শিরোনাম
হেজাজের মরুপথে
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:১৪
হেজাজের মরুপথে
মূল : পল স্যাপলক অনুবাদ : হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
প্রিন্ট অ-অ+

প্রাচীন হেজাজে কুয়ার সংখ্যা কয়েক হাজার। আমরা পথ চলছি সেগুলো দেখতে দেখতে। এসব কুয়ার কোনো কোনোটার পানি মিঠা, বেশিরভাগেরই লোনা। তবে তাতে কিছু যায়-আসে না। আরব জাহানের এক সময়কার বহু-ব্যবহৃত কাফেলার চলার পথে গুটি বসন্তের দাগের মতো খচিত হয়ে থাকা এসব কুয়া আজো সময়ের সাক্ষ্য হয়ে আছে। যেন বলছে, ''আজকের এই পরিত্যক্ত জনপদ এক সময় মানুষের কোলাহলে মুখরিত ছিল''। কাফেলা পথ চলত আর পথে পথে থেমে এসব কুয়ার পানি পান করত। এক সময় এ অঞ্চল শাসন করত হাশেমীয়রা। তারাই এসব কুয়া খনন করিয়েছিল। এসবের কোনো-কোনোটিতে এখনো লোক সমাগম হয়, আবার কোনোটি বা নির্জন, জনশূন্য। এসব কুয়ার সাথে মিশে আছে অনেক সুখ-দুঃখের কাহিনী।


আগস্টের এক আগুনঝরা দিনে আমরা পৌঁছে যাই অধুনাবিস্মৃত ওয়াদি ওয়াসিত কুয়ার ধারে। কুয়াটা আমাদের দীর্ঘ ভ্রমণের মাঝপথে। আমাদের পায়দল যাত্রার দৈর্ঘ্য সাত শ’ মাইল - জেদ্দা থেকে জর্দান। সম্ভবত গত কয়েক শ’ বছরের মধ্যে এই পথে এটাই প্রথম কারো পায়দল সফর।


কুয়ার ধারে দু’টি কাঁটা গাছ। তার ধূসর ছায়ায় আমরা বসলাম একটু জিরিয়ে নিতে। সেখানেই এক লোকের সাথে দেখা। লোকটি বসেছিল একটি পিকআপ ট্রাকে। আমাদের দেখে নেমে এলো। দেখেই বোঝা যায়, মরুর বেদুইন পশুপালক। কৌতূহলী, বন্ধুত্বপরায়ণ তবে আমাদের দেখে একটু যেন বা বিব্রতও মানুষটি। হড়বড় করে অনবরত কথা বলছিল। সে আমাদের ভেবেছে, গুপ্তধন অনুসন্ধানী (ভাবখানা, তা-ই যদি না হবে, তবে এই নির্জন মরুভূমিতে পায়দলে চলেছো কেন হে বাপুরা?)। লোকটি আমাদের দেখাতে নিয়ে এলো পুরনো জিনিসপত্র - একটি আংটি, একটি তরবারি, একটি প্রাচীন মুদ্রা। আমরা জানতে চাই, কত দিনের পুরনো এগুলো? লোকটি বলতে পারে না। শুধু বলে, কাদিম জিদন, মানে অনেক আগের।


মরুচারী এই বেদুঈনের দেখানো এসব জিনিস অনেক পুরনো নাও হতে পারে, কিন্তু আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেই হেজাজ সত্যিই অনেক, অনেক, অনেক পুরনো। এখানে এসে মিশেছে আরব, আফ্রিকা ও এশিয়া। এর সাথে ইউরোপের বাণিজ্যসম্পর্কও কম দীর্ঘ নয়। এই জায়গাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গল্পকাহিনী। এই হেজাজ দেখেছে লাখ লাখ পরিব্রাজক। প্রস্তর যুগের মানুষেরা আফ্রিকা থেকে এই পথ বেয়ে চলে গেছে উত্তরে। কয়েকটি আদি মানবসভ্যতার (অ্যাসিরীয়, মিসরীয় প্রভৃতি) লোকজনও এখানে পরিভ্রমণ করেছে। করেছে ধূপ ও স্বর্ণের বিনিময়ে দাসব্যবসা।


রোমকরা একপর্যায়ে হেজাজ দখল করে নেয়। সে সময় পানির অভাবে এবং অন্য নানা রোগে ভুগে তাদের হাজার হাজার যোদ্ধা প্রাণ হারায়। এই হেজাজের মক্কা নগরীতে ইসলাম ধর্মের জন্ম এবং মদিনা নগরে তার বিকাশ হয়। মরক্কো থেকে আসা তীর্থযাত্রীরা সম্ভবত এই ওয়াদি ওয়াসিত কুয়ার পানি পান করত। হয়তো লরেন্স অব অ্যারাবিয়াও এই এই কূপের পানি করেছিলেন। করেছিলেন কি? কেউ জানে না। কাদিম জিদন (অনেক আগের কথা) যে!


