শিরোনাম
হরিণের খোঁজে নিঝুম দ্বীপ
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ০৮:২৬
হরিণের খোঁজে নিঝুম দ্বীপ
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশের দক্ষিণের মায়াময় এক জায়গা নিঝুম দ্বীপ। এই দ্বীপের বনে ঘুরে বেড়ায় চিত্রা হরিণের পাল। পুরো দ্বীপটাই যেন হরিণের অভয়ারণ্য। এক সঙ্গে এত হরিণের দেখা আর কোথায় মেলে না। শেষ বিকেলে এরা হানা দেয় বেলাভূমিতে। মায়াময় এই দ্বীপ মুগ্ধ করবে যে কাউকে।


দলে আমরা পাঁচজন। অভিজিৎ, ঝিন্টু, আশিক, শফিক আর আমি। তিনজনেরই ক্যামেরা আছে, আগ্রহ নিয়ে ছবি তুলি। বরাবরের মতোই দলের নেতা অভিজিৎ। কোথায়, কিভাবে যেতে হয়, কী কী নিতে হয় সব জানে সে। তাঁর অনেকগুলো বড় ভাই আছে, তাঁদের থেকেই খবর জোগাড় করে। অভিজিৎ আমাদের নিয়ে চলল সদরঘাট। নিঝুম দ্বীপ যেতে চড়তে হবে এমভি টিপুতে। নামতে হবে হাতিয়া দ্বীপে। এ পথে সাকল্যে লঞ্চ চলে দুটি এমভি টিপু এবং এমভি পানামা। যেদিন টিপু চলে সেদিন পানামা বিশ্রাম নেয়। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৫টায় ছাড়ে লঞ্চ। পৌছায় পরদিন সকাল ১০ টায়।


লঞ্চে ডেকজুড়ে বসলাম সবাই। আমরা ডেকে শুয়ে-বসে হৈ হৈ করতে করতে যাব ভেবে রেখেছিলাম। কেবিনে তো অনেক ভাড়া, একটা সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া ৮০০ টাকা। ডেকে মোটে ২২০ টাকা। তবে ডেকে সুবিধা করতে পারলাম না আমরা। অলরেডি বহু লোক বিছানা রেডি করে ফেলেছে। লঞ্চ ছাড়ল পৌনে ৬টায়। লঞ্চের রেলিং ধরে দেশের ব্যস্ততম নগরী ঢাকাকে বিদায় জানালাম। কিছুক্ষণের মধ্যে নিভু নিভু করে জ্বলতে থাকা দিনের আলো একেবারে নিভে গেল। লঞ্চ চলছে। কিছুক্ষণ পর চাঁদও যোগ দিল যাত্রায়।


পূর্ণ দশা প্রাপ্ত হয়নি সে এখনো; তবে যা আলো দিচ্ছে তাতেই মেতে উঠছে চরাচর। লঞ্চের হোটেলে খেতে বসলাম রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ। জনপ্রতি ১০০ টাকার কমে এখানে খাওয়া হয় না। খাওয়াদাওয়ার পর চলল আড্ডা। তবে বেশিক্ষণ জমাতে পারলাম না, শরীর যেতে চায় ঘুমের দেশে। অভিজিৎ একাই ডেকে ঘুমাল। আমরা দুটি সিঙ্গেল কেবিনে। ঘুম ভাঙল সকাল ৭টার দিকে। দিনের আলো উঠে গেছে। সূর্যের দেখা নেই তখনো। অভিজিৎ দেখি ক্যামেরা বের করে শাটার টিপছে। দেখাদেখি ঝিন্টুও শুরু করল। আমি আর বাদ যাই কেন ভেবে ক্যামেরা তাক করলাম দিগন্তে। হাতিয়া পৌঁছাতে সাড়ে ৯টা বাজল। হাতিয়ায় নেমে প্রথমেই নাশতাটা সেরে নিলাম। এবার ডাঙার যাত্রা। প্রথমে রিকশায় করে ‘ওছখালী’ গেলাম, পাঁচজন দুই রিকশায়। ভাড়া নিল জনপ্রতি ৩০ টাকা। আধঘণ্টা পর ওছখালী পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে লোকাল জিপ গাড়ি করে ছুটলাম জাহাজমারার দিকে। মোটামুটি ঘণ্টাখানেকের যাত্রা। রাস্তায় ভালো ঝাঁকুনি। আমার মন্দ লাগছিল না।


