সে সময়ে আমরা শত-হাজার কোটি টাকার কোনো দুর্নীতির খবর শুনিনি। অথচ সেইসব পরীক্ষিত মুজিবাদর্শের সৈনিকদের একেকজনের বিরুদ্ধে সামান্য অডিট আপত্তির ধুয়ো তুলে প্রায় সবাইকে বিদায় করা হলো।


কৌশলে দখল নেয়া হলো অফিসের, বসানো হলো একের পর ছাত্রলীগ বিরোধী লোকজনকে। ফলশ্রুতিতে আমরা শত-হাজার কোটি টাকার লুটপাটের গল্প শুনতে পেলাম, জন্ম দিলাম আবজল-মিঠুদের। এখন বুঝি, লুটপাট নির্বিঘ্ন করার জন্যই ডিজি অফিসের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে এক্স-ছাত্রলীগার বসানো হয় না।


আজ যদি ডিজি অফিসের শীর্ষপদসহ গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে এক্স ছাত্রলীগের যোগ্য মানুষগুলো থাকতো, তাহলে পরিস্থিতি নিশ্চিত এ পর্যায়ে যেতো না। আজ যদি দুলাল ভাই, ইসমাইল ভাই বা বাসু ভাইদের কেউ একজন ডিজি থাকতেন, তাহলে কী হতে পারতো সেই দৃশ্যটা আমি কল্পনা করার চেষ্টা করি। "একদল নিবেদিত-যোগ্য কর্মকর্তা সর্বস্ব নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছেন কোভিড-১৯ মোকাবেলায়। মধ্যরাতের নির্জনতা ভেঙে হয়তো ইসমাইল ভাই আমাকে ফোন করে ধমকাচ্ছেন, দেশের এই দু:সময়ে তুই বিদেশে বসে কী করিস? কালই প্লেনের টিকেট কাট।' বিএমএ-স্বাচিপের নেতারা ডিজি অফিসকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে।" এখনতো ডিজি অফিসের সাথে বিএমএ-স্বাচিপের কাজের তেমন কোনো সমন্বয়ই নাই। দুর্যোগকালিন সারা দেশের চিকিৎসকদের করোনা যুদ্ধে সামিল করার মত ক্যারিশমাও বর্তমান ডিজির নাই, তিনি আছেন তার চেয়ার রক্ষায়। বর্তমান ডিজি তো চাকরি করেন, এর বাইরে বর্তমান সরকারকে তো অন্তরে ধারণ করেন না। যেটা চাকরি করি বা না করি, আমরা ধারণ করি। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমরা সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করব বর্তমান সরকার যেন তার কাজে সফল হয়, দেশের মানুষ যেন ভাল থাকে।


আমরা তো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, শেখ হাসিনার কর্মী। আমরা তো কেবল চাকরি করি না, বর্তমান সরকারকে মনেপ্রাণে ধারণও করি। প্রশাসনে এখন চাকরি করা চাটুকারের সংখ্যা বেশি, দক্ষ-যোগ্য মুজিবাদর্শের সৈনিক কম। যারা আছেন, তারা অনেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে কোনঠাসা। চারিদিকে হাইব্রিডদের জয়জয়কার।
সবকিছু দেখে আমাদের প্রাণটা কিন্তু ঠিকই কাঁদে।


লেখক: ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন, চেয়ারম্যান, ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস এন্ড রেসপন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর)


বিবার্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com