শিরোনাম
বাংলাদেশের ‘অচেনা' কিছু সমুদ্র সৈকত
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৬:৪২
বাংলাদেশের ‘অচেনা' কিছু সমুদ্র সৈকত
মোস্তাফিজুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশে সমুদ্র সৈকত ক'টি? জানতে চাইলে বেশিরভাগ মানুষই বলবেন কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, পতেঙ্গা বা কুয়াকাটার নাম। অথচ দেশের পুরো দক্ষিণ দিক জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু সমুদ্র সৈকত, সেগুলোর খোঁজেই বেরিয়েছিলাম আমি।


নতুন চালু হওয়া কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের পাশ দিয়ে চলে গেছে টেকনাফের শামলাপুর, শিলখালি আর হাজামপাড়া – প্রায় গায়ে গা লাগানো এই তিনটি সমুদ্র সৈকত। আগে এ সৈকত তিনটিতে মানুষের বিশেষ আনাগোনা ছিল না। অবশ্য তখন তেমন সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। কিন্তু মেরিন ড্রাইভ চালু হবার পর এই সৈকতগুলোতেও এখন পর্যটকের ঢল নামে।


২০০৯ সালে প্রথম গিয়েছিলাম শামলাপুর সৈকতে। টেকনাফের গেম রিজার্ভে বুনো হাতি দেখতে গিয়েছিলাম। টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং থেকে তৈঙ্গা পাহাড় অতিক্রম করে রাতের অন্ধকারে এসে তাঁবু গেড়েছিলাম শামলাপুর সৈকতের বেলাভূমিতে। হাতির ভয়ও ক্লান্তি তাড়াতে পারেনি। নির্জন সৈকতে সেই তাঁবুর মধ্যে মগ্ন হয়েছিলাম গভীর ঘুম।৷ সকালে ঘুম ভেঙেছিল একদল কৌতূহলী মানুষের হল্লায়।


সেবারের দেখা শামলপুর সৈকত মনে ধরেছিল খুব। কক্সবাজার গেলেই তাই চলে যেতাম জায়গাটিতে। এরপর একবার শামলাপুর বেড়াতে গিয়ে দেখা পাই শিলখালি আর হাজামপাড়া সৈকতের। একবার শিলখালি সৈকতেও তাঁবুবাসের সুযোগ হয়েছিল। ঘুম ভেঙে দেখেছিলাম তাঁবুর চারপাশটায় লাল কাঁকড়ারা কিলবিল করছে৷।হাজামপাড়া সৈকত দেখে তো প্রথমে ভ্রমই হয়েছিল, সেন্ট মার্টিনে এসে পড়েছি না তো!


কক্সবাজারে আরো তিনটি অপূর্ব সমুদ্র সৈকত দেখেছি। মানুষজন খুবই কম যান জায়গা-দু'টিতে। এর একটি সোনাদিয়া দ্বীপ। যাতায়াত কষ্টসাধ্য বলেই পর্যটকরা তেমন যান না ওদিকে। শীতের মৌসুমে স্পিডবোটে সোনাদিয়া যাওয়া যায়। তখনও মহেশখালী চ্যানেল আর সমুদ্রের মোহনায় প্রবল ঢেউ থাকে। বর্ষা মৌসুমে তো মহেশখালী যাওয়াই বন্ধ হয়ে যায়। মনে আছে, ২০০৮ সালে প্রথম গিয়েছিলাম সেই দ্বীপে। খুবই নির্জন সৈকতে নানান পাখির বিচরণ দেখেছিলাম সেবার। এরপরও কয়েকবার গেছি দ্বীপটায়। মহেশখালীর ধলঘাটা সমুদ্র সৈকতের নাম হয়ত শোনেনওনি অনেকেই।


কক্সবাজার জেলার আরেক দ্বীপ কুতুবদিয়া। দ্বীপটির পশ্চিমপ্রান্তজুড়ে পুরোটাই সমুদ্র সৈকত। বন্ধুর বাড়ি থাকার সুবাদে বহুবার যাওয়া হয়েছে দ্বীপটিতে৷ এখানেও পর্যটকদের দেখা খুব-একটা পাইনি। সুন্দর দ্বীপ কুতুবদিয়া। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি এখানকার মানুষের জীবনযাত্রাও বিচিত্র। প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আজন্ম লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জীবনযাত্রা উপভোগ করা যায় ছোট্ট এই দ্বীপে। আগে অবশ্য হোটেল-রেস্তোরাঁ ছিল না, এখন সেসবও হয়েছে। প্রাচীন বাতিঘর, বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শুঁটকি কেন্দ্র, সৈকতজুড়ে ঝাউবনসহ আরো অনেক কিছুই আছে এই দ্বীপে।