জিপ গাড়িতে ভাড়া নিল জনপ্রতি ৪০ টাকা। ‘জাহাজমারা’ থেকে আমাদের বাহন বেবিট্যাক্সি, যেগুলো শহর থেকে বিতাড়িত হয়েছে। ২০০ টাকা নিল। পাঁচজনেরই জায়গা হয়ে গেল। আমি আর শফিক বসলাম ড্রাইভারের দুই পাশে। কিন্তু এবার তো আর ঝাঁকুনি সইতে পারছিলাম না। শখ করে ড্রাইভারের পাশের বসার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। এখন পড়ি তো তখন পড়ি অবস্থা। কোনোভাবে ঝুলে রইলাম আর কি! তামিম বদটা দুর্দশা দেখে আবার কেলাচ্ছিল। এক ঘণ্টা পর পৌঁছালাম নিঝুম ঘাট। এখন ট্রলারে করে ওই পারে গেলেই দ্বীপ পেয়ে যাব। এপার থেকেই দ্বীপের অংশ দেখা যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ চরে এক রাখাল বালক একাই অনেক মহিষ চরাচ্ছে। তুলে ফেললাম ছবিটা। নিঝুম দ্বীপে পা দিয়ে ভাবলাম, যাক বাবা! বাঁচা গেল। কিন্তু হইয়াও হইল না শেষ।



নিঝুম দ্বীপে থাকা-খাওয়া-ঘোরাফেরার জায়গা আসলে আরো ১০-১২ কিলোমিটার ভেতরে। জায়গাটার নাম ‘নামার বাজার’। নামার বাজার যাওয়ার উপায় দুটি- রিকশা ও মোটরসাইকেল। রিকশায় করে যেতে লাগে সোয়া ঘণ্টা। ভাড়া ১৫০ টাকা। আর মোটরসাইকেলে সময় লাগে আধঘণ্টা। জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা। ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা ১টার ঘরে গেছে। আমরা পাঁচজন তিনটি মোটরসাইকেলে চড়ে বসলাম।


যেতে যেতে দেখলাম দ্বীপটার ভেতরের অংশ সাধারণ গ্রামের মতোই। পুকুরে মাছ ধরছে ছেলেপুলেরা। চাষবাসের কাজও করছে। মোটরসাইকেল ড্রাইভারের কাছ থেকে জানলাম, মাছ ধরাই এলাকার মানুষের প্রধান পেশা। কিন্তু জলদস্যুদের কারণে এখন তারা আর আগের মতো নদীতে মাছ ধরতে যায় না। পৌঁছালাম নামার বাজার। পর্যটন হোটেল অবকাশ অথবা লোকাল মসজিদ বোর্ডিংয়ে থাকার সুযোগ আছে। মসজিদ বোর্ডিংয়ে ভাড়া কম, আমাদের তো তাই চাই। এক রুম ৬০০ টাকা। ডাবল বেড। পাঁচজনের আরামসে হয়ে যাবে। এরপর নামার বাজারের হোটেলে খেয়ে চরের দিকে গেলাম। এত বড় যাত্রা শেষে এই প্রথম ঠিকভাবে নিঝুম দ্বীপকে অবলোকন করার সুযোগ পেলাম। বিস্তীর্ণ বিশাল চর, নদীর পাড়ে মাছ ধরার নৌকা, ট্রলার সার বেঁধে দাঁড়ানো। ন্যাড়া চরে মাঝেমধ্যে দু-একটা গাছ।