আমরা যখন জিনিসপত্র গুছিয়ে আমাদের উট দুটোর পিঠে তুলছি, তখন বেদুইন লোকটিকে আবার দেখি। সে তার গায়ের সাদা জোব্বাটি খুলে ফেলেছে, পরনে আছে কেবল আন্ডারওয়্যার। উদোম শরীরে নিষ্ঠুর সূর্যের নিচে লোকটি কুয়ার চার পাশে চক্রাকারে ঘুরছে। আমাদের দোভাষী আলী আল হারবি লোকটির একটি ছবি তুলে নিলো। আমাদের উটচালক আওয়াদ ওমরান লোকটির কাণ্ড দেখে হেসেই খুন। কিন্তু আমি হাসতে পারলাম না। লোকটি তো পাগল নয়, ধাবমান, অথবা নেশাসক্ত। কিংবা সে কেবলই মজা করছে। আমি ভাবি, এই মানুষটি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আমরা সবাই-ই কি নিজেদের হারিয়ে ফেলিনি? নিজেদের ইতিহাস ভুলে গিয়ে আমরা তো নিজেদের হারিয়েই ফেলেছি। আমরা জানি না আমাদের গন্তব্য কোথায়। এই হেজাজে অতীত মানেই পরিত্যক্ত। এমন স্মৃতিহারা জায়গা আমি আর কোথাও দেখিনি।


অন্য রকম জেদ্দা


জেদ্দার একটি চমৎকার ভবনের ভেতরে একটি চকচকে কাঠের টেবিলের চার পাশে আমরা। টেবিলে রাখা কাপে ঘন ও কড়া কফি। কাপে কফি শেষ হতেই তিনজন সুবেশী হেজাজী নারী তা ফের ভরে দিচ্ছেন। তারা কথা বলছেন। তারা চান, সউদি আরব সম্বন্ধে বহির্বিশ্বের যে ভুল ধারণা, তা ভেঙ্গে যাক। বাইরের দুনিয়া মনে করে, সউদি আরব একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এখানে নারীদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পর্দার অন্তরালে কাটাতে হয়।


তারা বলছেন, সউদি আরব হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে একটি মানব মোজাইক। এর নানা অঞ্চলে বাস করে নানা গোত্রের মানুষ। তাদের রয়েছে পৃথক সংস্কৃতি। পুব দিকে শিয়া, দক্ষিণে ইয়েমেনি, উত্তরে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং কেন্দ্রে বেদুইন। কেন্দ্রেই নজদীদের বাস। এখানেই শাসক সউদের বাড়ি। তিন নারীই জোর দিয়ে বললেন, বর্তমান শাসকদের অধীনে আসার আগে সউদি আরবের কোনো অঞ্চলই এত স্বাধীনতা ভোগ করেনি।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরই হেজাজ পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে যায়। ১৯২৫ সালে আল সউদ রাজবংশ হেজাজকে সউদি আরবের অঙ্গীভূত করে নেয়। হেজাজে আছে পবিত্র দুই নগরী, যেখানে অমুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ। পক্ষান্তরে, সউদি আরবের অন্য অনেক স্থানে স্থানীয় ও অভিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। সাংস্কৃতিক সংরক্ষণবাদী লায়লা আবদুল জাওয়াদ বলেন, দুনিয়ার সব প্রান্ত থেকে মুসলমানেরা হেজাজে এসেছে। তাই তো আমাদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে মধ্য এশিয়া থেকে আসা বুখারি চালের ভাত। আমাদের কাপড় আসে ইন্ডিয়া থেকে। আমাদের উচ্চারণে রয়েছে মিসরীয় টান। বিশ্ববাসীর কাছে কেন্দ্রের লোকদের চেয়ে আমরা অনেক বেশি খোলামেলা।


