নব্বইয়ের পর থেকেই একাধিবার ভাঙ্গনের কবলে পড়ে নয় বছর রাষ্ট্র পরিচালনাকারী এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। ক্ষমতা ছাড়ার পর হামলা-মামলা তাদের নিত্যসঙ্গী হলেও তাতে দলটি ভাঙ্গনের কবলে পড়েনি। তবে দলের শীর্ষনেতাদের মতভেদ এবং দলীয় কোন্দলের কারণেই পাঁচবার ভাঙ্গনের মুখে পড়ে দলটি।
১৯৯১ সালে এরশাদ যখন জেলে বন্দী, তখন দলের হাল ধরেন বর্ষীয়ান নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী। তাকে সহায়তা করেন সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, কাজী জাফর আহমেদ ও শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন। তখন থেকেই দলের অভ্যন্তরে তাদের মধ্যে নানা মতভেদ সৃষ্টি হয়। এই কোন্দলের কারণে ১৯৯২ সালে হঠাৎ করে মহাসচিবের পদ হারান শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন। তখন কাজী জাফর ও শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরোধ ছিলো ওপেন সিক্রেট। সেই ধারাবাহিকতা থেকে দীর্ঘ ২৭টি বছর নিজেদের মধ্যে দলাদলি কোন্দল যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছিলো না দলটির।
যখনই দলটির মহাসচিব পরিবর্তন করা হয় তখনই দলের ভিতর একটি গ্রুপ মহাসচিবের বিরুদ্ধে একটি বলয় সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। আবার ইতিপূর্বে যারা মহাসচিব পদ হারিয়েছেন তাদের বেশিরভাগ সময় আর জাতীয় পার্টি করতে দেখা যায়নি। যেমন এক সময়ের মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জু ও এবিএম শাহাজাহানকে পদ হারানোর পর দলে আর দেখা যায়নি। বহিস্কার করা হয়েছিলো নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে।
এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এবং জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। তারা দুজন মহাসচিবের পদ হারানো পরও দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে ছিলেন সক্রিয়। তবে তাদের দুজনের বিরোধ ছিলো এক প্রকার সাপ আর বেজির মতো।
প্রায় ১৪ বছর মহাসচিবের পদে থাকা রুহুল আমিন হাওলাদারকে হঠাৎ করে বাদ দেয়ায় প্রথম কিছুদিন নিস্ক্রিয় থাকলেও পরে আবার সক্রিয় হন তিনি। কিন্তু এর মধ্যে দলে শুরু হয়ে যায় কে হাওলাদারের লোক আর কে বাবলুর লোক। এ অবস্থায় বিপাকে পড়ে যান দলের নেতাকর্মীরা। হাওলাদারকে সরিয়ে বাবলু আবার বাবলুকে সরিয়ে হাওলাদার। এক পর্যায়ে তারা একে অপরকে রাজনৈতিকভাবে নিজের পথের কাঁটা ভাবতে শুরু করেন।
কিন্তু মহাসচিব পদ হারানোর পর থেকেই জিয়াউদ্দিন বাবলু পার্টির প্রোগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় প্রাণ ফিরে পান দলের নেতাকর্মীরা।
যদিও দলের অনেক নেতাকর্র্মীর অভিযোগ, বাবলু মহাসচিব থাকা অবস্থায় অনেক নেতাকর্মীকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিলো। দলকে সরকারঘেষা করে রাখার জন্যও দায়ী করা হয় জিয়াউদ্দিন বাবলুকে। বাবলু মহাসচিব থাকা অবস্থায় দলের আরেক প্রভাবশালী নেতা অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াও বাবলুর কাছের লোক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ব্যাপক সমালোচিত হোন। যার দরুণ বাবলু মহাসচিবের পদ হারানোর পর দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন রেজাউল। এক পর্যায়ে দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা অবস্থান নেন রেজাউলের বিরুদ্ধে। ফলে জাপার বিগত কাউন্সিলের পর পদ পেতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে।
সম্প্রতি শেষ হওয়া রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে দলের বর্তমান মহাসচিব হাওলাদার এবং সাবেক মহাসচিব বাবলুর মধ্যকার বিরোধের বরফ গলতে থাকে। প্রায় চারদিন সেখানে অবস্থানকালে তাদের দুজনের (হাওলাদার-বাবলু) অন্তরঙ্গ ছবি ফেসবুকে প্রকাশ হলে দলের নেতাকর্মীরা তা শেয়ার করতে থাকেন।
রংপুর জয় করে আসার পর দলের সমাবেশে প্রতিটি পোস্টারেই মহাসচিবের পাশাপাশি জিয়াউদ্দিন বাবলুর নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা রংপুর যাওয়ার আগেও ছিলো না। জাপা সূত্রে জানা যায়, তাদের মাঝে এখন এতটাই মধুর সম্পর্ক যে রুহুল আমিন হাওলাদার দলের কোনো কর্মসূচি দেয়ার আগে বাবলুর সাথে আলাপ করে নেন। বাবুলও যখন-তখন এসে হাজির হন হাওলাদারের বাসায়।
২০ ফেব্রুয়ারি জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ দলের শীর্ষনেতাদের একসাথে বরিশাল নিয়ে গিয়ে চমক দেখিয়েছেন রুহুল আমিন হাওলাদার। সে বহরে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সুনীল শুভ রায়, মুজিবুল হক চুন্নু, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, জহিরুল ইসলাম জহির, নুরুল ইসলাম নুরু, আরিফুর রহমান খান, গোলাম মোহাম্মদ রাজু, জহিরুল আলম রুবেল প্রমুখ।
সেখানে বিভাগীয় কর্মিসভা ছাড়াও নেতৃবৃন্দ কুয়াকাটায় হাওলাদারের মালিকাধীন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করেন। তাছাড়া নিজ বাড়ীতেও তাদেরকে অ্যাপায়ন করেন রুহুল আমিন হাওলাদার।
দলে শীর্ষ পর্যায়ে মিল হওয়ায় খুশি কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এবিষয়ে জাতীয় পার্টির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক নোমান মিয়া বিবার্তাকে বলেন, আমরা সব সময় দলের মধ্যে ঐক্য চাই। আমরা যদি সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকি তাহলে তৃতীয়পক্ষ দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ পাবে না।
জাতীয় ছাত্র সমাজের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিরু বলেন, আমাদের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার কর্মীবান্ধব নেতা। উনি ব্যক্তির চেয়ে দলকে বড় করে দেখেন। সেক্ষেত্রে সবাই যেন একসাথে দল করে পার্টিকে শক্তিশালী করা যায়, সেজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার ওপর জোর দেন তিনি।
এ বিষয়ে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর অব. খালেদ আখতার বিবার্তাকে বলেন, আমার জানা মতে তাদের দুজনের মাঝে কখনই বিরোধ ছিলো না। রাজনীতিতে মতবিরোধ থাকতেই পারে। তবে দলকে শক্তিশালী এবং রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের দলের সকল শীর্ষনেতাই আগেও ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, এখনো ঐক্যবদ্ধ।
বিবার্তা/বিপ্লব/কাফী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]