দূরে প্রায় দিগন্ত রেখায় দেখা যায় ঝাউবন। সূর্যের রশ্মি পানিতে পড়ছে। নৌকা চলছে সেই রশ্মি পড়া পানি দিয়ে। অভিজিৎ এবার পাখির ছবি তোলার উদ্দেশ্যে নিয়ে আসছে। সে তার উদ্দেশ্যমতো এগোল। আমি কখনো পাখি, কখনো নৌকার ছবি তুলছি। ঝিন্টুর টেলিলেন্স না থাকায় বেচারা মন খারাপ করে ল্যান্ডস্কেপই তুলছে। এদিকে শফিক বেরসিকের মতো নদীর পাড়ে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বেচারা তামিম একা হয়ে গেল। আমি ছবি তুলতে তুলতে ওঁর দিকেই এগোলাম।


সূর্যাস্ত পর্যন্ত নদীর পাড়েই কাটালাম। সূর্য ডোবার পর ফিরে গেলাম নামার বাজারে। সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি ছেলেকে দিয়ে খেজুরের রস আনালাম। আহা!! কী স্বাদ! কী গন্ধ!! রাতে খেয়ে ঠিক করলাম নিঝুম দ্বীপ এসে হরিণ না দেখে যাওয়ার তো কোনো মানে নেই। হোটেলের বয়কেই গাইড করে নিলাম। ঠিক হলো সকাল ৬টায় আমরা নাশতা নিয়েই বনের ভেতরে ঢুকব। উদ্দেশ্য হরিণ দেখা। যথারীতি যাত্রা শুরু। বনে ঢুকলাম। বনটা ভালোই ছমছমে। কিন্তু খুব একটা ঘন না। অনেক শাখা মূল মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে। আছাড় খেয়ে পড়লে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যাবে। সাবধানে এগোতে থাকলাম। আধঘণ্টা গেল। হরিণ নেই।


হঠাৎ ছেলেটি বলল, ‘ঐ যে!! ফড়িং !! ফড়িং!! ফড়িং!!!’। আমরা তো অবাক! এলাম দেখতে হরিণ। পোলায় কয় ফড়িং। ঘটনা কী! পরে বোঝালাম যে ‘হরিণ’ই আঞ্চলিক টানে হয়ে গেছে ‘ফরিং’। কিন্তু যে হরিণ দেখাল এর থেকে ফড়িং দেখলেও লাভ ছিল। দূরে ডটের মতো কি একটা দাঁড়িয়ে আছে। নড়লে বোঝা যায় কিছু একটা নড়ছে। তার ওপর গাছের রং আর হরিণের গায়ের রং একই। গাইড ছেলেটি এভাবেই আমাদের ‘ফড়িং’ দেখাতে দেখাতে নিয়ে চলল।


আমরা খুবই বিরক্ত হলাম। কিছুক্ষণ বনে হেঁটে নামার বাজার ফেরত চলে এলাম। মাঝে বনেই নাশতা করে নিয়েছিলাম। এদিকে অভিজিৎ গোঁ ধরল হরিণ না দেখে ছাড়বে না। সে খোঁজ নিয়ে এসেছে ফড়িংয়ের মতো হরিণ নয়, হরিণের মতোই হরিণ দেখা যাবে। গাইড বিদায় করে দিলাম। অভিজিৎ তাঁর এক পরিচিত বড় ভাইকে ফোন করে জানল, হরিণ দেখতে হলে আমাদের চৌধুরীর চরে যেতে হবে। নৌকা ঠিক করতে গেলে ঘণ্টায় ৫০০ টাকা দাম হাঁকাল।