সালমা আলীরেজার পরিবার বংশপরম্পরায় পোশাকে এমব্রয়ডারি করে থাকে। সালমাও তাই করেন। তিনি খোলাখুলি বলেন, ‘আবায়া নামে যে পোশাকটি এখন এখানকার নারীদের গায়ে দেখেন, এটি কিন্তু হেজাজী নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নয়। কুচকুচে কালো রঙের এই পোশাকটি নজদী শাসকরাই আমাদের মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এখানকার মেয়েরা আগে ঘরে-বাইরে সবখানে উজ্জ্বল লাল ও নীল রঙের পোশাক পরত। এটাই ছিল ওদের চিরাচরিত প্রথা। ১৯৬০-এর দশকে এসে সবকিছু পাল্টে গেল। তেল বিক্রির অঢেল অর্থ আমাদের হাতে এলো। আমরা অতিরিক্ত দ্রুতগতিতে আধুনিক হলাম। কিন্তু এই ৫০ বছরে আমরা আমাদের জীবনের অনেক বেশি কিছু হারিয়ে ফেলেছি।’


তবে তরুণ মার্কেটিং কনসালট্যান্ট রাবইয়া আলফাদল বলেন অন্য কথা। তার প্রশ্ন ‘হেজাজ কি এখনো বদলে গেছে?’ তিনি বলেন : ‘দেখুন না চার দিকে একটু তাকিয়ে!’


সত্যিই তাই। চার দিকে তাকিয়ে দেখা গেল টেবিলে যে নারীরা বসে আছেন, তাদের মুখ ঢাকা নয়। তাদের পরনে ক্যাজুয়াল পশ্চিমা পোশাক (সউদি আরবের রাজধানী রিয়াদে এরকম কোনো বৈঠক করা একেবারেই সম্ভব হতো না। সেখানে লিঙ্গবৈষম্য ও গোত্রীয় আইনকানুন এতই কড়া যে, একজন পুরুষ এমনকি তার মায়ের নামও উচ্চারণ করতে পারে না)। যে বাড়িটিতে আমরা বসেছি, তাও আধুনিক কেতায় সজ্জিত। আর বাড়ির বাইরে জেদ্দার রাজপথে হাঁটলেই চোখে পড়বে আর্ট গ্যালারি, ক্যাফে, খোলা চত্বর, জাদুঘর সবই। সত্যিই, জেদ্দা যেন সউদি আরবের সাংস্কৃতিক আলয়।


লায়লা আবদুল জাওয়াদও তা-ই বলেন। তার মতে, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের ধারাটি হেজাজ হাজার বছর ধরে লালন করে এসেছে। তারা নিজেদের মতো করে সঙ্গীত রচনা করেছে, নিজস্ব রন্ধনপদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে এবং তাদের রয়েছে নিজস্ব উপকথা। এই সংস্কৃতিকে কিছুটা হলেও বাঁচানোর জন্য আমরা এখনো সচেষ্ট।’


যে নারীদের সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলাম তারা সবাই একটি নারীবাদী শহরের কন্যা। আগেই বলেছি, শহরটির নাম জেদ্দা। এই শহরটি এখন একটি আধুনিক, বর্ধিষ্ণু শিল্পনগরী। কিন্তু আরব উপকথা অনুযায়ী এই শহরেই অন্তিম শয়ানে শায়িত আছেন আদিমাতা বিবি হাওয়া। এখানে আছে তাঁর মাজার, যা লম্বায় দুই শ’ গজ। ভূপর্যটক ইবনে জুবাইরের লেখা থেকে জানা যায়, এক সময় এর ওপরে ছিল গম্বুজবিশিষ্ট সুউচ্চ স্থাপনা। এখন আর তা নেই। ওয়াহাবি আলেমদের নির্দেশনায় তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। কারণ তাদের মতে, কবরের ওপর এক ধরনের স্থাপনা নির্মাণ ইসলাম সমর্থন করে না। এখন কবরটি চার দিকে কংক্রিটের ঘেরা দিয়ে কেবল চিহ্নিত করা আছে।