নোয়াখালীর হাতিয়ায় অবস্থিত নিঝুম দ্বীপ৷ এক সময়ে প্রচুর হরিণ দেখা যেত এ দ্বীপের প্যারাবনে। আমিও ছোট্ট এ দ্বীপে গিয়েছিলাম হরিণ দেখতে, এখানকার সমুদ্র সৈকত দেখতেও। সত্যিই বিমোহিত হয়েছিলাম। নিঝুম দ্বীপের গোটা দক্ষিণ প্রান্তজুড়ে বিস্তীর্ণ বেলভূমি। সেখানে লাল কাঁকড়া আর সামুদ্রিক পাখিদের নির্ভয় বিচরণ। নিঝুম দ্বীপের সৈকতে দেখা সূর্যাস্তের সেই মায়াময় রূপ ভোলা সম্ভব নয় কখনোই।


পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে সোনারচর৷ গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের পানপট্টি থেকে ছোট লঞ্চে চেপেছিলাম তাপসী দ্বীপের উদ্দেশে। পথে আগুনমুখা মোহনার ভয়াবহতা টের পেয়েছিলাম। তাপসী দ্বীপে নেমে ঘণ্টাখানেক হেঁটে পৌঁছেছিলাম সোনারচরে। সৈকতে পা ফেলেই দীর্ঘ ভ্রমণের সব ক্লান্তি ভুলেছিলাম। প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতে মানুষের চিহ্নমাত্র নেই৷ সদ্য জোয়ারে ধুয়ে যাওয়া বেলাভূমিতে একদল জেলের জাল তোলা দেখে কাছে গিয়েছিলা্ম। জানতে পেরেছিলাম এ সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত – দু'টোই দেখা যায়। তবে সময়স্বল্পতায় কোনোটাই দেখা হয়নি। দিনে দিনেই যে ফিরতে হয়েছিল সেবার।


বরগুনার লালদিয়া সুমদ্র সৈকতও কম সুন্দর নয়। হরিণঘাটা জঙ্গলের শেষ প্রান্তে এই সৈকত। বন ধরে হেঁটে গেলে সমুদ্রে পৌঁছাতে সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েক। এ সৈকতটি খুব দীর্ঘ নয়, কিন্তু সৌন্দর্যের কোনো কমতি নেই!


বাংলাদেশের সুন্দরবন লাগোয়াও বেশ কয়েকটি সমুদ্র সৈকত আছে। নির্জনতা, বাঘের ভয়, সুন্দরী-গড়ান-কেওড়ার জড়াজড়ি মিলিয়ে অন্যরকম এক জায়গা। অতিপ্রাকৃত, অপার্থিব। পক্ষির চর থেকে ডিমের চর, কচিখালী থেকে জামতলা, টিয়ার চর থেকে দুবলার চর আর মান্দারবাড়িয়া থেকে পুটনি দ্বীপ - একেকটি সমুদ্র সৈকত যেন একেকটি বিস্ময়।


সুন্দরবনে দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় কাজ করার সুবাদে সবগুলো সৈকতেই যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কোনো কোনো সৈকতে দিনভর বেড়িয়েছি, অথচ বেশিরভাগ সময়ই কোনো মানুষের দেখা পাইনি।


আমার দেখা বাংলাদেশের এসব ‘'অচেনা'' সমুদ্র সৈকতে খুবই কম পর্যটক যান। এই না-যাওয়ার প্রধান কারণ মনে হয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব। এ সব সৈকতে যাতায়াতব্যবস্থা যেমন খুবই খারাপ, তেমনি অভাব আছে হোটেল-মোটেলেরও। দেশের দক্ষিণ দিকজুড়ে প্রকৃতির অমূল্য দান এ সব সমুদ্র সৈকতে পর্যটক টানতে হলে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। কারণ উন্নত যাতায়াতব্যবস্থাই পর্যটন উন্নয়নের পূর্বশর্ত। পাশাপাশি হোটেল-মোটেল নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি উদ্যেক্তাদেরও।


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com