আমরা আবারও খুব বিরক্ত হলাম। কারণ আমাদের জানামতে, সারা দিনে ২০০-৩০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এত টাকা দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই মন খারাপ করে হাঁটছি। অভিজিৎ এদিকে অন্য স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞেস করে জানল দুটি ছোট খাল পার হতে পারলেই চৌধুরীর চরে যাওয়া যাবে। চরে একটি মাচাঘর আছে। ওখানে ঘণ্টা দুয়েক লুকিয়ে বসে থাকলে বিকেলে হরিণের দেখা পাওয়া যেতে পারে। আমরা সেভাবেই এগোলাম। প্রথম খালের কাছে গিয়ে আশপাশে চলতে থাকা নৌকার মাঝিদের অনুরোধ করলাম আমাদের পার করে দিতে। তারা পার করে দিল। এভাবে দ্বিতীয়টাও পার হলাম। পৌঁছালাম চৌধুরীর চরে। সে এক বিশাল চর। অনেক মহিষ ঘাস খাচ্ছে। চরের ভেতরের দিকে বন। বনের শুরুতেই মাচাঘরটি পাওয়া গেল। অভিজিৎ মহা উত্সাহে মাচাঘর পাতা দিয়ে ঢেকে দিল। কাছেই একটা পুকুর আছে। আশা করা যায়, বিকেলে হরিণরা এখানেই পানি খেতে আসবে।


সবাই মাচাঘরের মধ্যে ঢুকে বসে রইলাম। তখন দুপুর হবে। দুপুরের খাওয়া সারলাম বিস্কুট দিয়ে। মাচাঘরে বসে সবাই গল্প করছি। আর ভাবছি আসলেই কি হরিণ আসবে!! অভিজিৎ বারবার একই কথা বলছে, ‘কী একসাইটিং না!! কী একসাইটিং না!!’ আমার ইচ্ছা হচ্ছিল বলি যে ‘মোটেও একসাইটিং না। কোথাকার কোন হরিণের জন্য বসে আছি। তাও আসবে কি না ঠিক নাই।’


কিন্তু ওঁর মতো নিবেদিতপ্রাণ আলোকচিত্রীকে নিরুত্সাহী করতেও মন চাইল না। হাসি দিয়ে বোঝালাম ‘খুবই একসাইটিং!!’ হাসলে সাধারণত আমার দাঁত বের হয় না। ‘একসাইটমেন্ট’ বোঝাতে দাঁত বের করেও দেখালাম। ২টা থেকে বসে আছি। এখন ৪টা বাজে। হরিণ তো দূরের কথা ফড়িংও নেই। হঠাৎ দেখি তামিম লাফিয়ে উঠল, ওই যে! ওই যে!!’ অভিজিৎ বলল, চুপ! চুপ!।’ আমরা সবাই ফিসফিস মোডে চলে গেলাম। বন থেকে ১০-১২টি হরিণের একটি দল বের হচ্ছে। দুটি পুরুষ হরিণ। বাকিগুলো বাচ্চা আর মাদি হরিণ। পুরুষ হরিণ দুটোর ইয়া বড় শিং। কারুকার্যময়। শরীরে সাদা গোল গোল ছোপ। মাচাটা একটু নড়বড়ে ছিল। একটু নড়তেই শব্দ করে উঠল। এতে হরিণদের কয়েকটা বনে লুকিয়ে পড়ল।


বাকিরা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমাদের মাচার দিকে তাকায়ে রইল। ওরা পুকুর থেকে পানিটানি খেয়ে বিদায় নিল। আমরাও তিন ঘণ্টা পর মাচা থেকে নামলাম। কিছুক্ষণ পর সূর্যাস্ত হবে। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতেই নামার বাজার রওনা দিলাম। কিভাবে যাবেন ঢাকার সদরঘাট থেকে এমভি পানামা লঞ্চে হাতিয়া যাওয়া যায়। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৫টায় ছাড়ে। ডেকে ভাড়া ২২০ টাকা। সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া ৮০০ টাকা।সংগ্রহীত।


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com