আবার যাত্রা শুরু


জেদ্দা থেকে তিন শ’ মাইলেরও বেশি দূরে গিয়ে আমরা হাঁটা বন্ধ করলাম যেখানে, সেখানে আছে শুকিয়ে যাওয়া একটি কুয়া। কুয়াটির নাম আল আমারাহ। আমাদের পা দুটো ক্লান্ত। আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি। আমাদের পাশ দিয়ে দ্রুত চলে গেল একটি টয়োটা হিলাক্স গাড়ি। এই গাড়িই আধুনিক বেদুইনদের ‘লোহার উট।’


সউদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে এমন একাকী পায়ে হেঁটে পরিভ্রমণ, এক বা দুই প্রজন্ম আগেও চিন্তা করা যেত না। কারণ তখন এই মরুর কোথাও না কোথাও মরুগামী বেদুইনদের কালো তাঁবু চোখে পড়তই। এখনো কোথাও কোথাও তার চিহ্ন চোখে পড়ে। এসব তাঁবুতে বাস করত হেজাজের বিখ্যাত আদিবাসী বেদুইন গোত্রের লোকজন। বালাভি, হারব, জুহানিয়া কত গোত্র! সেই মরুর সন্তানেরা এখন থিতু হয়েছে নানা শহরে, শহরতলিতে, অফিস-আদালতে, আর্মির ব্যারাকে। আধুনিক সউদি আরব ব্যাপক নগরায়ণ হয়েছে, যা একমাত্র আমেরিকার সাথেই তুলনীয়।


তবে কিছু অদম্য বেদুইন এখনো তাদের মরুচারী জীবন ছাড়তে রাজি হননি। তারা এখনো মরুভূমিতে রয়ে গেছেন। আমরা যেখানে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তার অল্প দূরেই এরকম একজনের সাথে সাক্ষাৎ। ধূসর রঙের দাড়ি, পরনে ধূসর জোব্বা (থোবে)। প্রবীণ এই মানুষটির নাম আবু সালেহ। তিনি বিস্তীর্ণ মরুর দিকে আঙুল তুলে আমাদের বললেন, ‘এখানে আমরা সব ভ্রমণকারীকে স্বাগত জানাই।’


মানুষটি আমাদের জন্য কিছু উপহার নিয়ে এসেছিলেন। বললেন, ‘অতিথিকে উপহার দেয়াটা আমাদের প্রথা।’ ছোট্ট কিন্তু সহৃদয়তার প্রতীক এই উপহার একটি স্টিলের বাটিভরতি উটের দুধ। এরপর আবু সালেহ আমাদের বিদায় জানালেন।


আমরা এগিয়ে চললাম আল আমারাহ কুয়াকে পেছনে রেখে। আমাদের সামনে-পেছনে এরকম আরো অসংখ্য জলাধার। সময়ের প্রয়োজনে এসব কুয়া খনন করা হয়েছিল, সময়ের অভিঘাতে সেগুলোর বেশিরভাগই হয় বিলুপ্ত নতুবা বিবর্ণ।


ইতিহাস বলে, হেজাজে এ রকম কুয়া খননের সূচনা করেন দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা:)। এক দিনের পথের প্রান্তে একটি করে কুয়া খনন করান তিনি। শুধু কুয়া নয়, হজযাত্রীদের জন্য প্রাচীন পৃথিবীতে তিনিই প্রথম যাত্রাবিরতি স্থান বা সরাই নির্মাণ করান। সেখানে থাকত দুর্গ, অতিথিশালা, খেজুর বাগান, চিকিৎসার ব্যবস্থা, খাল এমনকি মাইলফলক পর্যন্ত। খলিফা ঘোষণা দিয়েছিলেন : ‘একজন পথিকই নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হকদার’। সে ব্যবস্থা করেও ছিলেন তিনি।


আমরা ফের পথ চলতে শুরু করলাম। সেই পথ, যে পথের ধুলোয় মিশে রয়েছে লাখো লাখো উটের খুরের দাগ, লাখো লাখো পথিকের পায়ের ছাপ। টিমবাকটু থেকে আসা বিজ্ঞজনেরা এ পথের দুই পাশের কুয়ার পানি পান করেছিলেন। পান করেছিলেন এ পথ অতিক্রমকারী স্পেনীয় বণিকের দল, ইউরোপীয় অভিযাত্রী দল।


এই অভিযাত্রী দলের একজন চার্লস এম ডাউটি। তিনি লিখেছেন, তার কাফেলায় ছিল ১০ হাজার প্রাণী এবং ছয় হাজার মানুষ। তারা যখন পথ চলত তখন তার দৈর্ঘ্য হতো প্রায় দুই মাইল এবং প্রস্থ কয়েক শ’ গজ।


এই ঐতিহাসিক পথ বেয়ে আমরা আল ওয়া শহরের উত্তরে গিয়ে থামলাম। উট দুটোকে ছেড়ে দেয়া হলো একটি কুয়ার পাশে। কুয়ার নাম আল আনতার। তার পাশ ঘেঁষে এখন ব্যস্ত মহাসড়ক। সর্বক্ষণ গাড়ির আনাগোনা, তার চলার শব্দ ও হর্নের আওয়াজ। প্রায় শত বছর আগে কুয়াটি প্রায় শুকিয়ে যায়। তাছাড়া থেকেই বা কী হতো। হজযাত্রীরা এখন বোয়িং-৭৭৭ বিমানে করে উড়ে আসে, উড়ে যায়। এই কুয়ায় তাদের কী কাজ! আমি উবু হয়ে কুয়াটির তলার দিকে তাকাই। ওর তলার দিক থেকে কেমন যেন একটা ভ্যাপসা বাতাস এসে আমার মুখমণ্ডলে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। অনেক দূরে কোথাও একটা পাখির শিস ভেসে আসে আমার কানে। আমার মনে হয়, আরব দুনিয়া তো দেখি আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলের মতোই; ভয়াল নিঃসঙ্গ।


অমুসলিম পরিব্রাজক দল


অমুসলিম বিশ্বে হেজাজ নামটি এখনো রোমাঞ্চ জাগায়। তাদের কাছে এ দেশটি এখনো রহস্যঘেরা এই ভাবনার পেছনে রয়েছে কিছু বিদেশী ভ্রমণকারীর দীর্ঘ পথ চলার কাহিনী।
তাদের একজন হচ্ছেন উনবিংশ শতকের সুইস কৃতবিদ্য পুরুষ জোহান লুডইইগ বার্চহাট। তিনি ভিখারির বেশে ইসলাম ধর্মের তীর্থস্থানগুলো পরিভ্রমণ করেন। তিনি ‘মিসরীয় ভদ্রলোক’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যদিও মিসরকে তিনি কখনো তার স্থায়ী ঠিকানা করেননি। তবে আমাশয়ে ভুগে তার মৃত্যু হলে মিসরের রাজধানী কায়রোতে তাকে ইসলাম ধর্মীয় রীতিতে সমাধিস্থ করা হয়।


পরিব্রাজকদের আরেক জন হলেন রিচার্ড ফ্রান্সিস বারটন। এই মেধাবী ও দাম্ভিক ইংরেজ ভদ্রলোকটি পবিত্র কাবাগৃহ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে সক্ষম হন। তিনি প্রত্যক্ষ করেন, পৃথিবীর এই অংশে সময় কিভাবে স্থির হয়ে আছে।


এই ইউরোপীয় পর্যটকেরা দেখেন লোহিত সাগরের উপকূলে গড়ে উঠেছে শহর। সেই শহরের বাড়িঘরের দরজা-জানালা লাল ও নীল রঙে চিত্রিত। তারা হেঁটেছেন দেয়ালঘেরা বিভিন্ন শহরে, যে শহরের দীর্ঘ ফটকগুলো সূর্যাস্তের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায়। তারা তাদের উট বেঁধেছেন দুর্গসদৃশ মরুদ্যানে, যেখানে ছিল বুনো চুলওয়ালা বেদুইনরা। বেশভূষা যা-ই হোক, এই বেদুইনদের প্রশংসা করার মতো অনেক গুণ ছিল, সে কথাও লিখে গেছেন তারা।


এই ‘সাহিত্যের হেজাজ’ যদিও কখনো থেকেও থাকে, আজ কিন্তু আর নেই। আমেরিকান স্টাইলের ছোট ছোট শহর ও বিপণিবিতানের নিচে তা চিরকালের মতো চাপা পড়ে গেছে।


সবাই ভুলে গেছে


আল জুরাইব দুর্গের ভেতরে একটি কুয়া। চার শ’ বছর আগে ওসামানীয় শাসকেরা এটি তৈরি করেছিলেন। আমরা যেদিন সেখানে পৌঁছি সেদিন শ্রমিকেরা কুয়াটি পরিষ্কার করছিল। কুয়ার ভেতর থেকে উঠে আসছিল কামানের গোলা। মনে হয়, ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে আক্রমণকারীর ভয়ে এগুলো কুয়ায় ফেলে দেয়া হয়। ওই সময় একদল উষ্ট্ররোহী আরব সেনাদল দ্রুত এগিয়ে আসছিল। তারা হেজাজের বিভিন্ন গোত্র যারা ওসমানীয় শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। সেই বিদ্রোহের অন্যতম মদদদাতা এক বিদেশী টমাস এডওয়ার্ড লরেন্স, যিনি ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ নামে পরিচিত।


এই তরুণ ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা চেয়েছিলেন আরব বিশ্বে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে, যা কিনা তাৎকালীন ওসমানীয় শাসকগোষ্ঠীর পায়ের তলায় পিষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু যুদ্ধশেষে তিনি একটি ভুল করে বসেন। তিনি পক্ষ নেন উদারপন্থী হাশেমীয় প্রিন্স ফয়সালের। কিন্তু ইতিহাসের চাকা তখন ভিন্ন দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। তাই তো গোত্র সঙ্ঘাতে উপদ্বীপের ভাবী রাজা ইবনে সউদের কাছে হেরে যান প্রিন্স ফয়সাল। আর সেই সাথে ইতিহাসের পাতায় খানিকটা খাটো হন লরেন্সও। কেননা ইতিহাস তো বিজয়ীরাই লিখে। আমি যখন কামানের একটি গোলার দিকে আঙুল তুলে বললাম, ‘লরেন্স আল আরব', দেখলাম শ্রমিকদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। অর্থাৎ এই নাম তাদের কাছে কোনো অর্থ বহন করে না।


মসজিদে নববীতে ইফতার


তখন রমজান মাস। ইফতারের সময় সমাগত। মদিনার মসজিদে নববীর উঠোনে বসেছে কয়েক হাজার মানুষ। তাদের সামনে ইফতারসামগ্রী, সাথে প্লাস্টিকের কাপে করে পানি। এখানে যারা বসে আছে তারা এসেছে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। আমি দেখতে পাচ্ছি আফ্রিকান ও ইন্ডিয়ান। শুনতে পাচ্ছি ফরাশি ভাষায় কথোপকথন। আমার সামনে ইফতারি রেখে হাঁটু গেড়ে বসেছে একদল আফগান। আমি মুসলমান নই, তবু মুসলমানদের সম্মানে সারা মাস রোজা রেখেছি। আমার পাশে এক রোজাদার তার হাতের কমলাটি আমাকে দিলেন, আমি আমারটা তাকে দিলাম। এভাবে কয়েক বার আমাদের ইফতারি অদলবদল হলো। আমরা হাসলাম। এরপর আজান হলো। সবাই একটু কিছু মুখে দিয়ে রোজা ভেঙে নামাজে দাঁড়াল। নামাজশেষে ফ্যাকাশে হলদেটে আকাশের নিচে বসে আমরা অসংখ্য মানুষ সুন্দর নীরবতায় ইফতার সারলাম।


নতুন কুয়া


হেজাজে এখন নতুন ধরনের কুয়া পুরনো কূপের জায়গা দখল করেছে। এই কুয়া প্রাকৃতিক নয়, যান্ত্রিক। যন্ত্র অবিরাম গুন গুন শব্দ তোলে, যন্ত্রই মাটির নিচে থেকে পানি তুলে আনে। সেই পানি ঠাণ্ডা করার প্রযুক্তিও আছে। এই পানি এত ঠাণ্ডা, এর ঝাপটা দিলে মুখমণ্ডল নিঃসাড় হয়ে আসে। এই যান্ত্রিক কুয়াকে আরবরা বলে আসবিলা। আল্লাহর রহমত লাভের আশায় ধর্মপ্রাণ মানুষেরা রাস্তার ধারে ধারে এরকম অসংখ্য আসবিলা স্থাপন করেছে। কিন্তু এক কাপ ঠাণ্ডা পানির জন্য এত খরচ!


আল ওয়াঝ বন্দরের ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম দুঃখ করে বলেন, ‘আমরা ধনসম্পদের কাছে আমাদের অতীত বিকিয়ে দিয়েছি। আমার দাদার দিনের প্রবাল পাথরে তৈরি আমাদের যে বাড়িটা, তার বয়স দুই শ’ বছর, সেটি কোথায় আজ বলতে পারেন? বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যে ডকে ইরিত্রিয়া থেকে ধাউয়ে (দেশীয় নৌকা) করে উট আনা হতো, সেটি কই? নেই। আমাদের শহরের বাতিঘরটা, যেটা দেখে সমুদ্রে ২০ মাইল দূরে থেকেও দিক নির্ণয় করা যেত, সেটি কোথায় গেল? গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। সবার ধারণা, এসবই পুরনো জিনিস, এগুলোর কোনো আর্থিক মূল্য নেই।’


পুরনো নিদর্শন বিলুপ্তির জন্য হেজাজিদের কেউ কেউ সউদি আরবের ‘অতিরক্ষণশীল’ শাসকদের দায়ী করেন। যেমন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মক্কা ও মদিনা নগরীর পুরনো অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে, যার সাথে এমনকি মহানবী সা:-এর স্মৃতিও বিজড়িত। নগর ইতিহাসবিদরা এটা মেনে নিতে পারেননি। সরকারিভাবে অবশ্য বলা হয়েছে, হজের সময় হাজীদের স্থান সংকুলানের জন্য এ ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। কিন্তু ধর্মাবেত্তাদের আশঙ্কা, ইসলাম-পূর্ব সময়ের তো বটেই, এমনকি ইসলামি যুগের নিদর্শনও দর্শনার্থীদের বস্তুপূজায় আকৃষ্ট করতে পারে।


একটা বিষয় অবশ্য খুবই উল্লেখযোগ্য যে, হেজাজের ঐতিহ্য বিনষ্টের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হতে দেখা গেছে সউদি আরবের বাইরে থেকে আসা মুসলমানদের। জেদ্দার পুরনো শহরের মেয়র মালাক মোহাম্মদ মেহমুদ বাইসা বলেন, ’সউদি তরুণদের ইতিহাসে আকৃষ্ট করাটা কঠিন। কেননা তাদের স্কুলে ইতিহাস বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয় না।’


হারানো দিনের গান


এক দিন আমি যাই হেজাজের উপকূলের এক শহরে। এখানকার অধিবাসীরা এক সময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন তারা তাদের নৌকাগুলো ভাড়ায় দিয়েছে বাংলাদেশী অভিবাসীদের কাছে। এই শহরের শেষ মৎস্যজীবী মানুষটির সাথে আমার দেখা হয়। তিনি আমাকে শোনান ধাউ (কাঠের তৈরি দেশীয় নৌকা) যুগের গান। আমি আমার টেপরেকর্ডারে তা রেকর্ড করি। কত রকম গান - লোহিত সাগরের উষ্ণ হাওয়ার গান, বন্দরে বন্দরে অপেক্ষামাণ রূপসী নারীদের নিয়ে গান।


বদলে যাচ্ছে দিন


প্রত্যেক দেশই তাদের অতীত নিয়ে কোনো না-কোনোভাবে বিব্রত ছিল। এক প্রজন্ম আগের আমেরিকার পাঠ্যপুস্তকে সেদেশের আদিবাসীদের নিয়ে কিছু লেখা থাকত না। নানা কারণে সউদি আরব এতদিন তার ঐতিহ্য রক্ষায় তৎপর না থাকলেও এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। যেমন হেজাজ রেলওয়ে জাদুঘর নির্মাণে রিয়াদ প্রায় ১০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে। জেদ্দায় পুরনো অংশকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করা যায় কিনা বিবেচনার অনুমতি দিয়েছে ইউনেস্কোকে (এ রকম একটি বিশ্বসম্পদ হেজাজেও আছে; মাদাইন সালিহ, নাবাতাইয়ান সাম্রাজ্যের সময়ের বিশাল সামাধিক্ষেত্র)। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, প্রায় আট শ’ বাড়ি নিয়ে গঠিত সমগ্র হেজাজি কারাভাঁ শহর আল উলাকে পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সউদি সরকার। ৪০ বছর ধরে পরিত্যক্ত হয়ে নষ্ট হতে চলেছিল শহরটি। এ প্রসঙ্গে প্রত্নতত্ত্ববিদ মুতলাক সুলেইমান আলমুতলাক বলেন, ‘এটা আমাদের সবচেয়ে বড় এক্সপেরিমেন্ট। আমরা অতীতের দিকে ফিরে তাকাচ্ছি, এটাই গুরুত্বপূর্ণ।’


আন্তরিক বন্ধুত্বপরায়ণ মানুষ মুতলাক শুধু একজন প্রত্নতত্ত্ববিদই নন, তিনি আল উলা শহরের কিউরেটরও। তিনি আমাকে জনশূন্য শহরটি ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে গেলেন। মধ্যযুগের শহরটির রাস্তা চলাচলের প্রায় অযোগ্য। তিনি আমাকে দেখালেন সেই চত্বর, যেখানে বণিকের দল প্রায় আট শতাব্দী ধরে নানা পণ্য বিকিকিনি করেছে। শূন্য বাড়ির মেঝেতে পড়ে আছে জার্মানিতে তৈরি কেরোসিন লণ্ঠন। বললেন, চতুর্দশ শতাব্দীতে এই শহরে এসেছিলেন বিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা। তিনি তার ভ্রমণকাহিনীতে শহরবাসীর সততার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন, হজযাত্রীরা মক্কা যাওয়ার পথে এখানে তাদের লাগেজ রেখে যেত। ফেরার পথে আবার তা ফেরত নিত। একটি জিনিসও খোয়া যেত না। সেই সততার অংশীদার প্রত্নতত্ত্ববিদ মুতলাক। যৌবনে তিনি এই শহরে বসবাস করেছেন। দেখেছেন, ১৯৭০-এর দশকে কিভাবে শহরবাসীকে গণহারে ট্রাকে তুলে আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টে সরিয়ে নেয়া হয়।


সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে করতে মৃদু হাসেন মুতলাক। বলেন, ''সব মনে আছে, কিছুই ভুলিনি। ব্যবসায়ীরা মিসর থেকে গাঁইটে গাঁইটে কাপড় আনতেন। কৃষকেরা সূর্য ওঠার সাথে সাথেই ছুটে যেতেন মাঠে। মেয়েরা জানালা দিয়ে এবাড়ি-ওবাড়ি কথাবার্তা বলত''।


এসব কি ভুলতে পারেন আল মুতলাক? এসব ভোলা যায়?


বিদায়বেলা


দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেল। আমার সফরও শেষ হয়ে এলো। আমার দুই গাইড আলী ও আওয়াদকে বিদায় জানালাম। হাকল সীমান্ত দিয়ে আমি সউদি আরব থেকে জর্দানে পা রাখলাম। আমার সাথে বোঝা বলতে তেমন কিছু ছিল না। কাঁধে ছিল একটি ব্যাগ। তাতে রাবার ব্যান্ড দিয়ে থোকা থোকা করে বাঁধা অনেকগুলো নোটবুক। ওতে আমার দীর্ঘ ভ্রমণের নানা বিষয়ে নোট নেয়া।


সীমান্ত পেরিয়ে আমি একটি আধুনিক ট্যুরিস্ট রিসোর্টে পৌঁছলাম। কেউ আমাকে লক্ষ্যই করল না। অনেক নারী গাড়ি চালাচ্ছে। অনেক দম্পতি সাগর সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি একটি মিনি মার্ট থেকে এক বোতল পরিশ্রুত পানি কিনলাম। বোতল তো নয়, যেন একটি ছোট প্লাস্টিকের কুয়া, যেন ইতিহাসের মূলধারার ছোট একটি টুকরা। বোতলটি হাতেনিয়ে দক্ষিণ দিকে মুখ ঘোরালাম, আকাবা উপসাগর ছাড়িয়ে হেজাজের দিকে। রহস্য রোমাঞ্চে ভরপুর হেজাজ। সেই নগরীর প্রাচীন কুয়াগুলোর মুখ দড়ি দিয়ে বাঁধা। সেই দড়িও পড়ে গলে ধুলায় মিশে গেছে। সেই ধুলাও উড়ে গেছে কালের হাওয়ায়।


আমি আমার প্লাস্টিক বোতলে মুখ দিলাম পানি খাব বলে। খেলাম। একেবারেই সাধারণ তার স্বাদ। এ তো আর হেজাজের সেই প্রাচীন কুয়ার প্রাকৃতিক পানি নয়, এ হলো পরিশোধনের বহু ধাপ পেরিয়ে বোতলবন্দী পরিশ্রুত জল। বিদেশি সাময়িকী অবলম্বনে


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com